রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
পরিব্রাজক
ই সেই বজ্রাসন! বোধগয়ার অশ্বত্থ গাছ আর মন্দিরের মাঝে চ্যাটালো পাথর। চার পাশে আলোকস্তম্ভ, পাথরে বিছিয়ে-রাখা রেশমি চাদর। তারই সামনে ধ্যানে বসেছেন চিন, জাপান, কোরিয়া থেকে আসা ভিক্ষুর দল। লাউডস্পিকারে ভেসে আসছে ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।’
আড়াই হাজার বছর আগে, সুজাতার দেওয়া পায়েস খেয়ে এই পাথরের ওপরেই ধ্যানে বসেছিলেন তিনি? শরীর শেষ হয়ে যাক, তবু জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর কারণটা তাঁকে জানতেই হবে। কী ভাবে মানুষ বাঁচতে পারে দুঃখের হাত থেকে?
আড়াই হাজার বছর আগের কথা থাকুক। মাত্র ১২৫ বছর যদি পিছিয়ে যাওয়া যায়? ১৮৮৬ সালের এপ্রিল মাস। তিন বছর আগে কানিংহাম, রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মতো পুরাতাত্ত্বিকদের চেষ্টায় জঙ্গল সাফ করে জায়গাটা খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। চলছে সংস্কারকাজ।
বোধগয়ার মন্দির ঘিরে এত নিরাপত্তা এবং সুব্যবস্থা তখন ছিল না। কলকাতা থেকে-আসা তিন গেরুয়াধারী যুবক সে দিন এই পাথরের ওপরেই ধ্যানে বসেছিলেন। নরেন্দ্রনাথ দত্ত, কালীপ্রসাদ চন্দ্র ও তারকনাথ ঘোষাল। তিন জনেই ইংরেজি-শিক্ষিত, শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। কেশবচন্দ্র সেনের ব্রাহ্মসমাজের ঘনিষ্ঠ।
তবে ব্রাহ্মসমাজের মঞ্চে গান গেয়ে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা তিন জনেই এখন ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের ঠাকুর রামকৃষ্ণ এঁদের গুরু। এই যুবকদের তিনি শিখিয়েছেন, সাকার আর নিরাকারে কোনও ভেদ নেই। শিখিয়েছেন, ‘ধ্যান করবে মনে, বনে আর কোণে!’
গত কয়েক মাস ধরে সেই রামকৃষ্ণ ক্যান্সারে ভুগছেন। আপাতত, ভক্তদের দানে কাশীপুরে ৮০ টাকা ভাড়ার এক বাগানবাড়িতে থাকেন। নরেন্দ্র, কালীদের মতো তরুণরা সেখানে সকাল থেকে অসুস্থ গুরুর সেবা করেন, রাতে কোনও ক্রমে বাড়ি ফিরে আসা। তার মধ্যেই ধ্যানজপ অভ্যাস। মাস কয়েক আগে এক সন্ধ্যায় গিরিশচন্দ্র ঘোষ আর নরেন্দ্র সেই বাগানে ধ্যানে বসেছিলেন। কিছুক্ষণ বাদে মশার কামড়ে অস্থির গিরিশ চোখ খুলে দেখেন, নরেন্দ্র তখনও ধ্যানমগ্ন। গায়ে কালো কম্বলের মতো মশা থিকথিক করছে, তবু হুঁশ নেই।
গত কয়েক মাস এ ভাবেই ধ্যান অভ্যাস চলছে। কিন্তু এপ্রিল মাসের সেই দিন, বোধগয়ার মন্দিরে ধ্যানের মধ্যেই নরেন্দ্র একটা আলো দেখলেন। বন্ধু কালীপ্রসাদকে বলেছিলেন, “দেখলাম, বুদ্ধমূর্তি থেকে তোমার পাশে, তারকদার দিক দিয়ে একটা জ্যোতি ‘পাস’ করে গেল।” এর আগে ছেলেবেলায় নরেন্দ্র মা এবং ভাইকে নিয়ে মধ্য ভারতের রায়পুরে গিয়েছিলেন। তার পর এই প্রথম সফর। গেরুয়া বস্ত্রে!
গেরুয়া আছে। কিন্তু তিন যুবকের কেউই নিয়মমাফিক, বিরজা হোম সম্পন্ন করে সন্ন্যাসী হননি। কোনও সন্ন্যাস-নামও নেই। মাস তিনেক আগে অদ্ভুত ভাবে এঁরা গেরুয়া পেয়েছেন। এঁদের সতীর্থ গোপালচন্দ্র ঘোষ গঙ্গাসাগর মেলায় আসা সাধুদের দেওয়ার জন্য বারোটি কাপড় কিনে তাতে গেরিমাটির রং করছিলেন। গোপালবাবু বয়সে নরেন্দ্র, কালীদের চেয়ে অনেকটাই বড়। স্ত্রীবিয়োগের পর রামকৃষ্ণ-সান্নিধ্যে এসেছেন।
কিন্তু রামকৃষ্ণ প্রবীণ শিষ্যের সেই ইচ্ছায় বাধ সাধলেন, “আমার এই ছেলেদের মতো ত্যাগী সাধু আর কোথায় পাবি? এদের এক-এক জন হাজার সাধুর সমান।” গোপালের আনা গেরুয়া বস্ত্র ও রুদ্রাক্ষ মন্ত্রপূত করে দিলেন তিনি। এ ভাবেই নরেন, কালী, শশী, শরৎ, নিরঞ্জন, বাবুরাম প্রমুখ এগারো জন শিষ্য সন্ন্যাস-বস্ত্র পেয়েছেন। বারো নম্বর গেরুয়াটি পেয়েছেন নট ও নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ। তিনি সেটিকে মাথায় ঠেকিয়ে ঠাকুরঘরে তুলে রেখেছেন, গেরুয়া পরেন না। এই তরুণ শিষ্যরা অবশ্য কাশীপুরের বাগানে ধ্যান, জপের সময় গেরুয়া পরেন। যাতায়াত বা অন্য সময়ে স্বাভাবিক পোশাক।
সে সময়েই নরেন্দ্রর পরিকল্পনা। দেখে আসা যাক বুদ্ধের তপস্যাস্থল! রামকৃষ্ণকেও কিছু জানানো হল না। গেরুয়া, কপনি আর কম্বল নিয়ে তিন যুবক বরানগর খেয়াঘাট থেকে নৌকোয় গঙ্গা পেরিয়ে চলে গেল বালি। ভোরবেলায় ট্রেন ধরে গয়া স্টেশন থেকে হেঁটে বোধগয়া।
ধ্যান শেষে তিন যুবকই মাধুকরীতে বেরোল। অতঃপর কিছু জলযোগ সেরে ধর্মশালায় রাত্রিযাপন। কিন্তু নরেন্দ্র প্রায়ই পেটের অসুখে ভোগেন, মাধুকরীতে পাওয়া মাড়ুয়ার রুটি তাঁর সহ্য হয়নি। রাত থেকেই পেটের যন্ত্রণা আর পাতলা পায়খানা। এ দিকে ফেরার পয়সাও নেই। পর দিন সকালে নৈরঞ্জনা নদীর বালির চর পেরিয়ে তিন যুবক হাঁটতে হাঁটতে বোধগয়ার মোহান্তের কাছে। দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ই এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণে। মোহান্তই তাঁদের ফেরার ট্রেনভাড়া জোগালেন।
২০১১ সালের এই সন্ধ্যায় বোধগয়ার মন্দির আলোয় ঝলমল। বুদ্ধমূর্তির সামনে মাখনের বাটিতে প্রদীপ। ১২৬ বছর আগে এখানে বৌদ্ধদের প্রবেশাধিকার ছিল না। নরেন্দ্রদের পর এখানে এসেছিলেন শ্রীলঙ্কার জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ নেতা অনাগরিক ধর্মপাল। মন্দিরে কেন বৌদ্ধদের প্রবেশাধিকার নেই, শৈব মোহান্তই বা কেন সর্বেসর্বা হবেন, তা নিয়ে ব্রিটিশ উপনিবেশে তিনিই শুরু করেছিলেন আন্দোলন।
শিকাগোর ধর্মমহাসম্মেলনে বৌদ্ধদের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন অনাগরিক ধর্মপাল। ছিলেন নরেন্দ্রও, তাঁর নাম তখন স্বামী বিবেকানন্দ। কিন্তু বোধগয়ায় দশনামী সম্প্রদায়ের মঠ নিয়ে তিনি ভাবিত ছিলেন না। বৌদ্ধধর্ম তাঁর কাছে হিন্দুধর্মেরই একটি শাখা। শিকাগো ধর্মমহাসভায় সাফ জানাবেন, “গৌতম বুদ্ধ ছিলেন হিন্দুধর্মের স্বাভাবিক পরিণতি ও ন্যায়সম্মত বিকাশ।... বেদের মধ্য থেকে সত্যকে বার করে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি।”
তা হলে? বিবেকানন্দের পরবর্তী চিন্তাভাবনার বীজ কি খুঁজে পাওয়া যায় দণ্ড, কমণ্ডলু হাতে তাঁর ভারত সফরে? ব্যক্তিগত অধ্যাত্মতৃষ্ণায় রামকৃষ্ণের কাছে গিয়েছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র, “আপনি ঈশ্বরকে দেখেছেন?” রামকৃষ্ণের উত্তর বিখ্যাত, “হ্যাঁ, তোকে যতটা দেখছি, তার চেয়েও স্পষ্ট ভাবে দেখেছি।”
আর, ভারত সফর শেষে? আমেরিকা যাওয়ার জন্য মুম্বই বন্দর থেকে ‘পেনিনসুলার’ জাহাজে উঠবেন বিবেকানন্দ। সতীর্থ তুরীয়ানন্দ তাঁকে তখন ধর্ম নিয়ে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। সাফ উত্তর এল, “ধর্মের কিছু বুঝিনি। তবে গত কয়েক বছরে হৃদয়টা খুব বেড়ে গিয়েছে। অন্যের ব্যথা আর দুঃখ বুঝতে শিখেছি।”
ভারতসফর এতটাই বদলে দিয়েছিল অধ্যাত্মপিপাসু তরুণকে!

বিস্তারিত দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন...

রুখে দাঁড়াও
বোধগয়ার পরের বছর জানুয়ারি মাসে গেরুয়াধারী নরেন্দ্রকে দেখা গেল বারাণসীধামে। সন্ত দ্বারকাদাসের আশ্রমে রয়েছেন তিনি। এখন তাঁর সন্ন্যাস-নাম: স্বামী বিবিদিষানন্দ।
গত অগস্টে রামকৃষ্ণ দেহ রেখেছেন। কাশীপুর ছেড়ে নরেন্দ্র ও তাঁর বন্ধুরা এখন বরাহনগরে দশ টাকা ভাড়ার এক বাড়িতে। সেখানে খাবারের ঠিকঠিকানা নেই, তেলাকুচো পাতার ঝোল আর নুনভাত সম্বল। কিন্তু শাস্ত্র আলোচনা, জপ, ধ্যান রোজ চলে। সে সময়েই নরেন্দ্র বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করলেন, “এ বার শাস্ত্রমতে সন্ন্যাস নিলে কেমন হয়?” কালীপ্রসাদ সায় দিলেন, “ভালই হয়। তবে বিরজা হোম করতে হবে। আমার খাতায় সেই মন্ত্র আছে।” বোধগয়া থেকে ফিরে, রামকৃষ্ণের জীবদ্দশাতেই কয়েক দিনের জন্য গয়ায় গিয়েছিলেন কালীপ্রসাদ। সেখানে এক দশনামী সন্ন্যাসীর কাছ থেকে বিরজা হোমের মঠ, মড়ি, মন্ত্র তাঁর খাতায় টুকে নিয়েছিলেন। সেটাই এ বার কাজে এল। মাঘ মাসের সকালে রামকৃষ্ণের পাদুকার সামনে নরেন্দ্র ও তাঁর বন্ধুরা বসলেন। হোমের জন্য জোগাড় হয়েছে বেলগাছের বারোটা ডাল, গাওয়া ঘি। কালীপ্রসাদ খাতা দেখে মন্ত্র পড়তে লাগলেন। এই অনুষ্ঠানের পরেই তাঁর নাম হবে অভেদানন্দ। নরেন্দ্র হবেন বিবিদিষানন্দ। রামকৃষ্ণ আলাদা কোনও সন্ন্যাসমন্ত্র দিয়ে যাননি। মঠ ও মিশনের প্রথম সন্ন্যাসীদের বিরজা হোমের মন্ত্রও গয়া সফরের প্রত্যক্ষ ফল।
পেটের অসুখ ও জ্বরের কারণে নরেন্দ্র এই সময় শিমুলতলা যান। হাওয়া বদল ছাড়া আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল। সামনেই দেওঘরের বৈদ্যনাথধাম! তার পর সেখান থেকে বারাণসী। সফর-সূচি তখন এ রকমই হত। বৈদ্যনাথ দর্শন করে কাশীর বিশ্বেশ্বর শিব। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর দিন পনেরো পর তীর্থযাত্রা করেন মা সারদা। তিনিও দেওঘর, বারাণসী হয়ে বৃন্দাবনে গিয়েছিলেন।
বারাণসীতে নরেন্দ্র আছেন দ্বারকাদাসের বাগানে। রোজ গঙ্গাস্নান সেরে বিশ্বেশ্বর শিবকে দর্শন করেন। এক দিন গঙ্গার ঘাটে গেলেন ত্রৈলঙ্গস্বামীর পদধূলি নিতে। আধ্যাত্মিক তৃষ্ণাতেই তখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন নরেন্দ্র। ‘নতুন ভারত বেরুক চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে’-এর উদাত্ত ডাক তখনও দূর অস্ত। এই সফরে এক সকালে দুর্গামন্দির যাচ্ছেন তিনি। রাস্তায় তাড়া করল এক পাল বানর। বানরদের ভ্যাংচানি-কামড়ানির কথা নরেন্দ্র জানতেন, হাঁটার বেগ বাড়িয়ে দিলেন তিনি। বানরেরাও পাল্টা বেগ বাড়াল। শেষে দৌড়, তবু ছাড়ান নেই। বানরেরা প্রায় ধরে ফেলেছে তাঁকে!
এমন সময় পিছন থেকে ভেসে এল এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর ডাক, ‘থামো। রুখে দাঁড়াও।’ পরামর্শ শুনে নরেন্দ্র ঘুরে দাঁড়ালেন, বানরগুলিও থমকে গেল। তার পর ভয়ের চোটে দে দৌড়! প্রথম বারাণসী সফরের এই অভিজ্ঞতা কোনও দিনই ভুলবেন না নরেন্দ্র। পরে আমেরিকা সফরেও ঘটনাটি বলবেন তিনি। জানাবেন, এই ভাবে রুখে দাঁড়িয়েই প্রকৃতি, অবিদ্যা ও মায়াকে জয় করতে হবে।
আমেরিকা সফর অনেক পরের গল্প। কিন্তু নরেন্দ্র বারাণসী থেকে ফেরার পর? কথামৃতকার শ্রীম বরাহনগরে দেখলেন, ‘‘কাঁসর ঘণ্টা বাজিতেছে, ‘জয় শিব ওঁকার, ভজ শিব ওঁকার।’ নরেন্দ্র এই গান ধরাইয়াছেন। কাশীধামে বিশ্বনাথের সম্মুখে এই গান হয়।’’ বেলুড়মঠে সেই ট্রাডিশন আজও চলছে!

আগরা ১৮৮৮
যমুনার ধারে এই শাহজাহানের তাজমহল? অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন সন্ন্যাসী। কখনও সকালে, কখনও চাঁদের আলোয়, কখনও এ দিক, কখনও বা ও দিক থেকে বারে বারে তাজকে দেখেও তৃপ্ত হচ্ছেন না তিনি। তাঁর মনে হচ্ছে, সম্পূর্ণ ভাবে তাজমহলের সৌন্দর্য দেখতে অন্তত ছয় মাস দরকার।
এ বারেও বালি স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে ফের বেরিয়ে পড়েছেন নরেন্দ্র। বরাহনগর মঠে তাঁর সতীর্থ ও সন্ন্যাসী বন্ধুরা অনেকেই দেশভ্রমণে ইতিউতি ছিটকে পড়ছেন।
তাঁর পাড়ার বন্ধু রাখাল ওরফে ব্রহ্মানন্দও বেরিয়ে গিয়েছেন সফরে। নরেন্দ্র অবশ্য ঠাট্টা করতে ছাড়েননি, “হ্যাঁ, ওই ভাবে ঘুরে বেড়ালেই ভগবান দেখা দেবেন আর কী!” আসলে নরেন্দ্রর পৈতৃক বাড়ি নিয়ে বিধবা মা ও কাকিমার মধ্যে
মামলা চলছে। কলকাতার বাইরে বেশি দিন থাকা সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে।
তবু বেরিয়ে পড়লেন নরেন্দ্র। প্রথমে বারাণসী। সেখান থেকে সরযূর তীরে রামচন্দ্রের স্মৃতিধন্য অযোধ্যা। তার পর লখনউ। সেখানকার মসজিদ, ভুলভুলাইয়া দেখে আগরা। স্থাপত্য-মুগ্ধ এক সন্ন্যাসী।
গোটা সফরেই কি রয়েছে নিঃশব্দ কোনও প্যাটার্ন? বারাণসী, অযোধ্যা হিন্দু তীর্থ। কিন্তু লখনউ বা আগরা? তাঁর সতীর্থরা তখন কেউ চলেছেন বৃন্দাবনে, কেউ বা হৃষীকেশ থেকে হাঁটাপথে কেদার, বদ্রী (বাসরাস্তা তখনও হয়নি)। কেউ বা বদ্রীনাথ, মানা গ্রাম পেরিয়ে সটান তিব্বত। প্রত্যেকের পর্যটনের নিয়ম মোটামুটি এক। টাকাপয়সা ছোঁন না। ভক্ত বা গুণগ্রাহীরা ট্রেনের টিকিট কেটে দিতে পারেন, এইমাত্র।
আর সেই সাধারণ নিয়মের মধ্যেই লখনউ, আগরায় দিন কয়েকের স্টপওভারে আলাদা হয়ে যায় নরেন্দ্রনাথের সফর। এক-একটি স্পটে তিনি দেখে নিচ্ছেন ভারতের হৃত গৌরব। শোপেনআওয়ারের দর্শন থেকে গিবনের ‘রোম সাম্রাজ্যের ইতিহাস’ খুঁটিয়ে পড়া হিন্দু সন্ন্যাসীর মনে নিজের অজান্তেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে বিশেষ এক জাতীয়তাবাদী বয়ান। সেই বয়ানের বলেই আরও কয়েক বছর পরে তিনি জানাবেন, “ভারত তার মুসলমান বিজেতাদের জয় করেছে।... মোগল সম্রাট মহাত্মা আকবর কার্যত একজন হিন্দু ছিলেন।”

ভাঙ্গীর হুঁকোয় টান
দণ্ড, কমণ্ডলু নিয়ে আগরা থেকে হেঁটে বৃন্দাবনে পৌঁছলেন বিবিদিষানন্দ। রাস্তার ধারে হুঁকোয় টান মারছে একটি লোক। সন্ন্যাসী দুটো টান দিতে চাইলে জড়সড় জবাব, ‘আমি ভাঙ্গী (মেথর), মহারাজ।’
সন্ন্যাসী এগিয়ে গেলেন। আর তার পরই নিজের মনে ধিক্কার। ছি, আমি না সন্ন্যাসী? সকলের মধ্যেই তো ব্রহ্ম! তবু পিছিয়ে এলাম?
সন্ন্যাসী ফের এগিয়ে গেলেন। এবং সেই ভাঙ্গীর হুঁকোয় টান দিলেন! আর সেই মুহূর্তে ভারতীয় অধ্যাত্মচিন্তায় ঘটে গেল নিঃশব্দ বিপর্যাস! রাজধানী কলকাতায় রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ থেকে কেশবচন্দ্র সেন অবধি সকলে তখন ‘অদ্বৈত ব্রহ্ম’র কথা বলেন। কিন্তু তাঁদের সেই ‘ব্রহ্ম’ শিক্ষিত, অভিজাত সম্প্রদায়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ।
আর বাবুবিবিদের গণ্ডির বাইরে যে সনাতন ভারতীয় সন্ন্যাস? খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে শঙ্করাচার্য-র তৈরি নিয়ম মেনেই সন্ন্যাসীরা আজও পুরী, গিরি ইত্যাদি সম্প্রদায়ে বিভক্ত। শঙ্কর বৈদান্তিক ছিলেন, ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’ই তাঁর দর্শন। মানে, পুরো জগৎ মায়ার খেলা। ব্রাহ্মণ থেকে মুচি, মেথর, চণ্ডাল, কুকুর, বেড়াল, ঘটি, বাটি সকলেই ব্রহ্ম!
এত কিছু সত্ত্বেও সেই বৈদান্তিক সন্ন্যাসী জাতপাত মেটাতে পারেননি। পুরী, শৃঙ্গেরী, দ্বারকায় সন্ন্যাসীদের মঠ তৈরি করেছেন, কিন্তু আশপাশের দরিদ্রদের নিয়ে ভাবেননি। তাঁর আমলে সেটি সম্ভবও ছিল না। উনিশ শতকে বিবিদিষানন্দের পর্যটন সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে দিল। জাতিবর্ণনির্বিশেষে যে দরিদ্র জনসাধারণ, ওই বাঙালি সন্ন্যাসীই প্রথম তাঁদের সঙ্গে একাত্মবোধ করলেন, হুঁকোয় টান দিলেন।
নেশার ছটফটানি? গিরিশচন্দ্র ঘোষ পরে ঠাট্টা করেছিলেন, “তুই শালা নেশাড়ু। তাই নেশার ঝোঁকে মেথরের কল্কে টেনেছিলি।” কিন্তু সন্ন্যাসী অটল, “না রে, সত্যিই সে দিন আমার নিজেকে পরীক্ষা করে দেখার ইচ্ছা হয়েছিল। সন্ন্যাস নিয়ে সত্যিই জাতপাতের ও পারে চলে গিয়েছি? কেটেছে সব সংস্কার?” বহু পরে বেলুড় মঠেও বিবেকানন্দের কাছে সন্ন্যাস আর বিদ্রোহ তাই সমার্থক। তাঁর কাছে সন্ন্যাসীর সংজ্ঞা, ‘Divine Outlaw’.

হিয়ার লিভ্ড স্বামী বিবেকানন্দ...
এই নিয়ে দু’বার হিমালয়ে এলেন বিবিদিষানন্দ। প্রথম বার এসেছিলেন বছর দুয়েক আগে। বৃন্দাবন থেকে হাতরাস জংশন হয়ে। সেখানকার স্টেশন মাস্টার শরৎচন্দ্র গুপ্ত তখন তাঁর কাছে সন্ন্যাসে দীক্ষা নেন। নাম হয় সদানন্দ। ভারত সফরে বেরিয়েই বিবেকানন্দের প্রথম ‘গুরু’ হয়ে ওঠা।
নতুন শিষ্যকে নিয়ে সে বার পায়ে হেঁটে হরিদ্বার, হৃষীকেশ এসেছিলেন বিবিদিষানন্দ। সেটাই তাঁর প্রথম হিমালয়দর্শন। সদানন্দ মাঝে মাঝেই পাহাড়ি পথে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। ঘোড়ায় চেপে পাহাড়ি নদী পেরোতে হবে, তাতেও তাঁর ভয়। বিবিদিষানন্দ ঘোড়ার লাগাম ধরে শিষ্যকে পার করালেন সেই নদী। কেদার, বদ্রীর দিকে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু সদানন্দ মাঝপথে অসুস্থ। তাই তাঁকে নিয়ে ফিরে গেলেন তিনি। সদানন্দর ব্যাপারটা নিয়ে সে সময় কয়েক জন গুরুভাই ঝামেলাও পাকিয়েছিলেন, “নরেন আজকাল শিষ্য বানাচ্ছে রে!”
বছর দুয়েক পরেই বরাহনগর মঠ ছেড়ে ফের বেরিয়ে পড়লেন বিবিদিষানন্দ। বরাহনগর মঠে তিনি আর ফিরবেন না। এই সফর থেকেই পরে আমেরিকা চলে যাবেন। মঠে তখন তুমুল অর্থাভাব। সুরেশচন্দ্র মিত্র এবং বলরাম বসু এত দিন মঠের খরচ চালাতেন, দু’জনেই মারা গিয়েছেন। খরচ চালানো দুঃসাধ্য, ফলে সন্ন্যাসীরা এ দিক ও দিক ছড়িয়ে পড়ছেন। স্বামী বিবিদিষানন্দও বন্ধুকে লিখছেন, ‘আপনার পরামর্শ বুদ্ধিমানের পরামর্শ।... আমরা এস্থানে ওস্থানে দুই চারিজন করিয়া ছড়াইতেছি।”
ভাগলপুর, বৈদ্যনাথ, অযোধ্যা হয়ে বিবিদিষানন্দ এ যাত্রায় এলেন নৈনিতাল। হ্রদের ধারে ছয় দিন কাটিয়ে অতঃপর বদ্রীনাথের পথে। মাঝে আলমোড়ায় দুই গুরুভাইয়ের সঙ্গে দেখা। তাঁরা তখন লালা বদ্রীদাস শাহ নামে স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে থাকেন, সেখানেই নিয়ে এলেন বিবিদিষানন্দকে।
কিন্তু কেদার, বদ্রীর রাস্তা সে বার বন্ধ। তার ওপর আলমোড়া ছাড়িয়ে জ্বরে পড়লেন বিবিদিষানন্দ। ফলে কর্ণপ্রয়াগ থেকে শ্রীনগর, টিহরি হয়ে দেরাদুন। সেখান থেকে হৃষীকেশ। এই নিয়ে দ্বিতীয় বার! হৃষীকেশের গঙ্গা তাঁকে এত মুগ্ধ করেছিল যে পরে ‘পরিব্রাজক’ বইয়ের শুরুতেও লিখবেন, ‘হৃষীকেশের গঙ্গা মনে আছে? সেই নির্মল নীলাভ জল... সেই হিমশীতল ‘গাঙ্গ্যং বারি মনোহারি...’
হৃষীকেশে কোথায় থাকতেন বিবেকানন্দ? থাকতেন সাধু ধনরাজ গিরির কুটিরে। সেটাই তখন নিয়ম। কখনও পাহাড়ের গুহা, কখনও বা ডালপালা ও ফুসঘাস (টাইগার গ্রাস) দিয়ে কুটির তৈরি করে সন্ন্যাসীরা থাকেন। সাধনভজন চলে। হৃষীকেশের ভিড় কি আজকের গল্প? গিরি সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী শঙ্করগিরি সেই সময়েই বিবিদিষানন্দকে বলেছিলেন, “আগে শান্তি ছিল। এখন ধর্মশালা, ছত্রে সাধুদের জন্য রুটি দেওয়া হয়। ফলে যত উল্টোপাল্টা ভিড়। হৃষীকেশ এখন রোটিকেশ!”
এর আগে বারাণসীতে ভাস্করানন্দ থেকে গাজীপুরে পওহারীবাবা, অনেক বিখ্যাত সন্ন্যাসীকেই দেখেছেন বিবিদিষানন্দ। কিন্তু হৃষীকেশ অন্য রকম! উলঙ্গ এক সাধু এক দিন রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, ছেলেরা ঢিল ছুড়ছে। দরদর করে রক্ত, তবু সাধুর ভ্রুক্ষেপ নেই। বিবিদিষানন্দ তাঁকে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছেন, সাধু হাসছেন, “কেয়া মজাদার খেল হ্যায়! বিলকুল বাবা কা খেল!” গুহাবাসী কোনও সন্ন্যাসী আবার তাঁর কাছে দর্শনার্থীদের উৎপাত চান না, ভয় দেখাতে ছড়িয়ে রেখেছেন মানুষের খুলি আর হাড়গোড়। শিকাগো থেকে ফেরার পরেও বিবেকানন্দ ভুলবেন না এই সব সন্ন্যাসীর কথা। শিষ্যদের বলবেন, ওই সন্ন্যাসীরা হিমালয়ের তীর্থে তীর্থে ঘুরে তপস্যা করেন একটাই কারণে। পুণ্যফলে মানুষের কল্যাণের জন্য।
এক ব্যক্তিগত ট্রাজেডির কারণে আলমোড়া ছেড়েছিলেন সন্ন্যাসী। সেখানেই খবর এসেছিল, শিমলা পাহাড়ে আত্মহত্যা করেছেন তাঁর বোন যোগেন্দ্রবালা। তার পরই আলমোড়া ছাড়ার সিদ্ধান্ত। নইলে সেখানে আনন্দেই ছিলেন। লালা বদ্রীদাসের বাড়ি থেকে রোজ পাহাড়ি চড়াই বেয়ে উঠে স্থানীয় কাসারদেবীর মন্দিরে গিয়ে ধ্যানে বসতেন।
একুশ শতকে কাসারদেবীর মন্দির এখন আর পায়ে হাঁটার দরকার হয় না। আলমোড়া থেকে বিনসরের জঙ্গলে যাওয়ার পথেই গোলাকার, লাল ছাদওয়ালা মন্দির। উল্টো দিকে চমৎকার সব লজ। স্যান্ডউইচ, বার্গার, কাফে-র জমজমাট বন্দোবস্ত। বিদেশি ট্যুরিস্টই বেশি। জায়গাটাকে স্থানীয়রা ‘হিপি হিল’ বলেন। বব ডিলান, অ্যালেন গিন্সবার্গ-এর মতো লোকেও এখানে থেকে গিয়েছেন।
আর এখানকার ভাষার যে কী প্রভাব! হরিদ্বার, হৃষীকেশ থেকে আলমোড়া, কেদার, বদ্রী অবধি তামাম উত্তরাখণ্ড আজও সন্ন্যাসীদের ‘মহারাজ’ বলে। সেই সংস্কৃতিচিহ্ন-র বলে রামকৃষ্ণ মিশনে আজও সন্ন্যাসীদের ‘মহারাজ’ ডাকা হয়।
ভাষা ছাড়া, বিবিদিষানন্দের কোনও চিহ্ন আদৌ আছে একুশ শতকের এই উত্তরাখণ্ডে? আলমোড়া শহরে এক সন্ধ্যায় খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছানো গেল লালাবাজার। সরু পাহাড়ি গলিপথ, একের পর এক বাজার। একটা চত্বর জামাকাপড়ের, সেটা পেরিয়ে হাঁটতে থাকলে মশলাপাতির দোকান। সেই গলিতে একটা বাড়ির গায়ে ছোট্ট পাথরের ফলক। ল্যাম্পপোস্টের বিবর্ণ আলোতেও পড়া যাচ্ছে লেখাটা, ‘লালা বদ্রীদাস হাউস। হিয়ার লিভ্ড স্বামী বিবেকানন্দ।’

(চলবে)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.