তেমন বড় মাপের বাজেট নেই। তেমন বড় মাপের নায়ক-নায়িকাও নেই। বিদেশি লোকেশন নেই।
তবু দর্শক টানতে ‘গণ্ডগোল’ করেনি ‘গোড়ায় গণ্ডগোল’। নির্মাতাদের দাবি, ৮৩ লক্ষ টাকা বাজেটের ছবির প্রথম সপ্তাহে ৪২ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকার ব্যবসা। দ্বিতীয় সপ্তাহে সেটা বেড়ে ৫৭ লক্ষ ৩৯ হাজার। প্রযোজক কৌস্তুভ রায় এবং পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের জন্য হ্যাটট্রিক! কৌস্তুভ জানাচ্ছেন, ‘‘ছ-এ ছুটি’ খুব কম হল-এ মুক্তি পেয়েছিল। তা-ও টাকা উঠে গিয়েছিল। ‘বাই বাই ব্যাঙ্কক’ প্রথম সপ্তাহ পার করে ভিড় টানতে শুরু করে। কিন্তু ‘গোড়ায় গণ্ডগোল’ প্রথম সপ্তাহেই শনি-রবি হাউসফুল।”
নির্বাক বাংলা ছবির যে একটিমাত্র নমুনা দেখতে পাওয়া যায়, কালীপদ দাস পরিচালিত সেই ‘জামাইবাবু’ (১৯৩১) ছিল কমেডি। বাংলায় কমেডি ছবির ঐতিহ্য তাই বহু কালের। অনেক সময় পার্শ্বচরিত্রেরাই হয়ে উঠত মুখ্য। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ বা ‘বরযাত্রী’ যেমন। ‘চন্দ্রবিন্দু’ ব্যান্ড-এর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, “সাড়ে চুয়াত্তরে চরিত্রাভিনেতারাই ছবির প্রাণ। সবাই মিলে হইহল্লা করেই যেন ছবিটা বানানো! ওই জন্যই ওটা ‘কাল্ট’ ছবি!”
ইদানীং পরপর যে তিনটি কমেডি ছবি বাণিজ্যসফল হল, তার মধ্যেও নায়ক-নায়িকার প্রথাগত উপস্থিতি কম। |
বরং আছেন এক ঝাঁক চরিত্রাভিনেতা রজতাভ-রুদ্রনীল-কাঞ্চন-খরাজ-বিশ্বজিৎ-রাজেশ। সঙ্গতে শাশ্বত-বিশ্বনাথরা। বাংলা ছবির স্বর্ণযুগে তুলসী-ভানু-জহর-রবি-নৃপতি-নবদ্বীপ-জীবেন বসুরা যে সব অমোঘ মুহূর্ত উপহার দিতেন, সেই রাস্তাতেই কি হাঁটছে এখনকার ছবিও? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় কিন্তু তেমনটা মনে করছেন না। তাঁর মতে, “তুলসী-রবিরা তাঁদের বাচিক এবং শরীরী অভিনয়কে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তার তুলনীয় দৃষ্টান্ত এখনও নেই। এখনকার কমেডি তার চরিত্রেও সাবেকি কমেডির সঙ্গে এক নয়।” কেন? সঞ্জয়ের বক্তব্য, নব্বইয়ের দশক থেকে বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে উপচে পড়ল প্রাচুর্য। “এখনকার কমেডি মূলত সেই প্রাচুর্যের আমোদ।”
সঞ্জয়ের কথার সূত্র ধরে এগোলে ‘বাই বাই ব্যাঙ্কক’ বা ‘গোড়ায় গণ্ডগোল’ শুধু নিখাদ কমেডি নয়, বাংলা ছবির চলতি ঢেউয়েরই অংশ। প্রযোজক কৌস্তুভও সে কথাই বলছেন। “‘বেডরুম’-এর দর্শক আর ‘গোড়ায় গণ্ডগোল’-এর দর্শক একেবারে আলাদা এমন নয়।” তাঁর হিসেব বলছে, “কমেডির একটা বাজার আছে। সেই সঙ্গে বাংলা ছবির সামগ্রিক পরিবর্তিত বাজারও বড় ভূমিকা নিচ্ছে।”
পরিচালক হিসেবে অনিকেত কমেডির কোন মডেল ধরে এগিয়েছেন? “একটা জিনিস ঠিক করা ছিল যে, কোনও মতেই বলিউডি ধাঁচ নয়।” ‘নো এন্ট্রি’ বা ‘গোলমাল রিটানর্স’ নয়। কেন? “বাঙালি ছবিতে ‘মেসেজ’ খুঁজে না পেলে দুঃখ পায়।” বাংলায় কমেডি বলতে ‘আশিতে আসিও না’, ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’, ‘গল্প হলেও সত্যি’ বা ‘ধন্যি মেয়ে’-র মতো ছবিকেই মনে রাখতে চান অনিকেত। “তবে কমেডিতেও গুরু বলে মানলে সত্যজিৎ রায়কেই মানি।” তা হলে, নিজের ছবি জুড়ে স্ল্যাপস্টিক (মোটা দাগের হাস্যরস) কেন? “ব্যবসার কথা মাথায় রেখে ‘মাস অ্যাপিলে’র কথা ভাবতেই হয়। সেই জন্যই স্ল্যাপস্টিক।”
চার্লি চ্যাপলিন বা লরেল-হার্ডির কমেডিও কিন্তু স্ল্যাপস্টিকই! মনে করাচ্ছেন অনিন্দ্য। একই সঙ্গে তাঁর মতে, কমেডির অন্যান্য ধারা নিয়েও কাজ হওয়া দরকার। “হিন্দিতে যেমন ডেভিড ধবনের পাশাপাশি ‘খোসলা কা ঘোসলা’ বা ‘ওয়ে লাকি লাকি ওয়ে’ হচ্ছে, সেটা এখানেও হলে ভাল। তবে মৌলিক চিত্রনাট্যে ভর করে অনিকেত যে ছবি করছেন, তাকে সাধুবাদ জানাতেই হবে।” এই নতুন ধারার কমেডিতে সঞ্জয় আরও দু’টো তাৎপর্য খুঁজে পাচ্ছেন। “এক, দার্শনিকতার ভড়ং এখানে নেই। দুই, বাজার-অর্থনীতি যে উদ্বৃত্ত জনগোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছে, তথাকথিত ‘শহুরে’ ছবিতে তার দেখা মেলে না। বিস্কুটের সেলসম্যান বা সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক-করিয়েকে পর্দায় আনছে কমেডি-ই।”
কমেডি-ই। তার বিপদও তো কম নয়! অনিকেত মনে করাচ্ছিলেন, “সফদার হাশমির স্মরণ-মঞ্চে রবি ঘোষ উঠতেই লোকে হো হো করে হেসে উঠেছিল। ওঁর মুখটা খুব করুণ হয়ে গিয়েছিল তখন।” |