রাজ্যের ‘শস্যগোলা’য় ফের আত্মঘাতী চাষি।
শনিবার সকালে বাড়ির কাছেই একটি গাছে ঝুলন্ত দেহ মেলে কেতুগ্রামের কৌড়ি গ্রামের ধানচাষি ভূতনাথ পালের (৫৪)। চলতি মাসেই এর আগে বর্ধমান জেলায় আরও চার চাষি আত্মঘাতী হয়েছেন। ভূতনাথবাবু সেই তালিকায় শেষ সংযোজন। এ ক্ষেত্রেও আত্মহত্যার কারণ হিসেবে মৃতের পরিবার যে দাবি করছে, জেলা প্রশাসন তা মানতে নারাজ।
মৃতের বাড়ির লোকের দাবি, আর্থিক অনটনের কারণে বাজারে বিস্তর দেনা ছিল ভূতনাথবাবুর। এর মধ্যেই ধানচাষে বিপর্যয় হওয়ায় মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। সামান্য যে ২ কুইন্টাল ধান কাটোয়ার একটি চালকলে আরও কিছু চাষির সঙ্গে মিলে বিক্রি করেছিলেন, মেলেনি সেই টাকাও। তবে এই মৃত্যুর সঙ্গে ধান বিক্রির সম্পর্ক নেই বলেই দাবি খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের। তাঁর বক্তব্য, “ঘটনাটি জানি। ওই ব্যক্তি মানসিক ভারসাম্যহীন বলে তাঁর পরিবারের লোকেরাই জানিয়েছেন। এর সঙ্গে চাষে বিপর্যয়ের বা ধান বিক্রির কোনও সম্পর্ক নেই।”
জেলা প্রশাসন অবশ্য মৃতের সংসারে অভাবের কথা মেনে নিয়েছে। মহকুমাশাসক (কাটোয়া) দেবীপ্রসাদ করণম বলেন, “আর্থিক অনটনের কারণেই ভূতনাথবাবু আত্মঘাতী হয়েছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে প্রকাশ।” ঘটনার তদন্ত করতে এ দিন সকালে গ্রামে যান যুগ্ম-বিডিও আরিকুল ইসলাম ও কেতুগ্রাম থানার আইসি আব্দুল গফ্ফর। আইসি বলেন, “মৃতের ভাই রঘুনাথ পাল লিখিত ভাবে জানিয়েছেন, যে ‘সাংসারিক অনটনে’র কারণেই আত্মহত্যা করেছেন ভূতনাথবাবু।” |
খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা করে মৃত চাষির পরিবার জানিয়েছে, মানসিক রোগের চিকিৎসা চলছে রঘুনাথ পালেরই। তাঁর মেয়ে পাপিয়া ঘোষ শনিবার বলেন, “বাবা দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন। বর্ধমানে চিকিৎসা চলছে।” একই কথা জানিয়েছেন পাপিয়ার মা রিতাদেবী। প্রসঙ্গত, গত ১৯ জানুয়ারি এই জেলারই গলসির হিট্টা গ্রামের কৃষিজীবী সুশান্ত ঘোষের আত্মহত্যা পরে তাঁর ‘মানসিক সুস্থতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল জেলা প্রশাসন। সুশান্তবাবুর পরিবার অবশ্য প্রশাসনের সেই দাবি উড়িয়ে দিয়ে ধান ও আলু চাষে বিপর্যয়কেই দায়ী করেছিল।
ভূতনাথবাবুর পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ভূতনাথবাবুর ৩ বিঘা জমি রয়েছে কৌড়ি গ্রাম লাগোয়া খেয়াই-বান্দরা গ্রামের দিকে। জমিটি নিচু। পরিবারের দাবি, এ বারও বর্ষায় জলে ডুবে ভূতনাথবাবুর ধান নষ্ট হয়ে যায়। ফলে, তিন বিঘা জমি থেকে মাত্র ৬ কুইন্টাল ধান তিনি ঘরে তুলতে পেরেছিলেন। অথচ, চাষিদের হিসেবে ওই জমি থেকে ন্যূনতম ২০ কুইন্টাল ধান হওয়ার কথা। যে ৬ কুইন্টাল ধান উঠেছিল, তার মধ্যে ২ কুইন্টাল চলে গিয়েছে দেনা শোধ করতে। ২ কুইন্টাল তিনি রেখেছিলেন বাড়ির জন্য। আর বাকি ২ কুইন্টাল আরও কিছু চাষির সঙ্গে মিলে গত ২০ জানুয়ারি চালকলে বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু ‘চেক’ হাতে পাননি।
কেন? এলাকার চাষি সঞ্জিত পাল, আস্তিক মণ্ডলদের অভিযোগ, ‘চেক’ পেতে বিস্তর হয়রানি হচ্ছে। ধান বিক্রির পরে বলা হচ্ছে, দিন পনেরো-কুড়ি বাদে এসে ‘চেক’ নিতে। যদিও সেই ‘চেক’-এ তারিখ দেওয়া থাকছে ধান বিক্রির দিনের। বস্তুত, স্থানীয় বিডিও (কেতুগ্রাম ২ ব্লক) হেমন্ত ঘোষও বলেছেন, “আমাদের কাছে এমন অভিযোগ প্রচুর এসেছে।”
একে তো ধান বিক্রির টাকা মেলেনি, তায় সংসারে চরম অভাব। তার উপরে ১০০ দিনের প্রকল্পে গত দু’মাসে ভূতনাথবাবু কাজ পেয়েছিলেন মাত্র ৯ দিন। হাতে পাননি তার মজুরিও। সংশ্লিষ্ট বিল্লেশ্বর পঞ্চায়েতের সিপিএম প্রধান ধুলো মণ্ডল বলেন, “নিয়মের ফেরে অনেক সময় মজুরি দিতে দেরি হয়। এ ক্ষেত্রে কী হয়েছে, খোঁজ নিতে হবে।”
বোরো চাষও করতে পারেননি ভূতনাথবাবু। তাঁর স্ত্রী অত্যুন্তি পাল বলেন, “ধান হয়নি। চার দিকে অনেক দেনা হয়ে গিয়েছিল। বোরো চাষ কী করে করবে, তা নিয়ে আমার স্বামী খুব দুশ্চিন্তা করছিলেন ক’দিন ধরে।” এ সবের মধ্যেই আসন্নপ্রসবা মেয়ে বৈশাখী ঘোষ বৃহস্পতিবার শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে আসেন। বড় মেয়ে মৌসুমী মানসিক প্রতিবন্ধী। অত্যুন্তিদেবীর কথায়, “এই অবস্থায় কী ভাবে সংসার চলবে, উনি কিছুতেই তা ঠিক করে উঠতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত যে এ রকম করে বসবেন, বুঝতে পারিনি।” ভূতনাথবাবুর ছোট ছেলে পবন এ বছর নবম শ্রেণিতে উঠেছে। কিন্তু অভাবে তার পড়া ঘুচেছে। তার গৃহশিক্ষকের টাকাও মেটাতে পারেনি পরিবার। পবন এখন কলকাতার একটি দোকানে ফাইফরমাস খাটে।
পড়শি জগবন্ধু ঘোষের দাবি, “পুজোর আগে মাসে ১০ শতাংশ সুদে ভূতনাথ আমার থেকে দশ হাজার টাকা ধার নেন। ধান বিক্রি করে টাকা শোধ করার কথা ছিল। কিন্তু ধানই তো পেলেন না! গ্রামের আরও অনেকের কাছেই ওঁর টুকটাক ধার ছিল।” স্থানীয় কংগ্রেস কর্মী নিমাই ঘোষ, তৃণমূল কর্মী জটাধারী ঘোষ বলেন, “পরিস্থিতির চাপে অনেককেই না আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়!” গ্রামবাসীরাই সাড়ে তিন হাজার টাকা চাঁদা তুলেছেন শেষকৃত্যের জন্য। সিপিএম পরিচালিত কেতুগ্রাম ২ পঞ্চায়েত সমিতি পারলৌকিক কাজের জন্য ৫ হাজার টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এই আত্মহত্যা ঘিরে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজাও। তৃণমূলের বর্ধমান জেলা (গ্রামীণ) সভাপতি স্বপন দেবনাথ বলেন, “ওই এলাকার অধিকাংশ মানুষেরই আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি সবই সিপিএমের। আমাদের সরকার চাইলেও ওরা চক্রান্ত করে মানুষকে ১০০ দিনের কাজ থেকে বঞ্চিত করেছে।” সিপিএমের বর্ধমান জেলা কমিটির সদস্য দুর্যোধন সরের পাল্টা দাবি, “রাজ্য সরকারের নীতির জন্যই আত্মঘাতী হচ্ছেন চাষিরা।” মঙ্গলকোটের সিপিএম বিধায়ক শাহজাহান চৌধুরী মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে জেলার আত্মঘাতী চাষিদের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। কাটোয়ার কংগ্রেস বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “রাজনীতি না খুঁজে কেন ওই চাষির মৃত্যু হল, তার প্রকৃত কারণ বের করা দরকার।”
এই ‘তরজাই’ অন্য মাত্রা পেয়েছে এ দিন খাদ্যমন্ত্রীর একটি অভিযোগকে ঘিরে। গলসিতে ‘ধান কেলেঙ্কারি’ ঘটেছে জানিয়ে তাঁর দাবি, “গলসিতে এমন কিছু লোককে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাঁদের কার্যত কোনও জমি নেই। কিন্তু তাঁরা একাধিক চালকলে ৫০০ বস্তার বেশি ধান বিক্রি করেছেন। তাঁদের চাষি হিসাবে ভুয়ো শংসাপত্র দিয়েছিলেন সিপিএমের দখলে থাকা কয়েকটি পঞ্চায়েতের প্রধান।” জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, “ওই প্রধানদের বিরুদ্ধে ভিজিল্যান্স তদন্ত হবে। দোষী প্রমাণিত হলে তাঁদের গ্রেফতার করা হবে। জেলাশাসককেও বলা হবে ওই প্রধানদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে।”
চালকলগুলি চাষিদের কাছ থেকে ধান কিনছে না, এই অভিযোগে শুক্রবার গলসির পারাজের কাছে পথ অবরোধ হয়। আটকে পড়েন আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক। মন্ত্রী ৩১ জানুয়ারি-৩ ফেব্রুয়ারি শিবির করে ধান কেনার আশ্বাস দিলে অবরোধ ওঠে। মলয়বাবু এ দিন বলেন “তদন্ত রিপোর্ট দেখে ভুয়ো চাষি ও দোষী প্রধানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” খাদ্য দফতরও তদন্ত করবে বলে জানিয়েছেন বর্ধমানের জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা।
সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য তথা বর্ধমান-দুর্গাপুরের সাংসদ সাইদুল হকের প্রতিক্রিয়া, “আমরাও চাই তদন্ত হোক। কারণ প্রথমে বিডিও ঠিক করে দিয়েছিলেন, চাষিদের কাছ থেকে ১০০ বস্তা করে ধান কেনা হবে। পরে তা কমিয়ে মাথা পিছু ৫০ বস্তা করা হয়। কিন্তু তৃণমূলের মদতেই বেশ কিছু লোক স্থানীয় কয়েকটি চালকলে গিয়ে যথেচ্ছ ধান বিক্রি করেছে। নিরপেক্ষ তদন্ত হলে তা বের হয়ে পড়বে।” |
সহপ্রতিবেদন: রানা সেনগুপ্ত |