বিতর্ক...
বিতর্ক: জারোয়াদেরও দরকার উন্নয়নের সুযোগ
পক্ষে
সংরক্ষণ নয়, চাই সংযোজন
২০০৮ সালে মার্চে আন্দামানে গ্রেট আন্দামান ট্রাঙ্ক রোডের দীর্ঘ বনপথ পার হওয়ার সময় রাস্তার দু’ধারে দেখেছি, জারোয়াদের দেখে বিরক্ত না-করা, ছবি না-তোলা, খাবার না-দেওয়া ইত্যাদি সাবধানবাণী রয়েছে। পর্যটকদের কাছে বাসের জানলা বন্ধ রাখার অনুরোধ ছিল। এই পথটি অতিক্রম করার সময় আমরা দু-এক জন পোশাক-পরিহিত জারোয়ার দর্শন পেয়েছি। ২০১২-তে যে স্বল্পসংখ্যক জারোয়া এখনও রয়েছেন আন্দামানে, তাঁদের গভীর মমতা ও ভালবাসায় উন্নয়নের সুযোগ দিতে হবে, জোর-জবরদস্তি নয়। এখন ওঁরা বন্যজীবন ছেড়ে অনেকে ফিরে আসছেন নিশ্চিন্ত খাদ্য, বাসস্থানের নিরাপত্তার জীবনে।
আজ জারোয়ারা বিপন্ন-বিকৃতমনা ভদ্রসমাজের পণ্য। সহমর্মিতার সঙ্গে সমস্ত সুযোগ দেওয়াই ওঁদের রক্ষা করার একমাত্র উপায়। সেটাই মানবিকতা।
প্রাচীন জারোয়াদের জীবন ও জীবনযাত্রা থাকুক নৃতাত্ত্বিক মিউজিয়ামে। বতর্মান জারোয়ারা উন্নয়নের সুযোগে হয়ে উঠুন আমাদের সমাজে একটি নতুন গোষ্ঠীর সংযোজন।
আন্দামানি ‘আকা-বিয়া’ ভাষায় জারোয়া শব্দের অর্থ অপরিচিত জন। বিশ্বের সুপ্রাচীন জনজাতিগুলোর মধ্যে আজও প্রাণান্তকর অভিযোজন করে এঁরা ভারত সরকার সীমায়িত ৭৬৫ কিমি বনভূমি অধ্যুষিত জারোয়া সংরক্ষিত অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। আজও সভ্য-অবশিষ্ট জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ২৫০ জনের এই জনজাতি গোষ্ঠী এখন অস্তিত্বের সঙ্কটে। এঁরা আজও ‘হিউম্যান জু’-তে অমানবিক ভাবে ‘অ্যানিমাল জু’-র মতো প্রদর্শিত হচ্ছেন। ভ্রমণপিপাসু মানুষরা তাঁদের পশুর মতো চকলেট বিস্কুটের লোভ দেখিয়ে অর্ধনগ্ন অবস্থায় নৃত্য করতে বাধ্য করছে। কখনও বা সেই কুরুচিকর দৃশ্যের ভিডিয়ো ছবি নিচ্ছে। এ যেন একবিংশ শতাব্দীর রোবট-মানব সভ্যতার পাশে প্রাগৈতিহাসিক অসভ্য মানুষের ঘন কালো অন্ধকার। এই অবস্থায় তাঁদের উন্নয়নের পথকে সুগম করার দাবি উঠছে। এই দাবি ন্যায়সঙ্গত। এক নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, তাঁরা কেউ কেউ হিন্দি ভাষা বুঝতে পারেন। কিংবা সভ্য মানুষের বেশ কিছু আচরণ নকল করতে পারছেন। দ্রুত গতিতে তাঁদের পুনর্বাসন প্রয়োজন। ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটির (ন্যাক) তৈরি করা সমীক্ষার ফল যথেষ্ট নয়, তার দ্রুত এবং যথাযথ কার্যকারিতার দিকটিও নিশ্চিত করা দরকার।
সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে আজ আর ‘নেগ্রিটো’ পর্যায়ভুক্ত জারোয়াদের সংরক্ষণের আলোচনা করা বৃথা। কারণ, এখন পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান দূষণের হাত থেকে বাঁচতে-বাঁচাতে জারোয়াদেরও দরকার উন্নয়নের সুযোগ।
১৯৭১ সালে বখ্তিয়ার সিংহ নামে এক সাহসী পুলিশ জয় নামে এক ছাত্রের মাধ্যমে জারোয়াদের সঙ্গে প্রশাসনের যোগাযোগ ঘটায়। তখন নারকোল, কলা, পেঁপে, লোহা আর লাল কাপড় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থায় ওঁরা অনেকটাই বন্ধুভাবাপন্ন হন। প্রশাসন জারোয়াদের সভ্য মানুষের সংস্পর্শে আসা পছন্দ করে না। ভাবে, এর ফলে তাঁরা ধীরে ধীরে তাঁদের নিজস্বতা হারিয়ে ফেলবেন এবং রোগগ্রস্ত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। আসলে বছরের পর বছর জারোয়াদের দেখিয়ে উন্নয়ন খাতে মোটা অঙ্কের টাকার লোভে তারা চায় না যে জারোয়ারা সভ্য হোন। দরকার জারোয়াদের নিয়ে রমরমা পর্যটন ব্যবসা বন্ধ করা, আর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নৃতত্ত্ববিদ ও প্রকৃত মানবদরদি ব্যক্তিদের নির্দেশিত পদ্ধতি পালন করে জারোয়াদের উন্নয়নের সুযোগ করে দেওয়া।

বিপক্ষে
আসুন, নিজেরা সভ্য হই
ভিক্ষে দেওয়ার চেয়ে কুকুর লেলিয়ে দেওয়াতেই আমরা অর্থাৎ সভ্য মানুষরা বেশি আনন্দ পাই। বছরের পর বছর ধরে সংরক্ষণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আদিবাসী জনজাতিদের যথার্থ উন্নয়ন হয়েছে কি? হয়নি। তার বদলে সংরক্ষণের দইটুকু নেপোর দলই চেটেপুটে খাচ্ছে। তেমনই, উন্নয়নের সুযোগ দেওয়ার নামে জারোয়াদের অবস্থারও কোনও হেরফের হবে বলে মনে হয় না। তাই বলি, ‘ভিক্ষে চাই না, কুকুরটা বাঁধো’।
আমরা নিজেদের উন্নত বলে গর্ব বোধ করি। আমাদের বড় বড় বাড়ি আছে। ঝাঁ-চকচকে গাড়ি আছে। আমরা চাঁদে, মঙ্গলে রকেট পাঠাই। তবু আমরা ভাল আছি তো? না, নেই। কারণ, আমরাই দুধে ডিটারজেন্ট আর মদে কীটনাশক মেশাই। ওষুধে ভেজাল দিই। শিক্ষিকাকে কুপিয়ে মারি। নারীপাচার, নারীধর্ষণ, লাশ গায়েব আর চোরাচালানে আমরা সিদ্ধহস্ত। আমাদের উন্নয়নের নমুনা যদি এমনই হয়, তেমন উন্নয়ন জারোয়াদের কোন কাজে আসবে?
জারোয়া, সেন্টিনেলি, ওঙ্গে এ সব আদিম জনগোষ্ঠীই হল আন্দামান দ্বীপখণ্ডের স্বাভাবিক মালিক। আমরা সভ্য মানুষরা তো ভুঁইফোড়ের মতো সেখানে উড়ে (কিংবা জাহাজে চড়ে) এসে জুড়ে বসেছি। আমাদেরই জবরদখল আর অত্যাচারের দাপটে প্রকৃতির সন্তান জারোয়াদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। নিজভূমে পরবাসী হয়ে আজ তাঁরা বিলুপ্তির মুখোমুখি। তাই উন্নয়নের মায়াকান্না নয়, নগর সভ্যতার বিষবৃক্ষ নয়, সবুজ অরণ্যের সমগ্র দ্বীপখণ্ডই ওঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
আন্দামানের আদিমতম অধিবাসী জারোয়াদের উন্নয়নের সুযোগ দেওয়া কতটা বাস্তবসম্মত, প্রথমে সেটাই বিবেচ্য। বর্তমানে যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে আমাদের জীবন যাপিত, তা অনেক সাধনায় বিজ্ঞানের কল্যাণে পাওয়া। বহুবিধ আরামদায়ী ভোগ্যবস্তুর সঙ্গে পেয়েছি ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ থেকে দুরারোগ্য মারণরোগ ও মারণাস্ত্র। আমাদের সেই তথাকথিত উন্নয়ন হাজার বছর অথবা আরও বেশি প্রাচীন বনজীবনে অভ্যস্ত এই আদিম মানবগোষ্ঠীর উপর কতটা প্রযোজ্য, তা ভাববার বিষয়। ওঁরা আছেন দূষণহীন উন্মুক্ত আকাশতলে প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের মাঝে। ওঁদের আছে নিজস্ব জীবন ও জীবিকা। ওঁরা বনেই সুন্দর। ওঁরা ওঁদের মতো থাকুন। এই মর্মে ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্টেরও নির্দেশ আছে। সেই অনুযায়ী সংযত থাকাই ভাল। নচেৎ উন্নয়নের চোরাগলি দিয়ে এক দিন বিষও তাদের কাছে পৌঁছে যাবে।
চার্লস ডারউইনের তত্ত্ব থেকে আমরা জেনেছি, জীবনযুদ্ধে তারাই বেঁচে থাকে যারা পরিবেশে যোগ্যতম বলে বিবেচিত হয়। অর্থাৎ পরিবেশের ঝড়ঝাপ্টাকে চ্যালেঞ্জ করে যারা এখনও বহাল তবিয়তে বেঁচেবর্তে রয়েছে। তাদের কি খুব দরকার মানুষের সাহায্যের? সম্প্রতি সুনামি বিধ্বস্ত আন্দামানে বহু পর্যটক, সাধারণ মানুষ মারা গেছেন, কিন্তু জারোয়াদের মৃত্যুর খবর তো সে ভাবে পাইনি। তাঁরা আগাম প্রকৃতির এই বীভৎসতা আঁচ করে পাহাড়ের উপরে উঠে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁদের তো কেউ অ্যালার্ট করেনি। এই আদিম জাতি প্রকৃতির বুকে লালিত, তাঁরা প্রকৃতিকে আমাদের মতো সভ্য সমাজের থেকেও বেশি বোঝেন, চেনেন। যেখানে প্রকৃতি তাঁদের পাশে, সেখানে মানুষ তাঁদের কী উন্নয়নের সুযোগ করে দেবে? তাঁদের জন্য তো সরকার অনেক রকম ভেবেছে, তাঁদের জন্য জঙ্গলে আলোর ব্যবস্থা, পানীয় জল, ওষুধ পৌঁছেছে। তাঁরা কিন্তু সেগুলি ঠিক ভাবে গ্রহণ করেননি, বরং নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে মানুষের নাগালের অনেক বাইরে অর্থাৎ গভীর জঙ্গলে চলে গেছেন। পৃথিবীতে বর্তমানে এ রকম আদিম জাতি খুবই কম টিকে আছে। ‘বন্যেরা বনে সুন্দর’। বনের বাস্তুতন্ত্রে তাঁরাও এক জন। শিকার, ফলমূল সংগ্রহ করে থাকুন না ওঁরা ওঁদের মতো। নাই বা ভাবলাম তাঁদের ‘উন্নয়ন’-এর কথা। তাঁদের ক্ষতি না-করে, তাঁদের সামাজিক জীবনে হস্তক্ষেপ না-করে তাঁদের নিজেদের মতো করে বাঁচতে দিলামই না-হয়। তাঁরা আমাদের বলছেন, ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’। আমাদের তোমরা বিরক্ত কোরো না।

এপ্রিল মাসের বিতর্ক
আপনার চিঠি পক্ষে না বিপক্ষে, তা স্পষ্ট উল্লেখ করুন।
চিঠি পাঠান ২৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই ঠিকানায়
মার্চের বিতর্ক,
সম্পাদকীয় বিভাগ,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.