অর্থনীতিকে বাঁচাতে জনমোহিনী
প্রস্তাবের সুযোগ ছিল না বাজেটে
বাজেট-পুজো শেষ। প্রসাদ বিতরণও সমাপ্ত। কেউ কেউ বলছেন, মিষ্টি কম। অনেকে বলছেন, তেতো। অনেক ওষুধও তো তেতো হয়। কিন্তু রোগ সারানোর জন্য খেতে হয়। এটা মনমোহন সিংহের যুক্তি। নিভে যাওয়া তুবড়ির খোলের মতো বাজেটের বাজার এখনও তপ্ত। চলছে আলোচনা, চুলচেরা বিশ্লেষণ।
শুরু করা যাক সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে চাকুরে ও মধ্যবিত্তের দৃষ্টিকোণ থেকে। সবাই আগে জানতে চান, আমি কী পেলাম। প্রত্যক্ষ কর প্রস্তাবে আহ্লাদে আটখানা হতে পারেননি এঁদের বেশির ভাগই। অন্য দিকে পরোক্ষ করের বাউন্সারে প্রায় সবাই সন্ত্রস্ত অস্ট্রেলিয়ার পিচে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মতো। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্রথম স্তরের করদাতাদের তুলনায় অনেক বেশি লাভবান হয়েছেন তৃতীয় স্তরের করদাতারা। করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে ২ লক্ষ টাকা করাতে যাঁদের আয় ২ লক্ষ টাকা বা তার বেশি, তাঁদের সকলেরই সাশ্রয় হবে ২,০৬০ টাকা। প্রথম স্তরের করদাতাদের সরাসরি কর বাবদ প্রাপ্তি এখানেই শেষ। তৃতীয় স্তরের করদাতাদের ভাগ্যে জুটেছে আরও বড় প্রাপ্তি। ২০ শতাংশ করের স্তর ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সম্প্রসারিত করায় যাঁদের বাৎসরিক আয় ১০ লক্ষ টাকা বা তারও বেশি, তাঁদের অতিরিক্ত সাশ্রয় হবে ২০,৬০০ টাকা, অর্থাৎ মোট কর কমবে ২২,৬৬০ টাকা। শতাংশের হিসাবে ১৪.৪৭ শতাংশ। খুব খারাপ নয়।
আরও যে-সব সুবিধা ব্যক্তিগত ক্ষেত্রের করদাতারা পাচ্ছেন, তার মধ্যে আছে সেভিংস ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রাপ্ত ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত সুদে কর রেহাই। এই সুযোগের পুরোটা সদ্ব্যবহার করতে পারবেন উঁচু আয়সম্পন্ন নাগরিকেরা, যাঁরা ৩৬৫ দিন ধরে সেভিংস অ্যাকাউন্টে ২.৫ লক্ষ টাকা ফেলে রাখতে পারবেন ৪% সুদে। কিছু বেসরকারি ব্যাঙ্ক অবশ্য এখন ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদ দিচ্ছে।
১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত যাঁদের আয়, তাঁরা ইক্যুইটিতে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত লগ্নি করলে করছাড় পাবেন লগ্নির ৫০ শতাংশের উপর। শর্ত হল, এই বাবদ কেনা শেয়ার তিন বছর পর্যন্ত বিক্রি করা যাবে না। এই ছাড় সাধারণ মানুষের আকর্ষণ বাড়িয়ে দেবে ইক্যুইটির প্রতি।
এ ছাড়া অসুখ রুখতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাবদ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচের উপর পাওয়া যাবে কর রেহাই। ব্যবসা থেকে কোনও আয় না-থাকলে অগ্রিম কর জমা করার প্রয়োজন নেই প্রবীণ নাগরিকদের। মোটামুটি এই হল ব্যক্তিগত ক্ষেত্রের করদাতাদের প্রত্যক্ষ প্রাপ্তিযোগ।
হারানোর তালিকাটি ছোট। কিন্তু তাতে আনন্দিত হওয়ার কারণ নেই। ২% করে উৎপাদন শুল্ক এবং পরিষেবা কর বৃদ্ধির চাপ কমবেশি অনুভব করবেন দেশের সবাই। এমনকী যাঁরা করের আওতায় পড়েন না, তাঁরাও। করযোগ্য পরিষেবার তালিকা আগের তুলনায় এখন অনেক বড়। অন্য ভাবে বলা যায়, করের আওতায় পড়বে না এমন পরিষেবার তালিকা এখন বেশ ছোট। অর্থাৎ সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে শুল্কযোগ্য পণ্য ও পরিষেবার জন্য বেশি অর্থ গুনতে। প্রাক্ বাজেট পর্বে চাকুরেরা বড় ধাক্কা খেয়েছেন প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুদ ৯.৫% থেকে এক ধাক্কায় ৮.২৫ শতাংশে নেমে আসায়। পেট্রোপণ্যের দাম বাড়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। সুতরাং বাজেট-বিধ্বস্ত মধ্যবিত্তকে এখন বলতেই হবে, বাজেট ফল তেতো।
তাকানো যাক বিনিয়োগের বাজারের দিকে। বাজেটের দিনে বাজার পড়লেও বুল-দের চাঙ্গা রাখতে কম দাওয়াই ছিল না প্রণববাবুর ব্রিফকেসে। ইক্যুইটিতে লগ্নির উপর কর ছাড়, লেনদেন কর (এস টি টি) হ্রাস। বন্ডে বিদেশি লগ্নি ইত্যাদি প্রস্তাবের সদর্থক প্রভাব অবশ্যই পড়বে বাজারে। উৎপাদন শুল্ক এবং পরিষেবা কর বৃদ্ধিকেই বাজারের সাময়িক ঝিমিয়ে পড়ার কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। কর বৃদ্ধির কারণেই অনেক পণ্যের দাম আবার বাড়বে। এই অবস্থায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এপ্রিল মাসে সুদ কমাবে কি না, তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। দাম বাড়বে ইস্পাত ও সিমেন্টের, যা ধাক্কা দেবে পরিকাঠামো ও নির্মাণ শিল্পকে। গাড়ির দাম বাড়ার প্রতিকূল প্রভাব পড়বে ইস্পাত, টায়ার, যন্ত্রাংশ, রং, ইলেকট্রনিক্স, প্লাস্টিক-সহ বেশ কিছু শিল্পের উপর।
বাড়ির চাহিদা কমলে একই ভাবে মার খাবে সংশ্লিষ্ট কিছু শিল্প। ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত গৃহঋণে ১% সুদ বাবদ ভর্তুকি অবশ্য আশার আলো দেখাচ্ছে এই শিল্পকে। শহরাঞ্চলে ৫০ লক্ষ টাকার বেশি দামে কোনও সম্পত্তি বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতার উপর দায়িত্ব বর্তেছে ক্রয়মূল্য থেকে ১% কর কেটে সরকারি কোষাগারে তা জমা করার।
বিমান শিল্পের জন্য কয়েকটি সুবিধার কথা বলা হয়েছে বাজেটে।
সোনার দাম বাড়ায় সন্ত্রস্ত স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। চিন্তিত লগ্নিকারীরাও। মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে কোনও কথা নেই বাজেটে। চলতি বছরের ৩০ হাজার কোটি টাকার জায়গায় আগামী বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকার করমুক্ত বন্ড ইস্যু করতে পারবে পরিকাঠামো সংস্থাগুলি। এর সুবিধাও পৌঁছবে মূলত ধনীদের ঘরে। অন্য দিকে ৮০ সিসিএফ ধারার কর সাশ্রয়কারী পরিকাঠামো বন্ডের উল্লেখ নেই বাজেটে। এটি তুলে নেওয়া হলে ১০, ২০ এবং ৩০% হারে করদাতারা যথাক্রমে ২০৬০, ৪১২০ এবং ৬১৮০ টাকা কর সাশ্রয়ের সুযোগ হারাবেন। অর্থাৎ কর বাবদ নীচের তলায় কোনও সাশ্রয়ই হল না।
গোটা অর্থনীতির দিক থেকে দেখলে সমালোচনার সুযোগ কম। পাহাড়-প্রমাণ ভর্তুকি দিয়ে এবং প্রতিরক্ষা, কৃষি পরিকাঠামোর জন্য বিশাল বরাদ্দের পরে জনমোহিনী প্রস্তাবের সুযোগ কমই ছিল। তা ছাড়া ভোট এত কাছে নয় যে, এ বারই মধ্যবিত্তকে হাত করতে হবে। আগে তো ভাত-কাপড় পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করা যাক। দীর্ঘ মেয়াদে এ সবের প্রয়োজনই বেশি। তবে বাজেটের পরেও মূল সমস্যা থেকেই যাবে। যা আগামী দিনেও প্রণববাবুকে ভাবাবে তা হল সেই দ্রব্যমূল্য, চড়া তেলের দাম, উঁচু সুদ এবং শিল্পের মন্থরতা।
আসলে বাজেট থেকে তাৎক্ষণিক লাভ কমই হয়। বাজেট যত গর্জে তত বর্ষে না। অনেক দেশেই বাজেট নিয়ে এত হইচই হয় না। বাজেটে এখানে অর্থনীতির তুলনায় রাজনীতিই প্রাধান্য পায়। এ নিয়ে অবশ্য প্রণবের সাধারণ বাজেটকে টেক্কা দিয়েছে ত্রিবেদীর রেল বাজেট। তবে, এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেট থেকে যতটুকু দাক্ষিণ্য পাওয়া গিয়েছে, তার অনেকটাই ধনীদের দিকে ঝুঁকে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.