‘ধর্ষিতা’র পাশে দাঁড়ানো দূরস্থান, উল্টে গ্রামের মোড়ল ও তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গেরা খুনের হুমকি দিয়ে তাঁকে গ্রামছাড়া করার চেষ্টা করছেন। মারধরও করা হয়েছে তাঁকে। পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে এই অভিযোগ জানিয়েছেন সিউড়িতে ধর্ষণের অভিযোগ আনা আদিবাসী বিধবা।
শুক্রবার সিউড়ি ২-এর বিডিও-র কাছে ওই অভিযোগ জানানো হয়। শনিবার মহকুমাশাসক (সিউড়ি সদর) সুজয় আচার্য বলেন, “বিডিও কোহেলি দাস গ্রামে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এ দিন রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। পুলিশকে ওই মহিলার নিরাপত্তা দেওয়া-সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছি।’’ মহিলার এক প্রতিবেশিনীর অভিযোগ, শুধু খুনই নয়, বাড়ি না ছাড়লে তাঁকে নগ্ন করে গ্রামে ঘোরানোর হুমকিও দিয়েছে মোড়লেরা। যদিও বিডিও বলেন, “এমন অভিযোগ পাইনি।”
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাতে মোড়ল ও তাঁদের লোকজন ওই মহিলার বাড়িতে চড়াও হয়েছিলেন। ওই রাতেই পুলিশ গ্রামে যায়। শুক্রবার দুপুরে গোপাল টুডু ও শ্যাম বেসরা নামে দুই মোড়লের বিরুদ্ধে সিউড়ি থানায় নির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের হয়েছে। কিন্তু শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ কেন কাউকে গ্রেফতার করল না, তার সদুত্তর মেলেনি। সরাসরি জবাব এড়িয়ে বীরভূমের পুলিশ সুপার হৃষিকেশ মিনা বলেন, “ওই মহিলাকে যাতে কেউ বিরক্ত না করে সে জন্য পুলিশ টহল দিচ্ছে। তদন্ত চলছে। প্রয়োজনে গ্রেফতার করা হবে।”
ঘটনাচক্রে, আদিবাসী ওই মহিলা নিজের গ্রামে তৃণমূল সমর্থক এবং অভিযুক্ত মোড়লেরা সিপিএমের কর্মী বলে পরিচিত। যদিও স্থানীয় পুরন্দরপুর পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান বাসন্তী মুর্মু বলেন, “ওই মহিলার উপরে অত্যাচার হয়েছে বলে শুনেছি। তবে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে যেতে পারিনি।” সিপিএমের সিউড়ি জোনাল সম্পাদক দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায় আবার দাবি করেন, “আমাদের দুই কর্মীকে ভিত্তিহীন অভিযোগে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে ফাঁসানো হয়েছে।”
২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কাজ সেরে ফেরার সময়ে তাঁর সঙ্গী এক রাজমিস্ত্রির মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে কয়েক জন ওই মহিলাকে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ। ওই ঘটনায় পুলিশ দু’জনকে গ্রেফতারও করেছে। কিন্তু বিডিও-র কাছে লিখিত অভিযোগে মহিলা জানিয়েছেন, তাঁর ‘অসহায়তা’র সুযোগ নিয়ে গোপাল টুডু ও শ্যাম বেসরার নেতৃত্বে কিছু লোক ঘরের দরজা ভেঙে ইট-পাটকেল ছোড়ে। ঘর থেকে বের করে তাঁকে মারধরও করা হয়। মহিলার কথায়, “ওরা আমাকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলে, অন্যথায় প্রাণে মারার হুমকি দেয়। পাশেই থাকেন আমার জামাইবাবু লপসা মাড্ডি। তিনি আমায় বাঁচাতে এলে তাঁকেও ওরা মারধর করে। পুলিশ সময় মতো না এলে ওরা আমাদের মেরে ফেলত।”
কেন এই হামলা? তিন সন্তানের জননী ওই মহিলার অভিযোগ, ঘটনার রাতে যে রাজমিস্ত্রি তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁকে জড়িয়েই কুৎসা রটানো হচ্ছে। ওই মিস্ত্রি কেন তাঁদের বাড়িতে যাতায়াত করেন, সেই প্রশ্ন তুলে তাঁর চরিত্র নিয়ে খারাপ কথা বলা হতে থাকে। মহিলার কথায়, “আমার চরিত্র নিয়ে অপবাদ দিয়ে শুক্রবার সকালে ওরা ফের আমাদের উপরে চড়াও হয়।” গোপাল টুডু অবশ্য দাবি করেন, “লপসার সঙ্গে গ্রামের কয়েক জনের গোলমাল হয়েছে। তা নিয়ে ওই মহিলা অহেতুক আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। সে জন্য আমি সকাল-সন্ধ্যা তাঁর বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। তিনি কেন আমাকে জড়িয়ে অভিযোগ তুলেছেন, জানি না।” কার্যত একই দাবি করেছেন শ্যাম বেসরাও।
গ্রামবাসীর একাংশের অভিযোগ, একই ভাবে কয়েক বছর আগেও গ্রামের দুই মহিলা ও এক পুরুষকে বাড়িছাড়া করেছিল ওই দুই মোড়ল। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তাঁরা গ্রামে ফেরেন। সে সময়ে গ্রামছাড়াদের এক জন পুতুল সোরেনের অভিযোগ, “ওরা আদিবাসী সমাজের দোহাই দিয়ে জুলুমবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।” পুলিশ সুপার এ ব্যাপারে মুখ খুলতে চাননি। তবে জেলাপুলিশের এক কর্তার দাবি, “আদিবাসীদের বিষয় বলেই কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছি না। আদিবাসী গাঁওতাকে ওই গ্রামে গিয়ে সমস্যাটি মেটাবার চেষ্টা করছি।” |