|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য... |
|
ভেঙে ফেলেছেন কল্পরূপাত্মক মায়াবী আবেশ আকৃতিতে চলছে |
শেখর রায়ের একক প্রদর্শনী। ঘুরে এসে লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
সমস্তই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অস্তিত্বের গভীর থেকে উঠে আসছে আর্ত চিৎকার। বিশ্লিষ্ট হচ্ছে শরীর। অভ্যন্তরের প্রত্যঙ্গগুলি বেরিয়ে আসছে। মস্তিষ্কের ভিতর শোনা যাচ্ছে গিয়ার আর পিনিয়নের ক্রেংকার। আলো নেই কোথাও। এ রকমই এক নিশ্ছিদ্র তমসার পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন শেখর রায় আকৃতি গ্যালারিতে। এই চিত্রমালার সব ছবিই কাগজের উপর জলরঙে আঁকা। জলরঙের চরিত্রকেও আমূল পাল্টে নিয়েছেন শিল্পী। স্বচ্ছতা বজায় আছে। সজলতাও বজায় আছে। তবু প্রয়োগের নৈপুণ্যে এগুলিই কঠিন এক আর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। জলরঙের সাধারণ চরিত্রের এই রূপান্তরণ ১৯৬০-এর দশক পরবর্তী আমাদের আধুনিকতাবাদী চিত্রকলায় অবশ্য নতুন নয়। শ্যামল দত্তরায় বা ভূপেন খক্করের সমাজবাস্তবতা ভিত্তিক জলরঙের ছবিতে পেলবতা বর্জিত অন্তর্লীন সংহতি আমরা দেখেছি। কিন্তু শেখরের এ বারের জলরঙের ব্যবহার সেই ধারা থেকে অনেকটাই আলাদা। অবয়বের ভিতর অন্ধকারকে তিনি অনেক তীব্র করেছেন। কালো ও লালের সংঘাতকে অনেক ক্ষেত্রেই এই লক্ষ্যে ব্যবহার করেছেন। শুভ্রতার ভিতর থেকে অপসারিত করেছেন আপাত-মায়াকে। শুভ্র প্রেক্ষাপটের সেই নিপাট শূন্যতা শরীরের অন্ধকারকে আরও গহন করেছে।
প্রতিবাদী চেতনা সব সময়ই শেখরের ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ১৯৮৫-তে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর প্রথম একক ‘ইনটেলেকচুয়াল’ শিরোনামে। শ্লেষাত্মক সেই চিত্রমালায় বাস্তবতার যে বিশ্লেষণ ছিল, ক্রমান্বয়ে তা আরও ঘনীভূত হতে থেকেছে। পরবর্তী কালে ক্যানভাসে বড় পরিসরে যখন তিনি অ্যাক্রিলিকে কাজ করেছেন, তখন বিশেষ এক ধরনের জ্যামিতিক বিন্যাস ও বুনোটের ব্যবহারে নিজস্ব এক রূপরীতি তৈরি করতে পেরেছেন, যা থেকে তাঁর ছবিকে সহজেই চিনে নেওয়া যেত। বাস্তবতাকে কল্পরূপের দিকে নিয়ে যাওয়ার সেই প্রক্রিয়ার ভিতরে প্রচ্ছন্ন থাকত তাঁর প্রতিবাদী চেতনা। তবু সেই অবয়ব বিন্যাসে এক মায়াবী আলোছায়ার খেলা চলত। ছায়াকে সব সময় তত নিপাট কালো মনে হত না। আশার আলোর প্রচ্ছন্ন প্রতিফলন থাকত। এই প্রদর্শনীর দু’একটি ছবিতে তার রেশ এখনও লক্ষ্য করা যায়। যেমন, সাদা-কালোর আলোছায়ার দ্বৈতে গড়া দণ্ডায়মান এক নগ্ন মানুষের উপস্থাপনা। তার শরীরের উপর অবস্থান করছে দু’টি পাখি। এই কল্পরূপাত্মক মায়াবী আবেশকে অধিকাংশ ছবিতেই তিনি কঠোর ভাবে ভেঙেছেন।
সমস্যা হচ্ছে প্রদর্শনীর সব ছবিই অনামা। কোনও সাধারণ শিরোনামও রাখেননি শিল্পী। ফলে কোনও নির্দিষ্ট ছবিকে আলাদা করে চিহ্নিত করা মুশকিল। স্মারকপত্রের ভূমিকার লেখার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘ট্রেসিং দ্য ইনভিজিবল পয়েন্টস অফ অরিজিন: আ মেডিডেটিভ সার্চ’। এ থেকে তাঁর ছবির মূল সন্ধানকে ঠিক শনাক্ত করা যায় না। তন্ময় সন্ধান আছে ঠিকই। কিন্তু সূচনার উৎস খুব অদৃশ্য নয়। শেখরের ছবির বিবর্তনের সঙ্গে পরিচিত দর্শক জানেন, সেই উৎস কী? ১৯৬০-এর দশকের শিল্পীরা যে প্রতিবাদী চেতনা উৎসারিত করেছিলেন, সেটাই আরও রূপান্তরিত হয়েছে, গভীর ও গহন হয়েছে আশির দশকের অনেক শিল্পীর সৃজন প্রক্রিয়ায়। শেখরের ছবিতে তারই নিদর্শন আমরা দেখি। |
|
একটি ছবিতে কোনও যুবকের মুখের পার্শ্বচিত্র। মুখের তীব্র অন্ধকারের ভিতর রক্ত-ব্যঞ্জিত লালের বিচ্ছুরণ। উপরে মস্তিষ্ক ছেদন করে বেরিয়ে এসেছে কিছু গিয়ার ও পিনিয়ন। পশ্চাৎপটের শুভ্রতা যেন অদৃশ্য কালিমালিপ্ত। যান্ত্রিকতাই যে আজকের মানবিক বিপর্যয়ের প্রধান এক উৎস, এই ছবির মতো অনেক ছবিতেই শিল্পী তার চিহ্ন রেখেছেন। কয়েকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে যুবক বা যুবতীর দোমড়ানো কঙ্কালসার শরীরের ভিতর থেকে প্রত্যঙ্গগুলি বাইরে বেরিয়ে এসেছে। মানবিকতার এই দুর্মর পরাজয় বারবার চিহ্নিত হয়েছে নানা ছবিতে। এই পরাজয়কে শিল্পী শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। বিস্তৃত করেছেন প্রকৃতির মধ্যেও। এ দিক থেকে মৃত হরিণের ছবিটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। নৃশংসতা ও কোমলতার সমন্বয়। মৃত হরিণের শরীরের অর্ধাংশ উপস্থাপিত হয়েছে চিত্রপটে। এখানেও শরীর জুড়ে তীব্র কালোর ভিতর কিছু কিছু রক্তাক্ত লালের বিচ্ছুরণ। অর্ধেক মুখ-খোলা পশুটির উন্মোচিত দন্তপঙক্তি ধ্বংসকে তীব্রতর করেছে। এই ধ্বংস পেরিয়ে শিল্পী অবশ্য দেখতে চেয়েছেন কিছু আশার আলোও। ডালের উপর বসে থাকে একটি পাখি। কিন্তু মুক্তি নেই তারও। উপর থেকে কাঁটাতার নেমে এসে স্পর্শ করেছে তাকে। কিশোরীর জামার উপর উড়ন্ত প্রজাপতিতে শৈশব-স্মৃতি। সেটুকুই ভরসা।
|
প্রদর্শনী চলছে
শ্রী আর্ট গ্যালারি: দেবাশিস, নিত্য প্রমুখ আজ শেষ।
গ্যালারি গোল্ড: সুমন, সমর প্রমুখ ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
অ্যাকাডেমি: সমীর কুণ্ডু ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
চারুচেতনা ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
ব্রততী মুখোপাধ্যায় ২৮ পর্যন্ত।
অভিনন্দন বড়ুয়া, সুশান্ত দত্ত প্রমুখ ৬ মার্চ পর্যন্ত।
আকৃতি: শেখর রায় ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
প্যালাডিয়ান লাউঞ্জ: ‘কালার রায়ট ২০১২’ ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
কেমোল্ড আর্ট: উত্তীয় সেন ১ মার্চ পর্যন্ত।
বোধি ট্রি (সুইস পার্ক): অত্রি সেন ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। |
|
|
|
|
|