তথ্যভাণ্ডারে আলো পড়ছে
পুর-উদ্যোগ
লকাতা বইমেলায় কলকাতা কোথায়? দশ দিনের মেলায় ভিড়ের মুখটা কলকাতারই মুখ, যে শহরে বইয়ের জন্য উদ্বেল হয় মানুষ। বইমেলার খাবারের বিপণিগুলিও কলকাতারই মুখ নিশ্চয়, যে মুখের অনেকটাই নাগরিক সচেতনতার অভাবের চিহ্ন। আর তারই সঙ্গে স্টল থেকে স্টলে খুঁজেপেতে মিলে যাবেই পুরনো কলকাতা আর নতুন কলকাতার গালগল্প কিংবা রীতিমতো গবেষণায় ভারী বই। কিন্তু পুরশ্রী বিবর্ধন করাই যার কাজ, সেই সংস্থাটি, কলকাতা পৌরসংস্থা, ডাকনামে কর্পোরেশন বইমেলায় সাধারণত তথ্য নিয়েই হাজির হত এত কাল। তথ্য মানে, নানা রকম করের ফর্ম, কিংবা ই-ফিলিং এই সব কেজো জিনিস। জনসংযোগের বড় মঞ্চ এই বইমেলা, সুতরাং কাজের কথা বলার এমন বিকল্প আর নেই, বলাই বাহুল্য। কিন্তু এর বাইরেও কলকাতা পৌরসংস্থার আর একটি কাজ রয়েছে, কলকাতার ইতিহাসকে ধরে রাখার কাজ। সে কাজটাও, তথ্যের খাতিরেই, বড় ছোট কাজ নয়। আশার কথা, পুরসভার সেই কলকাতা-ইতিহাসের সমৃদ্ধ ভাঁড়ারে আলো পড়েছে। নতুন করে তৈরি হচ্ছে আর্কাইভটি।
ডিজিটাইজেশন হচ্ছে অধিকাংশ পুরনো নথি, পত্র-পত্রিকার। তারই পাশাপাশি, পুরনো মিউনিসিপ্যাল গেজেট ঘেঁটে চলছে বিষয়ানুসারী সংকলনের কাজ। তারই দু-একটি হাজির বইমেলায়। প্রকাশিত হয়েছে প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং রবীন্দ্রনাথের ছবির দুটি সংকলন। ছবিগুলি সবই প্রকাশিত হয়েছিল গেজেটের নানা সংখ্যায়। বইমেলায় পুরসভার স্টলে চলছে গেজেটে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের লেখা, চিঠি ও ছবি নিয়ে একটি প্রদর্শনীও। প্রদর্শনীর পরিকল্পনা তথ্য ও জনসংযোগ বিভাগের কর্মী অরুণকুমার রায়ের। তিনিই জানালেন, আজ, সোমবার প্রকাশিত হবে রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর এচিংয়ে কলকাতার ছবির একটি অ্যালবাম। নিজের দেখা কলকাতাকে এচিং আর স্কেচে ধরে রেখেছিলেন শিল্পী রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। ছবিগুলি প্রকাশিত হয়েছিল মিউনিসিপ্যাল গেজেটেই। সঙ্গে তারই একটি, দিকেবিদিকে ছুটতে থাকা কলকাতার নয়, নড়িতে নড়িতে চলা কলকাতার একটি মন্থর মুহূর্ত।

গোড়ার কথা
‘... ছেলেকে কোলকাতায় রেখে পড়ানোর সঙ্গতি আমাদের ছিল না। আমি তা ভালোভাবেই জানতাম। তাই সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ার কথা ভেবে রেখেছিলাম।’ কিন্তু বন্ধুর কান্নাকাটিতে মত পালটাতে হল। বন্ধুর নাম সুবীর। সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পরে সুবীরের কলকাতায় আশুতোষ কলেজে পড়া ঠিক হয়ে গেল। ‘কাজেই বন্ধুবিচ্ছেদ আসন্ন। সুবীর কান্নাকাটি করে এমন মহা হাঙ্গামা বাধিয়ে দিল যে আমি সিদ্ধান্ত পালটে কোলকাতায় পড়তে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম।’ এই গল্প যিনি শুনিয়েছেন, তাঁর নাম অসীম চট্টোপাধ্যায়। ‘কাকা’ যদি সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজের পড়ুয়া হতেন, তবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রেসিডেন্সি কলেজের ভূমিকা কিছুটা অন্য রকম হত বোধহয়। মগমা (তখন বিহার, এখন ঝাড়খণ্ড) থেকে বীরভূমের পাঁচরা, পরে সিউড়ি হয়ে কলকাতার কলেজে এসে পৌঁছেছিলেন অসীমবাবু। সেই প্রাক্-প্রেসিডেন্সি জীবনের ঝাঁকিদর্শন তাঁর সদ্য প্রকাশিত ছোট্ট বই হাতেখড়ি (তালপাতা, ১০০.০০)। এক নিশ্বাসে শেষ করার পর একটু খেদ রয়ে যায় বড় বেশি সংক্ষিপ্ত।

সামগ্রিক
‘মনে পড়ছে বুভুক্ষু বৃদ্ধ ডোমের কথা, যার নাম লিখে নিয়েছি নোটবুকে। মনে পড়ছে পুলিশের লাঠি খাওয়া ৮০ বছরের বৃদ্ধ মুসলমানকে। সে কাঁদতে কাঁদতে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে হঠাৎ জিগ্যেস করেছিল ফিস ফিস করে শাস্তি হবে তো ওদের?’ ননী ভৌমিকের অগ্রন্থিত রিপোর্টাজ: ‘গ্রাম থেকে গ্রামান্তর’। রিপোর্টাজের মতো তাঁর অগ্রন্থিত কিছু ছোটগল্প, ব্যঙ্গরচনা, আলোচনা সাহিত্য পড়া গেল কথারূপ-এর (সম্পা: গৌতম অধিকারী, যুগ্ম সম্পা: তপন বাগচী) ‘ননী ভৌমিক সংখ্যা-দুই’-এ। তাঁকে তো সাধারণত ‘ধুলোমাটি’, ‘ধানকানা’-র লেখক আর রুশ সাহিত্যের অনুবাদক হিসেবেই চেনে বাঙালি, তাই পত্রিকাটি পর পর দু’টি সংখ্যায় তাঁর সমগ্রের পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তাঁর সৃষ্টিকর্মের নানা দিক নিয়ে যেমন আলোচনা রয়েছে, তেমনই আছে তাঁকে নিয়ে স্মৃতি-নিবন্ধ। অগ্রন্থিত রচনাপঞ্জির সঙ্গেই রয়েছে তাঁর গ্রন্থিত ভ্রমণকাহিনি ‘মরু ও মঞ্জরী’। সংগ্রহযোগ্য সংখ্যা।

শতবর্ষে
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্ম ১৯১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর। শতবর্ষে তাঁকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে সংবর্তক পত্রিকা। ছ’টি পর্ব আছে এই সংখ্যায়: আলোচনা রচনা স্মৃতিকথা, কবিতা, প্রবন্ধ নিবন্ধ, ফিরে পড়া, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কবিতা-গান এবং তাঁর প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার। পরিশিষ্টে তাঁর কিছু চিঠিপত্র, আর গ্রন্থ এবং জীবনের পঞ্জি। আমৃত্যু বামপন্থী মানুষটিকে পশ্চিমবঙ্গের শাসক বামপন্থীরা এক সময় দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন, কারণ তিনি সর্ব বিষয়ে শাসকদের প্রতিধ্বনি করতে পারেননি। ১৯৮৭ সালে, মৃত্যুর কয়েক মাস আগে এক সাক্ষাৎকারের একটি অংশ স্মরণীয়। বলেছিলেন তিনি, ‘সরকার আমাকে প্রোগ্রাম দেয় না।’ ‘কেন?’ ‘আমি কারো দালালি করি না তাই।’

নানা পরিচয়
সংকলনের শুরুতেই কালো চকপেন্সিলে ঈশা মহম্মদের আঁকা বিবেকানন্দ। স্বামী বিবেকানন্দ অসম্ভব প্রতিভাবান এই ক্ষণজন্মা মানুষটির বহুমুখী পরিচয় নিয়ে কোরক সংকলন: নানা বিবেকানন্দ (সম্পা: তাপস ভৌমিক, ১২৫.০০)। কয়েক বছর আগে কোরক-ই বিবেকানন্দ-কে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা বের করেছিল, এ বারে তাঁর সার্ধশতজন্মবর্ষে সে সংখ্যাটিই পরিমার্জন ও সংযোজনে নতুন বই হল। হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্যকীর্তনীয়া, স্বাধীনতা-যুদ্ধে বিপ্লবী মন্ত্রণাগুরু, সংগঠক, বাগ্মী, লেখক, সংগীতশিল্পী, রন্ধনশিল্পী, শ্রেণিহীন সর্বমানবিক সমাজতন্ত্রের সাধক এমন নানা পরিচয়ের নিরিখে বিবেকানন্দের মূল্যায়ন এটিতে। সম্পাদকের কথায়, ‘আমরা চাই এক বিবেকানন্দের ভিতরে নানা বিবেকানন্দের যে স্বরূপ সঞ্চিত ছিলো, তা যথাযথ-ভাবে উন্মোচিত হোক।’ বিশিষ্ট শিল্পীদের রেখায় বিবেকানন্দ ও সমসাময়িক ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতি সংকলনটিকে ঋদ্ধ করেছে আরও।

প্রকাশনা-শিক্ষা
কাঁচা রসদ পাণ্ডুলিপিকে কেটে ছেঁটে, সাজিয়ে গুছিয়ে তবে বই। দক্ষতার সঙ্গে কাজটি করতে জানতে হয় অনেক কিছু। বিষয়সূচি ও গ্রন্থপঞ্জি তৈরি, ফুটনোট ও এন্ডনোট-এর তফাত, পাতার সর্বাধিক অংশের ব্যবহার, প্রুফ রিডিং, বাইন্ডিং, পাতা কমলেও সমগ্র বিষয়টিকে উপস্থাপন করা ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রাক্-প্রকাশনার এ হেন যাবতীয় বিষয় শেখাতে ‘সিগাল ফাউন্ডেশন ফর আর্টস’ আনল ‘দ্য সিগাল স্কুল অব পাবলিশিং’। সহযোগিতায় নরওয়ে দূতাবাস। থাকছে দু’টি কোর্স সম্পাদনা ও আর্ট ডিজাইনিং। সংস্থার সম্পাদক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, ‘দেশ-বিদেশের প্রকাশনা জগতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিত্বরা শেখাবেন হাতে-কলমে। থাকবে ওয়ার্কশপের আয়োজন।’ ‘টাইপোগ্রাফি ও রঙের ব্যবহারে বইকে সার্বিক সুন্দর করার পদ্ধতিই শেখানো হবে আর্ট ডিজাইনিং-এ’ বললেন সংস্থার আর্ট-ডিজাইনার সুনন্দিনী বন্দ্যোপাধ্যায়। চার মাসের কোর্সটি শুরু হচ্ছে এপ্রিলে।

বাঁদর-বৃত্তান্ত
ধর্মীয়, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক ভাবেই হনুমান বা বাঁদর আমাদের খুব কাছের প্রাণী। তা ছাড়া জীববিজ্ঞানের বিচারে স্তন্যপায়ীদের সর্বোচ্চ বর্গে বাঁদরের সঙ্গে মানুষও শামিল। সেই গুরুত্ব কি কোনও দিন পেয়েছে বাঁদরেরা? এক দিকে অরণ্য উজাড় করে তাদের আবাস আর খাদ্যের প্রাকৃতিক উৎস ধ্বংস করেছি, অন্য দিকে পুজো করছি অন্ধ ভক্তিতে। এদের নিয়ে প্রাণীবিজ্ঞানী সঙ্গীতা মিত্র পনেরো বছরের অন্বেষণ আর গবেষণার পরে তৈরি করেছেন একটি অনবদ্য বই: আ পিকটোরিয়াল গাইড টু নন-হিউম্যান প্রাইমেটস অব ইন্ডিয়া। এ বইয়ে যেমন আছে দেশের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁদরের সচিত্র বিবরণ, তেমনই রয়েছে তাদের শ্রেণিবিন্যাস, বাসস্থান, প্রজনন, বেড়ে ওঠা, খাদ্যাভ্যাস এমনকী সমাজ নিয়েও প্রচুর তথ্য। ‘নেচারিজম’ প্রকাশিত এ বইয়ের বড় সম্পদ ছবি, যার সবই তুলেছেন কৌশিক।

দায়বদ্ধ
চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে নিলেও, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার নিরিখে ওঁরা কলকাতার অনুন্নত এলাকায়, রেললাইনের ধারে বস্তিতে, ফুটপাথে বিনে পয়সায় চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেন। কলকাতার চৌহদ্দিতে বন্দি না থেকে ওঁরা ছড়িয়ে পড়েছেন দক্ষিণ শহরতলির পাগলাহাট-ঘটকপুকুর এবং সুন্দরবনের সন্দেশখালির আগারহাটি গ্রামেও। সারা বছর ধরেই ঘুরিয়েফিরিয়ে ওঁরা অর্থাৎ ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন ছাত্রেরা পৌঁছে যান ওই এলাকায়। শুধু চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়াই নয়, বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার অভিযানও সারা বছর ধরে চালান ওই প্রাক্তনীরা। সেই পরিষেবা কী ভাবে আরও বেশি এলাকায় পৌঁছে দেওয়া যায় সেই লক্ষ্য সামনে রেখে ৩-৫ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন ছাত্রেরা ৬১ তম পুনর্মিলন উৎসবে মিলিত হবেন বলে জানিয়েছেন প্রাক্তনী শান্তনু ভক্ত। শান্তনুবাবু এ বছরের পুনর্মিলন উৎসবের সম্পাদক।

লোকজ শিল্প
আলপনা, কালীঘাটের পট, বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাস, চড়িদার ছো মুখোশ, বীরভূমের সেরপাই, বলাগড়ের নৌকো বাংলার নানা লোকজ শিল্প এ বার দুই মলাটে। বরুণকুমার চক্রবর্তী সম্পাদিত লোকজ শিল্প (পারুল, ৬৯৫.০০) বইয়ে লোকশিল্প নিয়ে তরুণ গবেষকদের পঞ্চাশটি প্রবন্ধ আছে। লেখাগুলিকে সাজানো হয়েছে সাতটি উপবিভাগে লোক চিত্রকলা, ধাতু নির্মিত লোকশিল্প, বাঁশ-বেত-পাটশিল্প, মাটি ও কাঠের লোকশিল্প, বয়নশিল্প, বৈচিত্রময় লোকশিল্প এবং তাত্ত্বিক ভাবনা। প্রচ্ছদটিও নিরাভরণ, দীপ্তিময়।

দুই বাংলায়
‘আমি পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ করে দেখলাম... এখানকার উর্বরা মাটির মতোই এখানকার মানুষের উদ্যম আগ্রহও প্রবল।’ ১৯২৬-এ কুমিল্লা-চাঁদপুর থেকে কলকাতায় ফেরার পথে নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুলের সংবর্ধনায় বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অরুণ সেন তাঁর ‘বাংলাদেশ-এ রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রচর্চা’ প্রবন্ধে এ-তথ্য ব্যবহারের সূত্রেই যেন আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চার উদ্যোগ। পাশাপাশি আবার অন্য প্রবন্ধে পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রোত্তর সাহিত্যসংস্কৃতি কোন পথে এগোচ্ছে তার হদিশ। এই রাবীন্দ্রিক আধুনিকতা কী ভাবে রূপ পাচ্ছে তা নিয়ে তো বটেই, সঙ্গে ‘মুসলমান বাঙালির কণ্ঠস্বর’, ‘বাংলার বাইরে বাংলা’র মতো প্রবন্ধাদি নিয়েও সোনার বাংলা প্রকাশন থেকে বেরল দুই বাংলায় রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য (২৫০.০০)।

নাটকের রবি

মাইক্রোফোনের সামনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বেতারে ‘রক্তকরবী’ অভিনয় করছেন শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র। এমন একটি দুর্লভ ছবি বহুরূপী-র (সম্পা: প্রভাতকুমার দাস) সার্ধশতবর্ষ রবীন্দ্রজন্ম বিশেষ সংখ্যা ২-এ। সম্পাদকীয়তে জানানো হয়েছে: ‘বহুরূপী নাট্যদলের এই মুখপত্র বাংলার নাট্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকাকে অনুসরণের যে কথা বারবার নাট্যকর্মীদের মনে করিয়ে দিতে চেয়েছে...।’ ফলত রবীন্দ্রনাট্যবিশেষজ্ঞরা যেমন লিখেছেন এ-সংখ্যায়, তেমনই লিখেছেন রবীন্দ্রনাট্যের মঞ্চপ্রয়োগকারীরাও, বিভাস চক্রবর্তী থেকে উষা গঙ্গোপাধ্যায় থেকে সুমন মুখোপাধ্যায় অবধি। পাশাপাশি শূদ্রক-এ রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে মননশীল নিবন্ধাদি। দুটি চমৎকার রচনা, আলপনা রায়ের ‘মায়ার খেলা: ইমোশনাল থেকে ইস্থেটিক্’, রুশতী সেনের ‘এলোমেলো পাঠে রবীন্দ্রনাথ’। সঙ্গে বিশিষ্ট নাটককাররা রবীন্দ্রসৃষ্টিকে ভিত্তি করে লিখেছেন নিজস্ব নাটক।

অগ্রন্থিত
‘কবিতা লেখার সময় সমসাময়িকদের থেকে বরং আমার চেতনাবচেতনে থাকে পূর্বসূরিসচেতনতা। মাথায় রাখার চেষ্টা করি যা লিখছি যেমন করে লিখছি তা আগে লেখা হয়ে যায়নি তো।’ তুষার চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে। প্রয়াত কবির এ রকম আরও সাক্ষাৎকার, অপ্রকাশিত ডায়েরি, নির্বাচিত রচনা, বইয়ের পরিচিতি, জীবনপঞ্জি নিয়ে বেরিয়েছে দেবভাষা-র (সম্পা: দেবজ্যোতি মুখোপাধ্যায় সৌরভ দে সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়) ‘তুষার চৌধুরী সংখ্যা’। কবিকে নিয়ে লিখেছেন পবিত্র মুখোপাধ্যায় অমিতাভ গুপ্ত পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল জয় গোস্বামী মৃদুল দাশগুপ্ত সৈয়দ কওসর জামাল রবিশংকর বল প্রমুখ। একই সঙ্গে দেবভাষা বার করেছে তুষার চৌধুরীর অগ্রন্থিত কবিতা (৮০.০০), কৃষ্ণেন্দু চাকী-কৃত তার মুখচ্ছবিটিও চমৎকার!

দামাল
জ্যাকব শুঁড় বুলাচ্ছে আমার বৃদ্ধ বাহনের গায়ে। তেলের পাইপ বেয়ে টুপটাপ পেট্রল ঝরছে মাটিতে।... ছোটন বলে “সত্যিই গেল। কপিধ্বজের শেষকৃত্য, তোমাকে আর গয়ায় গিয়ে পিণ্ডদান করতে হবে না। জ্যাকব সিধে এক বাইপাস ঝাড়বে, তোমার বাহন তলিয়ে যাবে খাদে।” হাতি নিয়ে অর্ক চৌধুরীর রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা, পড়তে-পড়তে ঘুম বন্ধ হয়ে যেতে পারে পাঠকের। শুধু এই দামাল হস্তীকুলের সঙ্গে উনিশ বছর ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতাই নয়, দলমা পাহাড়, তার সংলগ্ন ছোটনাগপুরের মালভূমি, সিমলিপাল-সারান্ডার অরণ্যভূমির প্রাণ ও প্রকৃতি নিয়ে নিবিষ্ট অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ অর্কর কলমে। মানচিত্র-সহ তাঁর এই লেখালেখি নিয়ে সহজপাঠ থেকে বেরল দলমার দামাল (২০০.০০)। অর্কর গদ্যও দলমার দামালদের মতোই দুর্দান্ত।

নোলেদা
ফেলুদা-ঘনাদা-টেনিদা অধ্যুষিত বাংলায় নোলেদা-কে মনে পড়ে কি? সেই নোলেদা, যার মাথায় ইকড়িবিকড়ি চুল, খাড়াই নাক, মুখটা ফজলি আমের মতো লম্বাটে। বেকেনবাওয়ারের ছদ্মবেশে তিনি এক বার বিশ্বকাপ জিতে এসেছিলেন। পেলে তাঁর খেলা দেখে স্যালুট ঠুকেছিলেন। পেলে এ শহরে এসেছিলেন ১৯৭৭-এ। নোলেদা, পরের বছরই। সৌজন্য ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকা। এই অসামান্য কমিক স্ট্রিপটির স্রষ্টা অহিভূষণ মালিক। যিনি মাঝে মাঝে ঘনাদা এঁকেছেন, একটানা এঁকে গিয়েছেন রূপদর্শীর ব্রজদা। তাঁরই জাম্বো সৃষ্টি নোলেদা এ বার গ্রন্থাকারে (লালমাটি), রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের দুটি অনবদ্য ভূমিকা-সমেত।

টেরাকোটা
পোড়ামাটির শরীরে ধরা থাকে সভ্যতার পদচিহ্ন। গবেষকদের কাছে যা অমূল্য উপাদান। হরপ্পা মহেঞ্জোদড়ো থেকে চন্দ্রকেতুগড় কোশাম্বি বালুচিস্তান তক্ষশীলা নালন্দা বা পাহাড়পুরের এমন অনেক উপাদান জমা রয়েছে ভারতীয় জাদুঘরে। রয়েছে পুতি, সিল, ইট, বিভিন্ন মূর্তি এমনকী উনিশ শতকের সতীদাহের একটি ফলকও। জাদুঘরের ১৯৮তম বার্ষিকীতে পোড়ামাটির সংগ্রহ থেকে বাছাই করা দ্রষ্টব্য নিয়ে আয়োজিত হয়েছে বিশেষ প্রদর্শনী ‘এনশেন্ট ইন্ডিয়ান টেরাকোটা’। সঙ্গে আন্তর্জাতিক সেমিনার, কর্মশিবির এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বৃহস্পতিবার সকাল ১১ টায় আশুতোষ শতবার্ষিকী হলে এর উদ্বোধন করবেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। চলবে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত (১১-৪.৩০)। সোমবার বন্ধ। প্রধান অতিথি অধ্যাপক সব্যসাচী ভট্টাচার্য। ডেকান কলেজের অধ্যাপক কে কে পাধাইয়া নাথানিয়েল ওয়ালিচ স্মারক বক্তৃতায় ‘কালচারাল হেরিটেজ ইন ইন্ডিয়া: ইট্স প্রিজারভেশন অ্যান্ড রেলিভেন্স’ শীর্ষকে বলবেন। ছবি প্রদর্শনী থেকে।

দশাবতার
প্রথমে সব তাস মিশিয়ে ফেলা হয়। তার পরে কয়েকখানা তাস নিয়ে প্রত্যেককে একটি করে বিলি করা হয়। যিনি সব চেয়ে বড় মানের তাস পান তিনি চাল দেন। অর্থাৎ মোট তাসগুলো কেটে দেন এবং তিনিই খেলা শুরুর আদেশ দেন। তাঁর বাঁ-দিকের খেলোয়াড় এক গণ্ডা করে তাস বিলি করতে থাকেন। বিভিন্ন সময়ে এই ভাবে প্রত্যেকে চব্বিশটি করে তাস হাতে পায়। বিচিত্র এই খেলার নাম দশাবতার তাস। গোল তাসের গায়ে দশ অবতারের বা তাদের অস্ত্রের ছবি। বিষ্ণুপুরে মল্লরাজাদের সময়ে বহুল প্রচলন ছিল এ খেলার। হারানো সেই দশাবতার তাসের স্মৃতি আর সত্তা নিয়েই এই বইমেলায় প্রতিক্ষণ সূচনা করল একটি গ্রন্থমালার। যার উদ্দেশ্য, ভারতের বিভিন্ন লোকশিল্প নিয়ে আলাদা আলাদা ‘হ্যান্ডবুক’ তৈরি করা। অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সুধাংশুকুমার রায় এবং বিনয় ঘোষের তিনটি লেখা, বিদ্যুৎ ফৌজদারের আঁকা তাসের ছবি নিয়ে দশাবতার তাস সম্পাদনা করেছেন শর্মিষ্ঠা দত্ত।

বিয়াল্লিশের বাংলা
নৃতাত্ত্বিক, সমাজবিজ্ঞানী, গাঁধীবাদী নির্মলকুমার বসুকে কোনও একক অভিধায় চিহ্নিত করা অসম্ভব। ১৯৪২-এর অগস্ট আন্দোলনে গ্রেফতার হয়ে তাঁকে দমদম সেন্ট্রাল জেলে থাকতে হয়েছিল। এই পর্বে সহবন্দিদের কাছ থেকে তিনি বিপুল তথ্য সংগ্রহ করেন। প্রথমে ‘দর্শক’ পত্রিকায়, পরে গ্রন্থাকারে এই তথ্যই বিয়াল্লিশের বাংলা নামে সংকলিত হয়। নিছক নীরস তথ্যপঞ্জি নয়, বঙ্গজীবনের এক দ্রুত পরিবর্তনশীল সময়ের আশ্চর্য দলিল এই গ্রন্থ বহু দিন পর নতুন ভাবে প্রকাশ পেল মৃত্তিকা ও কারিগর-এর যৌথ উদ্যোগে (বিয়াল্লিশের বাংলা, ৪০০.০০)। মূল পাণ্ডুলিপি মিলিয়ে সংশোধন ছাড়াও সঙ্গে আছে নির্মলকুমারের ‘আধুনিক বঙ্গদেশ’ ও ‘জেলের ডায়েরি’, আর ফিরে পড়ার অভিজ্ঞতা লিখেছেন গৌতম ভদ্র।

তিন শিল্পী
শিল্পীদের ছবির পোর্টফোলিয়ো অনেক হয়েছে, কিন্তু বিষয় ধরে তিন শিল্পীর প্রিন্টের সংকলন? না অন্তত বাঙালি প্রকাশনায় বিশেষ দেখা যায়নি। রবীন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথের প্রত্যেকের ৪টি করে ছবি নিয়ে মোট ১২টি ছবির একটি সুমুদ্রিত পোর্টফোলিয়ো প্রকাশ করল প্রতিক্ষণ। বিষয় ‘নিসর্গ’। পাশাপাশি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে আজ শুরু হচ্ছে গগনেন্দ্রনাথের মূল ছবির এক প্রদর্শনী, চলবে ১৯ মার্চ পর্যন্ত। আর ৩১ জানুয়ারি ৪টেয় আশুতোষ জন্মশতবার্ষিকী প্রেক্ষাগৃহে অবনীন্দ্রনাথের দৌহিত্রীপুত্র দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলবেন ‘দি অল্টারনেট নেশন অব অবনীন্দ্রনাথ’ শীর্ষকে।

পরিচালক
চা পর্যন্ত খান না, ভোরে উঠেই শরীরচর্চা। রীতিমতো ফুটবল! বলের পিছনে ধাবমান শরীরটিকে দেখলে তখন বিশ্বাস করা শক্ত, এই ভদ্রলোকই খানিক পরে ক্যামেরার সামনে গম্ভীর সব চরিত্র, আর সন্ধেবেলা মঞ্চের আলোছায়ায় তিনি সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ। দেবেশ রায়চৌধুরী এ রকমই। এতদিন তাঁর মুখ্য পরিচয়টি ছিল বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠীর সুখ্যাত চরিত্রাভিনেতা। আজও তিনি সেই ভূমিকাতেই, নিশ্চিত, কিন্তু সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও একটি অভিজ্ঞান। পরিচালক। বহুরূপীর সাম্প্রতিক প্রযোজনা ‘নানা ফুলের মালা’-র পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তারাপদ মুখোপাধ্যায়। তাঁর সহসা প্রয়াণের পরে প্রযোজনাটিকে দিশা দেখানোর দায়িত্ব তুলে নিলেন দেবেশ। ‘কিছুদিন আগেই পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমিতে ‘কালের যাত্রা’ করালাম, কিন্তু বহুরূপীতে প্রযোজনার নির্দেশনা... এই প্রথম’, জানালেন স্বভাবলাজুক দেবেশ। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। ‘সেখানে দেখেছি, দেবনারায়ণ গুপ্তের মতো মানুষ, আবার বহুরূপীতে কুমার রায়ের মতো কিংবদন্তির সান্নিধ্য! একটু একটু করে শিখেই চলেছি। তাই, আচমকা খুব দুর্ভাগ্যজনক ভাবে যখন দায়িত্বটা এল, এগিয়ে এলাম। তারপরে, মজাই লাগছে!’ হেসে ফেললেন দেবেশ রায়চৌধুরী। তাঁর নির্ভুল স্বাক্ষরের মতো হাসি।

অন্য দেখা
সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবির সেই দৃশ্যটা মনে আছে? সেই যেখানে একমাত্র পুত্রের আত্মহত্যা, স্ত্রীর মৃত্যুজাত নিঃসঙ্গতা বুকে নিয়ে বর্ষীয়ান ত্রিপাঠীর ভূমিকায় একা পাহাড়ী সান্যাল গাইছেন অতুলপ্রসাদী সে ডাকে আমারে— প্রভাতে যারে দেখিবে বলি দ্বার খোলে কুসুমকলি কুঞ্জে ফুকারে অলি/ যাহারে বারে বারে সে ডাকে আমারে! কিন্তু এই পাহাড়ী সান্যাল সাধারণ্যে খুব পরিচিত নন। অভিনয়ের পাশাপাশি গায়ক পাহাড়ী সান্যালকে সে ভাবে মনে রাখিনি আমরা। অথচ গানের ভুবনে পাহাড়ী সান্যাল আজও এক স্মরণীয় নাম। বিশেষ করে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও অতুলপ্রসাদ সেনের গানে। অতুলপ্রসাদের গান জনপ্রিয় করার নেপথ্যে তাঁর অবদান যথেষ্ট। লখনউ প্রবাসী অতুলপ্রসাদকে খুব কাছ থেকে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে দেখেছেন পাহাড়ী সান্যাল। এ কথা স্মরণীয়, লখনউ প্রবাসে অতুলপ্রসাদের গানে ঠুমরি বা খেয়াল ভেঙে গান রচনার প্রবণতা বেড়েছিল। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র গানটিও ভৈরবী রাগাশ্রিত হিন্দি কম্পোজিশন ‘ভবানী দয়ানী’র আদলে রচিত। এবং এই লখনউ-প্রবাসেই অতুলপ্রসাদ একা, চূড়ান্ত নিঃসঙ্গ। সেই দেখাকে ভিত্তি করেই লিখেছিলেন দীর্ঘ এক ধারাবাহিক, ‘মানুষ অতুলপ্রসাদ’, সত্তরের দশকের ‘দেশ’ পত্রিকায়। লেখাটি অসমাপ্তই থাকে। দীর্ঘ চার দশক পরে পত্রিকার পৃষ্ঠা থেকে সেই অসম্পূর্ণ স্মৃতিকথাই প্রকাশিত হল এই বইমেলায়, সপ্তর্ষি প্রকাশন থেকে। মানুষ অতুলপ্রসাদ নামের সেই বইটিতে থাকছে পাহাড়ী সান্যাল ও অতুলপ্রসাদের বেশ কয়েকটি ছবিও। বইটি সম্পাদনা করেছেন অর্চি মিত্র।
   


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.