রাজ্য প্রশাসনকে ‘সক্রিয়’ রাখার পাশাপাশিই সাধারণ ধর্মঘট ‘ব্যর্থ’ করতে রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে চলেছে তৃণমূল। দলীয় স্তরে বিভিন্ন সভা-সম্মেলন করে তারা মঙ্গলবারের ধর্মঘট রুখে দেওয়ার ‘আহ্বান’ জানাচ্ছে। ধর্মঘটের দিন জনজীবন স্বাভাবিক রাখার আবেদন জানিয়ে মন্ত্রী এবং তৃণমূল নেতারা জেলায় জেলায় ঘুরছেন। কিন্তু এই ধর্মঘট-বিরোধী প্রচার চালাতে গিয়েই বিরোধীদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যার ফলে, ধর্মঘটের প্রাক্কালে বিতর্কে সরগরম রাজ্য-রাজনীতি।
সরকার এবং শাসক দলের ‘দমন নীতি’তে সাড়া না-দিয়ে ধর্মঘট ‘সফল’ করার জন্য রবিবার কলকাতায় বাজার-সভা এবং নানা এলাকায় স্থানীয় মিছিল করেছে বামফ্রন্ট। কিন্তু তাদের সেই কর্মসূচিতেও তৃণমূল বাধা দিচ্ছে, দোকানে-বাজারে ‘ভয়’ দেখানো হচ্ছে বলে বাম নেতৃত্বের অভিযোগ। ধর্মঘট ‘ব্যর্থ’ করার নামে যে ভাবে ‘সন্ত্রাসে’র পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে, তার প্রেক্ষিতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আবেদন জানিয়ে আজ, সোমবার কলকাতার পুলিশ কমিশনারের দ্বারস্থ হচ্ছে কলকাতা জেলা বামফ্রন্ট। ধর্মঘটীদের পক্ষে সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তী প্রশ্ন তুলেছেন, “জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না? বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তারা এত ভয় পাচ্ছে কেন? মানুষ যাদের সঙ্গে আছে, তাদের কথা তো মানুষের এমনিই শোনার কথা! এত জোর খাটাতে হচ্ছে কেন?”
তৃণমূল নেতৃত্বও তাদের পাল্টা প্রচারে অনড়। কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের তৃণমূল-প্রভাবিত কর্মী সংগঠন ‘ধমর্ঘট-বিরোধী’ সম্মেলন করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী হলে। সম্মেলনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এবং রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর উপস্থিতিতে সাধারণ ধর্মঘটের বিরোধিতা করে ওই দিন সব প্রতিষ্ঠান চালু রাখার জন্য প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। |
সিটু, আইএনটিইউসি, বিএমএস-সহ ১১টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের ডাকা সাধারণ ধর্মঘটকে ঠেকানোর আর্জি জানিয়ে মুকুলবাবু বলেন, “বাংলায় কর্মসংস্কৃতি ফেরানোর যে কর্মসূচি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়েছেন, রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে কাজ তিনি শুরু করেছেন, তা এই বন্ধ করে পিছিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাকে আমরা ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখছি।” রেল, বিমানবন্দর, বন্দর, কয়লা-সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার কর্মীরা এক দিন ধর্মঘট করলে রাজ্যের মাথায় যে আর্থিক ক্ষতির বোঝা আরও বাড়বে, তা জানিয়ে ওই সম্মেলনে পূর্ণেন্দুবাবু বলেন, “একে তো ৩৪ বছরের বাম শাসনে রাজ্যের মাথায় ২ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি দেনার বোঝা রয়েছে। তার উপরে একটি বাণিজ্য সংস্থা জানিয়েছে, এক দিনের ধর্মঘটে ৮৮ কোটি টাকার ক্ষতি হবে।” সম্মেলনের আয়োজক তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের রাজ্য সভানেত্রী দোলা সেনের বক্তব্য, “বাম শাসনে আমাদের রাজ্য অনেক পিছিয়ে গিয়েছে। আমরা আর পিছোতে চাই না। আমরা এগোতে চাই। ২৮ ফেব্রুয়ারি আমরা কাজ করতে চাই।” কাল বিভিন্ন সংস্থায় ‘স্বাভাবিক কাজকর্ম’ চালু রাখতে আজ, সোমবার রাত থেকেই ধর্মঘট-বিরোধী শ্রমিক-কর্মীরা কারখানায় থাকতে চান বলে সংস্থা কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিচ্ছেন দোলা।
পক্ষান্তরে, ধর্মঘটকারীদের প্রশ্ন সরকার এবং প্রধান শাসক দলের ‘অতি সক্রিয়তা’ নিয়েই। ধর্মঘটের পক্ষে প্রচার চালানোর জন্য ট্যাংরা এলাকায় এ দিন একটি মিছিলের পথ বারবার রোধ করা হয় বলে বামেদের অভিযোগ। কলকাতা জেলা বামফ্রন্ট এ সবের প্রেক্ষিতে এ দিনই জরুরি বৈঠকে বসে। পরে কলকাতা জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক দিলীপ সেন বলেন, “যে ভাবে সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে, সেই ব্যাপারে পুলিশ কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। শ্রমিক-কর্মচারীদের এবং মানুষকে আমরা বলছি, কোনও ভাবেই প্ররোচনায় পা দেওয়া যাবে না।” একই সুরে সিপিএমের কলকাতা জেলার নেতা রবীন দেব বলেন, “আমরা শুধু আবেদন-নিবেদন করব ধর্মঘটে যোগ দেওয়ার জন্য। সংঘাতে যাব না। যে ভাবে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে, তার পরে কিছু ঘটলে প্রশাসনকেই দায় নিতে হবে।” বিরোধীদের প্রশ্ন, খাস কলকাতাতেই ধর্মঘটের প্রশ্নে মিছিল করতে গিয়ে ‘হুমকি’র মুখে পড়তে হলে বাকি রাজ্যে কী হবে?
পূর্ণেন্দুবাবু, মুকুলবাবুরা অবশ্য এ দিনের সম্মেলনে বার বার বলার চেষ্টা করেছেন, দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য তাঁরা শ্রমিক আন্দোলনের বিরোধী নন। এমনকী, শ্রমিকের আন্দোলনের অধিকার কেড়ে নেওয়াও তাঁদের সরকারের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে শাসক তৃণমূল ও তার শাখা সংগঠন যে রীতিমতো ‘শক্তি প্রদর্শনে’ নেমেছে, তার ইঙ্গিত মিলেছে সম্মেলনে দলের নেতা-মন্ত্রীদের কথায়। পূর্ণেন্দুবাবু, মুকুলবাবু, দোলা তো বটেই, দলের বিধায়ক তমোনাশ ঘোষও বলেন, “আমরা ওঁদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলছি, ২৮ তারিখ রাজ্যে সব কিছু চালু থাকবে।” পাশাপাশি, দলীয় কর্মীদের প্রতি পূর্ণেন্দুবাবুর সতর্ক-বার্তা, “আগ বাড়িয়ে কেউ কোথাও গোলমালে যাবেন না। আমরা চাই না, কারখানার গেটে মারদাঙ্গা হোক।”
হুগলির পুড়শুড়ায় দলের কর্মিসভায় তৃণমূলের মহাসচিব তথা শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যয়ের ‘পরামর্শ’, “হাতজোড় করে হাটে-বাজারে-অফিসে মানুষকে বলতে হবে, উন্নয়নের গতি থমকে দিতেই সিপিএম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বন্ধ ডেকেছে।” ধর্মঘট মোকাবিলায় শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ির প্রশাসনিক ও পুলিশ-কর্তাদের নিয়ে এ দিন শিলিগুড়িতে বৈঠক করেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। পরে গৌতমবাবু বলেন, “উত্তরবঙ্গে উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছে। বন্ধ ডেকে তা থমকে দেওয়ার চেষ্টা আমরা মেনে নেব না।” মুর্শিদাবাদে মন্ত্রী সুব্রত সাহা এবং বর্ধমানে সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীও একই ভাবে ধর্মঘট ‘ব্যর্থ’ করার কথা বলেছেন।
কাল কাজে যোগ না-দিলে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে রাজ্যের মন্ত্রীরা ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়েছেন। বাম নেতারা তা নিয়ে প্রতিবাদও জানিয়েছেন। পূর্ণেন্দুবাবু এ দিন বলেন, “সরকারি কর্মচারীদের কাজে বাধা দান আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। সেই কাজই করার চেষ্টা হচ্ছে।” কাজে যোগদানে ইচ্ছুক সরকারি কর্মচারীদের বাধা দিলে সরকার ‘শাস্তিমূলক’ কী ব্যবস্থা নেবে, তা অবশ্য শ্রমমন্ত্রী বলেননি। তবে ধর্মঘটী শ্রমিক সংগঠনগুলিকে কেন্দ্রীয় সরকার আলোচনায় বসার আহ্বান জানালেও তারা সাড়া দেয়নি বলে অভিযোগ করে পূর্ণেন্দুবাবুর মন্তব্য, “এটা স্বৈরাচারী, স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা!”
সিটুর তরফে শ্যামলবাবুর পাল্টা বক্তব্য, “যাদের বিরুদ্ধে ধর্মঘট, সেই কেন্দ্রীয় সরকার তাদের কর্মচারীদের কাজে যোগদানে বাধ্য করার জন্য নির্দেশিকা দেয়নি! আর এখানে রাজ্য সরকার ফতোয়া জারি করে বসে রয়েছে!” ফরওয়ার্ড ব্লকের জাতীয় সম্পাদক জি দেবরাজনও বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের সঙ্গে ‘অন্তর্ঘাত’ না-করে তৃণমূলের উচিত ছিল, তাদের শ্রমিক সংগঠনকে ধর্মঘটে যোগ দেওয়ানো। পরিবর্তে তাদের নেতৃত্বাধীন সরকার যা করছে, কোনও রাজ্যই তা করছে না। আর রবীনবাবুর মন্তব্য, “এই সরকার ১৮২৭ দিন (দু’টি লিপ ইয়ার ধরে) কাজ করুক। কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু আমাদের ঘাড়ে সব কিছু চাপিয়ে দেওয়া হবে কেন? ব্রিগেড সমাবেশের পরেই ওঁরা হামলা শুরু করেছেন। হিংসার পথ ধরে ধর্মঘটকে বানচাল করার চেষ্টা চলছে।”
ঘটনাপ্রবাহেই স্পষ্ট, সাম্প্রতিক কালে ধর্মঘট ঘিরে এত ‘উত্তেজনা’ দেখেনি রাজ্য! |