ফের চাপের মুখে মনমোহন সরকার। ফের প্রশ্নের মুখে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক। এবং গোটা ঘটনায় বাজেট অধিবেশনের আগে চূড়ান্ত অস্বস্তিতে কংগ্রেস।
জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র (এনসিটিসি) গঠন করে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে চাইছে, এই অভিযোগ তুলে এ বার ইউপিএ-সরকারের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করেছেন দেশের ছয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। এর নেতৃত্বে রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি আবার ইউপিএ জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক দলের প্রধানও বটে। এনসিটিসি নিয়ে আপত্তিতে মমতার সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন নীতীশ কুমার, নবীন পট্টনায়ক, জয়ললিতা, নরেন্দ্র মোদী এবং শিবরাজ সিংহ চৌহান। এঁরা প্রত্যেকেই প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র নিয়ে নিজেদের আপত্তি জানিয়েছেন। ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রীদের বক্তব্য, লোকপাল বিলের পরে এ বার এনসিটিসি গঠন করে কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাতের চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে আগে কেন রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।
বিদ্রোহী মুখ্যমন্ত্রীদের এই জোটে যোগ দিয়েছেন তেলুগু দেশম নেতা তথা অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডুও। উসকে দিয়েছেন নতুন ‘রাজনৈতিক জোট’-এর সম্ভাবনা। মমতা-জয়ললিতা-চন্দ্রবাবুর সঙ্গে ফোনে কথা বলে এই জোটে আপাতত যিনি ‘অনুঘটক’-এর কাজ করছেন, সেই নবীন পট্টনায়কের অবশ্য যুক্তি, তাঁরা শুধুই রাজ্যের অধিকার নিয়ে কথা বলছেন। তৃণমূলের পাশাপাশি ইউপিএ-র আর এক শরিক ডিএমকে-ও জানিয়েছে, তারাও রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে।
সব মিলিয়ে চূড়ান্ত অস্বস্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার। কংগ্রেসের শীর্ষনেতৃত্বও। গত ডিসেম্বরের শীতকালীন অধিবেশনের আতঙ্ক ফের হাজির তাঁদের সামনে। সে যাত্রায় খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার দিয়ে শুরু করে অধিবেশনের শেষ দিনে লোকপাল বিল পাশ করাতে না পারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনড় মনোভাবের সামনে মাথা নত করতে হয়েছিল মনমোহন-সরকারকে। এ বারে বাজেট অধিবেশন শুরুর ঠিক আগেই প্রকাশিত হবে উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফল। যাতে ভর করে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর আশা করছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। কিন্তু সরকারের প্রধান শরিক দলের নেতৃত্বে ছয় মুখ্যমন্ত্রীর বিদ্রোহ অনেক অঙ্কই বদলে দিতে পারেন বলে আশঙ্কা সরকার-পক্ষের।
এখনও অবশ্য নিজের অবস্থানেই অনড় মনমোহন-সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের যুক্তি, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার স্বার্থেই এনসিটিসি তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে রাজ্যগুলির সঙ্গে আগাম আলোচনা করার কোনও প্রয়োজন ছিল না। কারণ বর্তমানে চালু ইউএপিএ-আইনের আওতাতেই এনসিটিসি-কে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্রসচিব রাজকুমার সিংহ এ দিন বলেন, “এ নিয়ে কোনও বিতর্ক হওয়া উচিত নয়।” সরকারি সূত্রের বক্তব্য, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত করার কোনও উদ্দেশ্য ইউপিএ-সরকারের নেই। একই ভাবে এনসিটিসি-র পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে আসারও কোনও প্রশ্ন নেই। সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী, ১ মার্চ থেকেই কাজ শুরু করবে এনসিটিসি। আজও সংস্থার প্রধান-পদের জন্য দুই অফিসারের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছে। কংগ্রেস মুখপাত্র রেণুকা চৌধুরী বলেন, “সরকার যে কোনও বিষয়ে খোলা মনে আলোচনায় তৈরি। কিন্তু দেশের নিরাপত্তা নিয়েও সমঝোতা করা উচিত নয়।”
এনসিটিসি নিয়ে আপত্তির কথা জানিয়ে দিন তিনেক আগেই কেন্দ্রকে চিঠি দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুক্তি, ইউএপিএ-আইনের ৪৩এ ধারায় কোনও সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা বা তল্লাশি চালানোর অধিকার রয়েছে এই কেন্দ্রের। এর জন্য রাজ্যের অনুমতির প্রয়োজন নেই। মমতার সুরে সুর মিলিয়েই ওড়িশা, বিহার, তামিলনাড়ু, গুজরাত ও মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীদের যুক্তি, আইন-শৃঙ্খলা যেখানে রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়, সেখানে রাজ্যের অনুমতি ছাড়াই নাক গলাতে চাইছে কেন্দ্র। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এটা মেনে নেওয়া যায় না। তৃণমূল নেতা সুলতান আহমেদ বলেন, “কেন্দ্র কী করতে চাইছে, তা জানার অধিকার রাজ্য সরকারের রয়েছে।” মমতার আপত্তির কথা জেনেই রাজ্যের মুখ্যসচিবের সঙ্গে কথা বলেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব। নর্থ ব্লক সূত্রে খবর, অন্য রাজ্যের মুখ্যসচিবদের সঙ্গেও কথা বলবেন তিনি। আজ রাজকুমার বলেন, “সন্ত্রাস দমনে বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার মধ্যে আরও ভাল সমন্বয়ের জন্যই এনসিটিসি তৈরি হয়েছে। নতুন কোনও আইন তৈরি হয়নি। যে ইউএপিএ নিয়ে আপত্তি উঠছে, সেটি ছয়-সাত বছর ধরে রয়েছে।”
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে বিতর্ক ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হলেও সরকারকে বেকায়দায় পেয়ে তার ফায়দা তুলতে মাঠে নেমেছে বিজেপি। বিরোধী দলনেত্রী সুষমা স্বরাজের অভিযোগ, “শুধু এ ব্যাপারে নয়, অনেক ক্ষেত্রেই এই সরকার যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বিশ্বাস করে না।” সুষমার মতে, কেন্দ্রের উচিত ছিল রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া। কংগ্রেসের একাংশেরও মত, সরকারি স্তরে শরিকদের সঙ্গে সব বিষয়ে আগাম আলোচনা করে নেওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত। শরিকদের সঙ্গে সহমতের ভিত্তিতে না এগোনোর জন্যই তিস্তা চুক্তি থেকে খুচরো ব্যবসা বারবার হোঁচট খেতে
হয়েছে কেন্দ্রকে।
কংগ্রেসের আরেকটি অংশের যুক্তি, আলোচনা হলেও মমতা আপত্তি তুলতেন। নবীন পট্টনায়ক, জয়ললিতারা এখন কোনও জোটে নেই। তাঁরা জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এনডিএ-তে থাকলেও নীতীশ কুমারেরও বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী-পদপ্রার্থী করলে তাঁকে এনডিএ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই এগোচ্ছেন সকলে।
কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের কথা বলে মমতা যাঁদের সঙ্গে ‘জোট’ গড়েছেন, তাঁরা সকলেই এক সময় বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ-তে ছিলেন। আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ‘দ্বিচারিতা’-র অভিযোগ তুলে সরব হওয়ার পাশাপাশি এই বিষয়টিও মাথায় রাখছেন সিপিএম নেতৃত্ব। তাঁদের বক্তব্য, মমতা এক দিকে কেন্দ্রে সরকারকে সমর্থন করছেন, আবার অন্য দলগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিরোধিতাও করছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতার দায় নিতেই মমতা এমন রাজনৈতিক অবস্থান নিচ্ছেন। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘মন্ত্রিসভায় ওঁর দলের সংসদরা আছেন। তাঁদের বাদ দিয়ে তো কোনও সিদ্ধান্ত হতে পারে না। সব ব্যাপারেই মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের পরে উনি বলেন, আমি জানি না! আমার আপত্তি আছে। তা হলে মন্ত্রিসভায় ওঁর দলের মন্ত্রীরা কী করেন?” এনসিটিসি প্রসঙ্গে সিপিএমের নীতি কী? সেলিম বলেন, “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে কঠোর অবস্থানের পক্ষে আমরা।” |