কর্ণ নয়, অশ্বত্থামা নয়, অভিমন্যু নয়, শকুনিও নয়। এঁদের জীবনচরিত বাংলা রঙ্গমঞ্চ ইতিমধ্যেই দেখেছে, ভবিষ্যতেও দেখবে। কৌশিক সেনের পরিচালনায় নতুন চেহারায় ‘অশ্বত্থামা’র মঞ্চায়ন তো হওয়ার কথা এ
বছরের শেষেই। কিন্তু তার আগে এই মুহূর্তে মহাভারত থেকে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করছেন এক নতুন নায়ক, দুর্যোধন।
সোমবার অভিনয় শুরু হবে বহুরূপী-র নতুন নাটক, ‘নানা ফুলের মালা’-র। সেখানে দুর্যোধন শুধু মূল চরিত্রই নন, ভিলেন-এর চেনা ছবি থেকে বেরিয়ে এসে তিনি এক অন্য প্রতিমা।
সেই প্রাচীন যুগে, দ্বিতীয়-তৃতীয় খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত নাট্যকার ভাস লিখেছিলেন নাটক, ঊরুভঙ্গ। সেখানে নায়ক ছিলেন দুর্যোধন। ষাটের দশকের শেষে শান্তা গাঁধী হিন্দিতে এবং সাতের দশকে রতন থিয়াম মণিপুরিতে সেই নাটক নতুন করে ফিরিয়ে এনেছিলেন। এ বাদে দুর্যোধনকে নায়ক করে তেমন বড় মাপের কোনও নাটক লেখা হয়নি বললেই চলে। অথচ উত্তরাঞ্চল এবং কেরলের বেশ কিছু অংশে দুর্যোধনের মন্দির দেখতে পাওয়া যায়। প্রজাবৎসল রাজা হিসেবে দুর্যোধন আজও সেখানে পুজো পান। |
বাংলার নাট্যমঞ্চে মহাভারতকে অবলম্বন করে বহু প্রযোজনা হয়েছে। কর্ণার্জুন, ভীষ্ম, সাবিত্রী-সত্যবান, বীর অভিমন্যু, কৃষ্ণ-শকুনি একাধিক প্রযোজনা হয়েছে পেশাদার রঙ্গালয়ে। গ্রুপ থিয়েটারেও ‘নাথবতী অনাথবৎ’ থেকে ‘প্রথম পার্থ’, ‘ধর্মাধর্ম’ থেকে ‘মাধবী’, ‘অনাম্নী অঙ্গনা’ থেকে ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’, ‘কথা অমৃত সমান’ থেকে ‘অগ্নিজল’ উদাহরণ বিস্তর। এমনকী শিব মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় সম্মিলিত অভিনয়ে ‘মহাভারত’ও হয়েছে। এদের মধ্যে বাণিজ্যিক সাফল্যের নিরিখে সবচেয়ে আগে অবশ্যই শাঁওলী মিত্রর ‘নাথবতী অনাথবৎ’। আটের দশক থেকে শুরু করে অন্তত শ’পাঁচেক শো হয়েছে তার। এখনও পাঠ-অভিনয় হলে হাউসফুল থাকে। নয়ের দশকে কৌশিক সেনের ‘প্রথম পার্থ’ ১১৫টি শো হয়। নান্দীকারের ‘মাধবী’ এখনও অভিনীত হচ্ছে। শো হয়েছে ৮০-র বেশি। এ ছাড়াও অভিনয় চলছে মনোজ মিত্র’র ‘যা নেই ভারতে’। সবে শুরু হয়েছে অর্পিতা ঘোষের ‘এবং দেবযানী’, ৬টি শো হয়েছে। বহুরূপী অভিনয় করছে ‘বীর্যশুল্কা’ এবং ‘কালসন্ধ্যা’, ৩০-এর কাছাকাছি শো হয়ে গেল।
এই সব প্রযোজনায় কখনও উঠে এসেছে মহাভারতের নানা টুকরো আখ্যান, কখনও কুরু-পাণ্ডবের চরিত্ররা। সেখানে বিদুর (কালসন্ধ্যা) বা শকুনি (শকুনির পাশা) বা অম্বা-কে (বীর্যশুল্কা) নিয়ে নাটক হলেও দুর্যোধন কিন্তু উপেক্ষিতই ছিলেন এত দিন। ‘নানা ফুলের মালা’ সেদিক থেকে হতে চলেছে একটি ব্যতিক্রমী প্রযোজনা। যেখানে দুর্যোধন প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন ব্যাসকে, “এই কি ভারত তব পিতামহ? বিরুদ্ধ স্বর যদি সত্য হয়, শক্তিধর বধ করে তাকে অন্যায় আঘাতে?” দুর্যোধন এখানে বহুত্ববাদের প্রতিনিধি। যিনি কখনও সে ভাবে সাম্রাজ্য বিস্তারে লিপ্ত হননি, করেননি কোনও রাজসূয় যজ্ঞ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরই বরং ছোট ছোট রাজ্যসীমাগুলি মুছে গিয়ে বৃহৎ রাষ্ট্রের জন্ম হল। নাটকটি লেখার জন্য অলখ মুখোপাধ্যায়ের আধার ছিল প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস। ষোড়শ মহাজনপদের সময় পেরিয়ে প্রধান শক্তি হিসেবে মগধের উত্থান-পর্বটিই ভাবিয়েছে তাঁকে, বললেন তিনি। নাটকের কাহিনিসার শুনে কৌশিক সেন কিন্তু চিনে নিলেন সম সময়কেও। বললেন, “গণতন্ত্র শুনলেই মনে হয় খুব লোভনীয় ব্যাপার। কিন্তু সত্যই কি তা ধারণ করে বিরুদ্ধ স্বর? বহু স্বর?”
এ নাটকে দুর্যোধনের ভূমিকায় অভিনয় করছেন দেবেশ রায়চৌধুরী। মালিনী, নবান্ন, ফুল্লকেতুর পালা, ছাঁচভাঙা মূর্তি একের পর এক নাটকে তাঁর অভিনয় এত দিন আলো ছড়িয়েছে। তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের অকস্মাৎ মৃত্যুর পরে এ বার পরিচালনার দায়িত্বেও তিনি। বহুরূপীতে একক নির্দেশনায় এই প্রথম আত্মপ্রকাশ তাঁর। ‘যযাতি’-তে যযাতি, ‘কালসন্ধ্যা’য় কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করার পরে ‘দুর্যোধন’ দেবেশের কাছে নতুন চ্যালেঞ্জ। দর্শকের কাছে দুর্যোধনকে অন্য চেহারায় পৌঁছে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ। “সংলাপ যদি যুক্তিনির্ভর হয় আর সেটা যদি বিশ্বাস্য করে তোলা যায়, দর্শক বুঝবেনই। অভিনেতার সেটাই তো কাজ!”
অতএব? ‘নায়ক’ দুর্যোধনের মঞ্চ তৈরি! |