প্রবন্ধ... যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি
স্বপ্ন দেখা এবং আমার ভয়ে কেঁপে ওঠা
কেশবচন্দ্র সেনের মেয়ে সুনীতির সঙ্গে কোচবিহারের রাজকুমারের বিয়ে উপলক্ষে বাংলার সমাজে আর সাংস্কৃতিক জগতে যে প্রবল আলোড়ন চলেছিল, তা অনেকেই জানেন। কবে, বিয়ের রাতে এবং নববধূ হিসেবে রাজপ্রাসাদে গিয়ে সুনীতি কী অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা কিছুটা অস্পষ্ট। শেষ জীবনে সুনীতিদেবী একটা আত্মজীবনী লিখেছিলেন ইংরেজিতে। তার থেকে অনেক তথ্য জানা যায়।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবর্তিত ব্রাহ্ম ধর্মের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র কেশবচন্দ্র। শিক্ষিত, মুক্তচিন্তার অধিকারী এবং উদ্যমী পুরুষ। সেই সময় হিন্দু ধর্ম নানা রকম কুসংস্কার, কদাচার ও কুপ্রথায় জর্জরিত। রূপকার্থে বলা যায়, হিন্দুত্বের গা থেকে পচা গন্ধ বেরোচ্ছে। সেই সময় ব্রাহ্মরা নতুন আলোর সন্ধান দিয়েছিলেন। ব্রাহ্মরা যদিও বলতেন যে, তাঁদের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁরা নতুন এক ধর্মে দীক্ষিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হিন্দুধর্মেরই এক পরিচ্ছন্ন ও সুসংস্কৃত রূপ।
একেশ্বরবাদ কিন্তু হিন্দু ধর্মেও একেবারে অপরিচিত নয়। ব্রাহ্ম ধর্ম যদি প্রবল ভাবে প্রচারিত হত, সাধারণ মানুষকে সহজ ভাবে আকৃষ্ট করা যেত, তা হলে সেই সময়কার ইতিহাস অন্য রকম হত।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই নব্য ধর্ম হয়ে রইল ওপরতলার মানুষদের ব্যাপার, এলিটিস্ট। খ্রিস্টানরা তাদের গৃহভৃত্য কিংবা ক্রীতদাসদেরও নিজেদের ধর্মে টেনে আনত। মুসলমানরা, যে হেতু তাদের ধর্মে বর্ণভেদ নেই, অস্পৃশ্যতা নেই, তাই সমস্যাদীর্ণ হিন্দু সমাজের তথাকথিত নিচুতলার মানুষ, শূদ্র এবং অন্যান্যরা বামুন কায়েতদের অত্যাচারে ও অপমানে অস্থির হয়ে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। আর হিন্দু ধর্মে নতুন কাউকে আহ্বান তো নেই-ই, নিজেদের ধর্ম থেকে বহু মানুষকে ঠেলে বার করে দিয়েছে, সামান্যতম কারণে।
কেশবচন্দ্র সেন, সুনীতি দেবী ও নৃপেন্দ্রনারায়ণ
আরও দুঃখের কথা, নতুন ব্রাহ্ম ধার্মিকরা নিজেদের দৃঢ় ভাবে সংগঠিত করার আগেই দলাদলি আর বিচ্ছেদ শুরু করে দেয়। দেবেন্দ্রনাথের তুলনায় কেশবচন্দ্র অনেক আধুনিক চিন্তাধারার অধিকারী। দু’জনের মধ্যে মতভেদ শুরু হয়। এক সময় আদি ব্রাহ্ম সমাজ থেকে সদলবল বেরিয়ে এলেন কেশবচন্দ্র। নিজে আলাদা দল গড়লেন, ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ। এক থেকে হল দুই, আর কিছু কালের মধ্যেই এই সমাজ তিন টুকরো হয়ে যাবে। দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে কেশবচন্দ্রের এই বিরোধের অনেক কারণ আছে। আত্মজীবনীতে সুনীতি লিখেছেন, অন্যতম কারণ দলের মধ্যে তাঁর বাবার বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে মহর্ষি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। (মহাপুরুষদেরও ঈর্ষা হয়?)
কেশবচন্দ্র তাঁর নতুন দল নিয়ে অনেক সমাজ-সংস্কারে ব্রতী হন। বিশেষত, নারীদের মুক্তির ব্যাপারে তাঁর উদ্যোগ বিশেষ প্রশংসনীয়। তখনকার দিনে আট, ন’বছর বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। লেখাপড়া শেখার বিশেষ সুযোগ ছিল না। বাকি জীবন অন্তঃপুরে বন্দিনী হয়ে থাকাই ছিল তাদের নিয়তি। এর মধ্যে আবার বিধবা হয়ে গেলে তো তাদের উপর অত্যাচার এবং নিষ্ঠুরতার কোনও সীমা থাকত না।
কেশবচন্দ্র নারীদের শিক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। বাল্যবিবাহ রোধ করতে না-পারলে এই শিক্ষাও অর্থহীন। মেয়েদের বিয়ের বয়স হওয়া উচিত অন্তত চোদ্দো বছর আর ছেলেদের আঠারো। দলবল সমেত কেশবচন্দ্রের আন্দোলনের ফলেই সরকার বিয়ের এই বয়সের সীমা মেনে নিয়ে বিবাহ বিষয়ে একটা আইন জারি করে। লোকের মুখে মুখে তার নাম হয়ে যায় তিন আইন। এটা কেশবচন্দ্রেরই জয়।
কিন্তু এর পর কী হল? কোচবিহারের রাজবাড়ি থেকে যুবরাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে কেশবচন্দ্রের বড় মেয়ে সুনীতির বিয়ের প্রস্তাব এল। কিন্তু সুনীতি তখনও চোদ্দো বছরে পৌঁছাননি। আর নৃপেন্দ্রনরায়ণেরও বয়স আঠারোর কম। তবু কেশবচন্দ্র এই বিয়ের প্রস্তাব মেনে নিলেন।
প্রথমে সবাই হতবাক হয়েছিল। বিয়ের বয়সের সীমা নিয়ে কেশবচন্দ্র যে আন্দোলন করেছিলেন, নিজেই তা ভাঙতে রাজি হয়ে গেলেন? বাংলার সমাজে এটা একটা দারুণ আলোচনা ও নিন্দামন্দের প্রধান বিষয় হয়ে উঠল। কেশবচন্দ্র রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য এত দুর্বল হয়ে গেলেন কেন?
রাজপরিবার থেকে আরও দাবি জানানো হল যে, বিয়ের অনুষ্ঠান হবে হিন্দু মতে। এবং কেশবচন্দ্র নিজে কন্যা সম্প্রদান করতে পারবেন না। কারণ, তিনি এর আগে বিলেতে গিয়েছিলেন, সে জন্য জাতিচ্যুত। হিন্দু পুরোহিতরা এসে এই বিবাহ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন।
আসলে এই অভিনব বিয়ের প্রস্তাবের পিছনে ছিল ইংরেজ সরকারের কারসাজি। কোচবিহার তখনও পুরোপুরি ইংরেজদের অধীন না-হলেও রাজপরিবারের অনেক বিষয়েই কলকাঠি নাড়েন ইংরেজ প্রতিনিধিরা। তাঁদের ইচ্ছা ছিল, নৃপেন্দ্রনারায়ণকে তাঁরা বিলেতে ঘুরিয়ে আনবেন। আর রাজকুমারের স্ত্রী কিছুটা ইংরেজি জানবে। এবং বড় বড় রাজপুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারবে।
তখন কেশবচন্দ্রের পরিবারের মেয়েরাই ছিল প্রগতিশীল। পাত্রপক্ষ যা চাইবে, তাই শুনতে হবে। এর প্রতিবাদ করার সুযোগ কেশবচন্দ্রের নেই। শুধু তিনি চাইলেন রাজপরিবার থেকে একটা ঘোষণা যে, নৃপেন্দ্রনারায়ণ এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী এবং বহুবিবাহের বিরোধী। নৃপেন্দ্রনারায়ণ বিলেত যাবেন বলেই এই বিয়ের ব্যবস্থা দ্রুত সেরে ফেলতে হবে।
এই উপলক্ষে কেশবচন্দ্র বার বার অপমানিত হয়েছিলেন এবং মেনেও নিয়েছিলেন।
বিয়ের রাত্তিরেও নানা রকম মতবিরোধ হয়েছিল। বিয়ে প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। সুনীতির মা চাইছিলেন, বিয়ের অনুষ্ঠান ছাঁটাই করে সংক্ষিপ্ত ভাবে যেন কিছু ব্রাহ্ম প্রথাও অনুসৃত হয়। আর রাজমাতা ধরে বসে রইলেন যে, বিয়ে হবে পুরোপুরি হিন্দু মতে। হিন্দু মতে না-হলে তা সিদ্ধ হবে না। সুনীতিও মহারানির মর্যাদা পাবেন না। এবং সুনীতির মাকে বেশ অপমানজনক ভাষায় এ সব শুনতে হল।
এই তর্কাতর্কিতে বিয়ের সব অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে গেল। বিয়ের সব আলোর রোশনাই ও সাজসজ্জা, সব বন্ধ হয়ে গেল। সুনীতি লগ্নভ্রষ্টা হওয়ার উপক্রম হল। বাংলার সমাজে লগ্নভ্রষ্টা কুমারীদের যে কত রকম অপমান ও নির্যাতন সইতে হয়, তা অনেকেই জানেন।
পরে রাত তিনটের সময় আর একটা লগ্ন ছিল। রাজকুমার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে ডেকে তোলা হল। কেশবচন্দ্রকে নিয়ে আসা হল বিবাহবাসরে। কেশবচন্দ্র সবই মেনে নিলেন। নমো নমো করে বিয়ে হয়ে গেল। এর পরেও কোচবিহারের রাজবাড়িতে সুনীতিকে অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছে।
তিনি যখন গর্ভবতী হন, তখনই জেনে গিয়েছিলেন পুত্রসন্তান না-জন্মালে সে রানিকে অপয়া মনে করা হয়। তার প্রতি আকারে-ইঙ্গিতে প্রচুর বিদ্রুপ বর্ষিত হয়। কিন্তু সন্তান ছেলে না মেয়ে, তা তো জানার কোনও উপায় ছিল না। শেষের দিকে একটা মাস সুনীতির নিদারুণ উৎকণ্ঠার মধ্যে কেটেছিল। সুখের বিষয়, সুনীতির প্রথম সন্তানটি তো ছেলেই হয়।
এ দিকে কেশবচন্দ্র সেনের এই কাণ্ডের পর, ব্রাহ্ম ধর্মের তরুণ নেতারা খুবই আহত বোধ করেন। আবার এই সমাজ ভেঙে তৃতীয় একটি দল তৈরি করেন শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ। সেটার নাম দেওয়া হয়, সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ। অর্থাৎ এক প্রজন্মের মধ্যেই ব্রাহ্মদের দল তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এদের নিয়ে সুদূরপ্রসারী কোনও ব্যবস্থার প্রবর্তন করার সম্ভাবনা ছিল না।
সুনীতির ইংরেজি আত্মজীবনীটি আমি এখনও পড়ার সুযোগ পাইনি। তবে ‘বলাকা’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকায় চিত্ররেখা গুপ্ত ওই বইটি সম্পর্কে একটি বিস্তৃত প্রবন্ধ লিখেছেন। তার থেকে আমি অনেক কিছু জেনেছি।
ধনঞ্জয় ঘোষালের সম্পাদনায় ‘বলাকা’ একটি বিশেষ ধরনের পত্রিকা। গল্প-উপন্যাসের পরিবর্তে কোনও একটি বিষয়ের উপর মূল্যবান লেখা আমি এই পত্রিকায় দেখেছি। যেমন, এই সংখ্যার বিষয় ‘নবচেতনায় বঙ্গনারী’। এই সংখ্যাটি নারীস্বাধীনতা বা নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের অবশ্য সংগ্রহযোগ্য।
‘কোরক’ পত্রিকাটিও প্রতি সংখ্যার বিষয় ভিত্তিক। তাদের নতুন সংখ্যাটির বিষয়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, তাঁর রচনা ও জীবন। বাংলা ভাষার এখনকার প্রবীণতম কবি নীরেন্দ্রনাথ আজও সৃষ্টিশীল।

এই লেখাটি লেখার পর রাত্তিরে আমি বেশ বড় আকারের একটা স্বপ্ন দেখলাম। রাস্তায় একটা মিছিল বেরিয়েছে, তা এগিয়ে আসছে আমারই বাড়ির দিকে। সেই মিছিলে এক জনও পুরুষ নেই, সবই নারী। কাছাকাছি আসার পর তাদের স্লোগান শুনে আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম। এরা বলছে, আগামী পাঁচ বছর কোনও পুরুষ লেখকের কোনও কিছু লেখার অধিকার থাকবে না। সকলের কলম কেড়ে নেওয়া হবে। মিছিলে বেশ কয়েকটি পরিচিত মুখও দেখলাম।
আমি নীচে নেমে গিয়ে সেই মিছিলের সামনে দু’হাত তুলে বললাম, পুরষদের লেখা বন্ধ? অনেক পুরুষই তো নারীস্বাধীনতার বিষয়ে লেখে। আমি নিজেকে একজন কট্টর নারীবাদী বলে মনে করি। লেখা বন্ধ হয়ে গেলে আমি বাঁচব কী নিয়ে?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.