প্রথম নেপোলিয়ানের সময় ফ্রান্সের যে সামাজিক বিধি নির্মিত হইয়াছিল, তাহাতে মহিলাদের কুমারীত্ব-নির্দেশক সম্বোধন ‘মাদমোয়াজেল’ ব্যবহারের বিধি গড়িয়া উঠিয়াছিল। ক্রমে এই কুমারীত্ব-সূচক সম্বোধনটি বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। পুরুষের কৌমার্য হইয়াছে কি না তাহা লইয়া মাথা ঘামাইবার দায় নাই, কিন্তু মহিলাদের কুমারীত্ব বজায় রহিয়াছে কি না তাহা না জানিলে চলিবে কেন! এমনকী সরকারি কাজকর্মে আত্মপরিচয় দানের সময় ইহা আবশ্যক ছিল। ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলিতে চাহিলে, দোকান হইতে দ্রব্যাদি কিনিবার সময় অহেতুক কেন কুমারী না অকুমারী ইহা ঘোষাইতে হইবে তাহা বোঝা ভার। পুরুষদের ক্ষেত্রে বহু দিনই মঁসিয়ের বদলে কেবল স্যর প্রচলিত হইয়াছিল। ইংরাজিতেও মিস আর মিসেস-এর ব্যবহার লুপ্তপ্রায়। ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ফ্রঁসোয়া ফিলোঁ ফরাসিনিদের উপর হইতে কুমারীত্ব ঘোষণার দায় প্রত্যাহার করিয়াছেন। বেশ করিয়াছেন।
সম্বোধনের কথা যদি বিচার করিতে হয়, দেখা যাইবে বঙ্গমহিলাদের নামের পূর্বে কুমারী আর নামের পশ্চাতে দেবী ব্যবহারের পুরাতন রীতির দাপট অনেক কমিয়াছে। দেবী ছাড়াও একদা মহিলাদের নামের পশ্চাতে দাসী ব্যবহার করা হইত। সে রীতিও গিয়াছে। এই উপসর্গ ও অনুসর্গগুলি নারীদের বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করিতে চাহে। তাহাদের সাপেক্ষ পদ করিয়া রাখাই উদ্দেশ্য। দাসী মানে স্বামীর দাসী। পতি পরম গুরু রমণী তাঁহার চরণতলাশ্রয়ে থাকিবেন। যাহা বলিবেন স্বামী দেবতা, তাহাই শুনিবেন, স্বামী দেবতা যাহা করিবেন, তাহা মানিয়া লইবেন। বুক ফাটিবে, তবু রমণীর মুখ ফুটিবে না। বঙ্কিম সূর্যমুখীর কথা লিখিয়াছিলেন বিষবৃক্ষ উপন্যাসে। সেখানে সূর্যমুখী তাঁহার স্বামী নগেন্দ্রর দাসী। তাঁহাদের শয়নকক্ষে দাসী শব্দটি সূর্যমুখী খোদাই করাইয়াছিলেন। আর নগেন্দ্র যখন অপর রমণীর প্রেমে পড়িলেন, তখন বিবাহবিচ্ছেদ না লইয়া দাসী সূর্যমুখী স্বামীর বিবাহ দিয়া অভিমানে গৃহত্যাগ করিলেন।
দাসী হইতে দেবী উত্তম কিছু নহে, বাঁধিবারই আর এক ছল। বঙ্কিম প্রফুল্ল নামক মেয়েটিকে প্রয়োজন মতো দেবী বানাইয়াছেন, আবার শেষে দেবীত্ব মোচন করিয়া ঘাটে বাসন মাজাইয়াছেন। মহিলাদের কুমারীত্ব লইয়া, হায়া লইয়া বঙ্গদেশে একদা বিচিত্র রীতিনীতি ছিল। কুমারী মেয়ে কী করিবেন না করিবেন তাহার নানা বিধি, আবার কুমারী থাকিলে নানা অপরূপ অলৌকিক শক্তির উদ্ভব হয় এমন বিচিত্র বিশ্বাস বজায় ছিল। কুমারী, দাসী, দেবী ইত্যাদি অভিধা বঙ্গললনাদের নামের আগুপিছু হইতে অনেকটাই গিয়াছে, বেশ হইয়াছে। প্রশ্ন হইল, নামের পিছন হইতে গিয়াছে, কিন্তু পুরুষশাসিত সমাজের মন হইতে গিয়াছে কি! নারীরা পুরুষদের লালসার স্বীকার হইলে অসম্মানিত বা ধর্ষিত হইলে বঙ্গসমাজ তো এখনও অনেক সময় মেয়েদের দোষ দেয়। যে মন মেয়েদের কুমারী, দাসী, দেবী করিয়া রাখিতে চাহে, সেই মনই পুরুষদের লালসার দায় মেয়েদের উপরে চাপাইয়া দেয়। কেহ বলপ্রয়োগ করিয়া ‘কুমারীত্বে’ বা ‘সতীত্বে’ আঘাত করিলে তাহা যেন মেয়েটিরই দোষ। এই মন কে বদলাইবে? কবেই বা? |