মন্ত্রীদের কাজকর্মে ‘সন্তুষ্ট’ না হলে তিনি যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী দফতর বদলাতে দ্বিধা করবেন না, সেই ‘বার্র্তা’ আবার দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজ্য মন্ত্রিসভার প্রবীণ সদস্য সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। ওই দফতরের মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহকে পরিসংখ্যান ও পরিকল্পনা রূপায়ণ দফতরে পাঠানো হয়েছে। মমতার ওই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে মহাকরণের একাংশের বক্তব্য, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বলছিল, চন্দ্রনাথবাবুর ‘পারফরম্যান্সে’ খুশি নন মুখ্যমন্ত্রী। তাই তাঁর জায়গায় সুব্রতবাবুকে নিয়ে এলেন তিনি। মমতা নিজে অবশ্য সোমবার জানিয়েছেন, পরিসংখ্যান বিষয়ক একটি আলাদা দফতরে ‘গুরুত্ব’ দিয়েই চন্দ্রনাথবাবুকে পাঠানো হল।
এ দিন মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, “মঙ্গলবার থেকে সুব্রত মুখোপাধ্যায় জনস্বাস্থ্য ও কারিগরির পাশাপাশি পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরও সামলাবেন। পঞ্চায়েতমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ পরিসংখ্যান ও পরিকল্পনা রূপায়ণ দফতরের দায়িত্ব পাচ্ছেন। পরিসংখ্যান বিষয়ক পৃথক দফতর তৈরির জন্য দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে অনুরোধ আসছিল। আগের সরকার গুরুত্ব দেয়নি। আমরা আলাদা দফতর গড়ে চন্দ্রনাথবাবুকে তার ভার দিলাম।”
সুব্রতবাবুকে কেন পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের ভার দেওয়া হল, তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ এ দিন যা বলেছেন, তার মোদ্দা কথা২০১৩ সালের মাঝামাঝি পঞ্চায়েত নির্বাচন হওয়ার কথা। ২০০৮ সালে যে পঞ্চায়েত ভোট দিয়ে রাজ্যে মমতার নেতৃত্বে তৃণমূলের ‘জয়যাত্রা’ শুরু হয়েছিল, পাঁচ বছর বাদে আবার সেই নির্বাচন। এবং ক্ষমতায় আসার পর পঞ্চায়েত ভোটই হতে চলেছে তৃণমূলের প্রথম বড় পরীক্ষা। স্বভাবতই পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়নে ‘বাড়তি জোর’ দিতে চান মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূল সূত্রের আরও খবর, ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোট আগামী বছরের শেষাশেষি করে ফেলতে চান মুখ্যমন্ত্রী। ফলে আপাতত তাঁর হাতে মাত্র একটা বছর। তার মধ্যেই ‘কাজ’ করে দেখাতে হবে।
কিন্তু তথ্য বলছে, প্রথমত, অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় এখনও এ রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন গ্রামীণ প্রকল্প রূপায়ণে পিছিয়ে। ১০০ দিনের কাজ, ইন্দিরা আবাস যোজনা বা প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার মতো প্রকল্পগুলির সুবিধা থেকে এখনও অনেক মানুষ বঞ্চিত। দ্বিতীয়ত, ধান-পাটের সহায়ক মূল্য সহ বিভিন্ন ‘কৃষক-কেন্দ্রিক’ প্রশ্নে ইতিমধ্যেই রাস্তায় নেমে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিরোধীরা। আগামী ৪ জানুয়ারি ওই প্রশ্নে বামেরা গ্রাম বাংলা বন্ধ ডেকেছে। সরকারের জোটশরিক কংগ্রেসও ওই নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে। গ্রামের ভোট বিপুলভাবে পেয়ে মমতার ক্ষমতায় আসা। ফলে ‘কৃষক-স্বার্থে’ সে দিকে তাঁকে দ্রুত নজর দিতেই হবে। একই সঙ্গে গ্রামোন্নয়ন প্রকল্পগুলির ‘সুফল’ শাসক হিসেবে পৌঁছে দিতে হবে মানুষের কাছে।
তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “পঞ্চায়েত ভোটের আগে সে কাজ সেরে ফেলে তার ‘সাফল্য’ তুলে ধরেই গ্রাম-গঞ্জে ভোট চাইতে যেতে হবে নতুন সরকারকে।” ফলে কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলি রূপায়ণ ও এই সময়ের মধ্যে পঞ্চায়েত দফতরের কাজ ‘বাড়তি তৎপরতা’র সঙ্গে পরিচালনার জন্য এক জন ‘অভিজ্ঞ’ মন্ত্রীর প্রয়োজন মুখ্যমন্ত্রীর। এবং সেই দায়িত্ব নেওয়ার মতো এই মন্ত্রিসভায় মমতার পাশাপাশি মন্ত্রিত্বের অভিজ্ঞতা রয়েছে সুব্রতবাবুর। রাজ্য মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যই একেবারে আনকোরা। সেই জন্যই পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরে সুব্রতবাবুকেই নিয়ে এলেন মুখ্যমন্ত্রী। নতুন দফতরে তাঁর দায়িত্ব ঘোষণার পর সুব্রতবাবু এ দিন বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী আমার উপর যে আস্থা রেখেছেন, তার যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করব।”
চন্দ্রনাথ সিংহ |
মাত্র ২৬ বছর বয়সে প্রথম বার ভোটে জিতে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হন সুব্রতবাবু। তার পর থেকে তিনি বহুবার বিধায়ক হয়েছেন। পাশাপাশি, ২০০০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তিনি কলকাতার মেয়র হিসেবে কাজ করেছিলেন। তখনও রাজ্যে বাম-জমানা। ক্ষমতায় সিপিএম। যাদের সঙ্গে তৃণমূলের চূড়ান্ত বৈরিতা। তা সত্ত্বেও সুব্রতবাবু তিনি ‘সফল’ প্রশাসক ছিলেন বলেই শহরবাসীর একাংশ এখনও মনে করেন। আর মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, সুব্রতবাবু জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরও যথেষ্ট ‘দক্ষতা’র সঙ্গে সামলাচ্ছেন। যার ভিত্তিতে তাঁর উপর ‘গুরুত্বপূর্ণ’ দফতরের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হল।
বস্তুত, গত শনিবারই সুব্রতবাবুকে নিয়ে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের সঙ্গে দেখা করে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা মৌখিক ভাবে জানিয়ে এসেছিলেন মমতা। তখনই ঠিক হয়, সোমবার মুখ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেবেন রাজ্যপালকে। এ দিন দুপুরে মহাকরণে ঢুকেই ওই ফাইলটি স্বাক্ষর করে রাজ্যপালের কাছে পাঠান মমতা। তারপর নিজেই বিষয়টি ঘোষণা করেন। তবে ফাইল সই-সাবুদ হওয়ার আগেই এ দিন সকালে পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠক সেরে ফেলেন সুব্রতবাবু।
মুখ্যমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মধ্যেই তাঁর ‘বার্তা’ দেখতে পাচ্ছে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক শিবির। মন্ত্রী ও আমলাদের নিয়ে সরকারের গত কয়েকটি পর্যালোচনা বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যেই চন্দ্রনাথবাবু সহ কয়েকজন মন্ত্রীর কাজকর্ম নিয়ে ‘অসন্তোষ’ প্রকাশ করেছিলেন। তার জেরেই মন্ত্রিসভার ভিতরে দফতর রদবদল হচ্ছে বলে প্রশাসনিক মহলের একাংশের বক্তব্য। এর আগেও কাজকর্মে ‘ক্ষুণ্ণ’ হয়ে রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে স্কুলশিক্ষা দফতর থেকে সরিয়ে কৃষি দফতরের ভার দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। স্কুলশিক্ষার অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে। প্রশাসনিক মহল মনে করছে, এ দিনের ঘোষণায় সেই সব মন্ত্রীর কাছেও আবার ‘বার্তা’ গেল, যাঁরা নিজেদের দফতরের কাজে এখনও ‘ঢিলেঢালা’। রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষকর্তার কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী বলতে চাইলেন, এখনও সময় আছে। দেখা যাক, সেটা কতটা ফল দেয়।” |