তুলোর স্তূপে আগুনে বিভ্রান্তি
গোপনে ধূমপানেই বিপর্যয়, বলছে তদন্ত
সিগারেটের টুকরো থেকে বেসমেন্টে রাখা তুলোর স্তূপে আগুন লেগেই আমরি (ঢাকুরিয়া) হাসপাতালে বিপত্তি ঘটেছিল বলে প্রাথমিক তদন্তের পরে কলকাতা পুলিশের ধারণা। এবং এর জন্য গোয়েন্দারা হাসপাতালের কয়েক জন কর্মীর ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’কেই প্রাথমিক ভাবে দায়ী করতে চলেছেন বলে লালবাজার-সূত্রে জানা গিয়েছে।
আমরি-র অগ্নিকাণ্ডের পরে এক সপ্তাহ ধরে তদন্ত চালিয়ে পুলিশ এখন মনে করছে, গত ৮ ডিসেম্বর রাতে হাসপাতালের বেসমেন্টে বায়োমেডিক্যাল স্টোর্সের পাশে রাখা তুলোর স্তূপে সিগারেটের টুকরো থেকেই আগুন লেগেছিল। তদন্তকারীরা এ-ও জানাচ্ছেন যে, হোসপাইপের জল দিয়ে কর্মীরা তা নেভানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পুলিশের বক্তব্য: তুলোর আগুন যে সহজে নেভে না, সে ধারণা ওই কর্মীদের ছিল না। তাই তুলোর ডাঁইয়ের উপর থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখেই তাঁরা ধরে নেন, আগুন নিভেছে। অথচ তুলোর নীচের স্তরে আগুন তখনও ধিকিধিকি জ্বলছিল। পরে যা বেসমেন্টে রাখা অন্যান্য দাহ্য বস্তুতে ছড়িয়ে পড়ে। কালো ধোঁয়া এসি ডাক্ট বেয়ে উঠে যায় উপরে, ঢুকে পড়ে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে। চেষ্টা করেও এই বিপর্যয় আর রোখা যায়নি বলে গোয়েন্দা-সূত্রের অনুমান।
এ দিকে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, হাসপাতালের বেসমেন্টে ‘স্মোক অ্যালার্ম’ ছিল। তা হলে ধূমপানের সময়ে এবং পরে আগুন লেগে ধোঁয়া উঠলে বিপদঘণ্টি বাজেনি কেন?
কলকাতা পুলিশের তদন্তকারী অফিসারদের ধারণা, বেসমেন্টে অনেক সময়েই কর্মীদের কেউ কেউ ধূমপান করতেন। মাঝে মধ্যে তাঁদের সঙ্গে কিছু চিকিৎসকও যোগ দিতেন। আর তা যাতে জানাজানি না হয়, সে জন্য ওই সময়ে অ্যালার্ম বন্ধ করে রাখা হতো বলে তদন্তকারীদের অনুমান। তাঁদের মতে, এই রেওয়াজই বিপর্যয় ডেকে এনেছে। সেই রাতে অ্যালার্ম ঠিক সময়ে বাজলে অনেক রোগীর প্রাণ বাঁচত বলে মন্তব্য করেছেন গোয়েন্দারা।
পাঁচিল তুলে বন্ধ দরজাই! অনেক বিধিভঙ্গের একটা। ঢাকুরিয়া আমরিতে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
কিন্তু বিপজ্জনক ওই তুলোর স্তূপ বেসমেন্টে রাখা ছিল কেন?
দমকল-সূত্রের বক্তব্য: ঢাকুরিয়া আমরি-র বেসমেন্টে ওষুধ ও চিকিৎসা-সামগ্রী ডাঁই করে রাখা নিয়ে তারা আগেই আপত্তি তুলেছিল। বিশেষত বেসমেন্ট থেকে তুলো সরানোর জন্য হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষকে তারা একাধিক বার সতর্ক করেছিল বলে দমকলের দাবি। দমকলের এক পদস্থ কর্তার কথায়, “তুলোয় আগুন লাগলে তা যে অল্প জলে নেভে না, এবং আগুন নেভা নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়, সে সম্পর্কেও আমরা ওদের হুঁশিয়ার করেছিলাম। সকলকেই করি। কারণ, তুলোর বিভিন্ন স্তরের মধ্যে বাতাস আটকে থাকে। জল তাতে পিছলে যায়। আগুন নীচে পৌঁছে গেলেও জল পৌঁছাতে পারে না। উপরের স্তরে ধোঁয়া দেখে মনে হয়, আগুন নিভে গিয়েছে।” লালবাজার-সূত্রের খবর, আমরি-র ক্ষেত্রে এই বিভ্রান্তিই ঘটেছে বলে দমকল-কর্তারা পুলিশকে জানিয়েছেন।
আগুনের সূত্রপাত যে সিগারেটের টুকরো থেকে, সেটা তদন্তকারীরা বুঝলেন কী করে?
পুলিশ ও ফরেন্সিক সূত্রের খবর: অগ্নিকাণ্ডের পরে নমুনা সংগ্রহের সময়ে ঘটনাস্থলে বেশ কয়েকটা পোড়া সিগারেটের টুকরো মিলেছিল। প্রাথমিক ভাবে গোয়েন্দাদের সন্দেহের উৎস সেখানেই। পরে বিভিন্ন লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁরা কর্মীদের ‘গোপন ধূমপানের’ কথা জানতে পারেন। লালবাজারের এক অফিসারের কথায়, “প্রাথমিক তদন্তে এটা প্রমাণিত যে, ঘটনার রাতেও ওখানে স্মোক অ্যালার্ম বন্ধ ছিল। কিন্তু গোয়েন্দারা ধরতে পারছিলেন না, ঠিক কখন সেটা বন্ধ করা হয়। সময়টা নির্দিষ্ট ভাবে জানতে পারলে ছবিটা স্পষ্ট হবে।” সেটা কখন জানা যাবে?
লালবাজারের খবর: কলকাতায় এ ধরনের যান্ত্রিক ব্যবস্থা পরীক্ষার সরকারি ব্যবস্থা নেই। তাই সেটি পরীক্ষা করতে হায়দরাবাদের সেন্ট্রাল ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি (সিএফএসএল)-র বিশেষজ্ঞদের ডাকা হয়েছিল। সিএফএসএলের রিপোর্টেই বোঝা যাবে, কখন, কী থেকে আগুন লেগেছিল এবং কখন ফায়ার অ্যলার্ম বন্ধ করা হয়েছিল।
তবে আগুন লাগার প্রায় দু’ঘণ্টা পরে কেন দমকলকে খবর দেওয়া হল, তা নিয়ে পুলিশের ধন্ধ কাটেনি। বেসমেন্টের আগুন আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ার পরেও রোগীদের কেন ভিতর থেকে বাইরে আসতে বাধা দেওয়া হল, কেনই বা হাসপাতালে রাত কাটানো রোগীর আত্মীয়দের ভিতরে যেতে দেওয়া হল না, সে সব প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজে চলেছে পুলিশ। গোয়েন্দারা মনে করছেন, হাসপাতালের উচ্চতর-কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জেনেও ব্যবস্থা নেননি। কে বা কারা আগুন লাগার পরে হাসপাতালের মূল ভবনের গেট বন্ধ করে রাখার নির্দেশ দিয়েছিল, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আগুন লাগার কারণ যাই হোক না কেন, ঢাকুরিয়া আমরি-র বেসমেন্টকে যে ভাবে ‘জতুগৃহ’ করে রাখা হয়েছিল, তার জন্য হাসপাতালের কর্তারাই দায়ী বলে মনে করছেন পুলিশকর্তারা। একই ভাবে বিধি ভেঙে হাসপাতাল নির্মাণ, রোগীদের বার করার জন্য নির্দিষ্ট পথ না-রাখা, কর্মীদের অগ্নি নির্বাপন প্রশিক্ষণ না-দেওয়া কিংবা দমকল-বিধি না-মানার জন্যও হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের দিকেই আঙুল তুলছে পুলিশ। তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, গত জুলাইয়ে ঢাকুরিয়া আমরি পরিদর্শন করে বেসমেন্ট পরিষ্কার করার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিল দমকল। ২৯ অগস্ট এ ব্যাপারে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষকে ৯০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। ২৯ নভেম্বর সে মেয়াদ পেরিয়ে গিয়েছে। তার পরেও নির্দেশ মানা হয়নি।
কিন্তু সময়সীমা ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও দমকল কেন ফের ওখানে পরিদর্শনে যায়নি?
পুলিশি তদন্তে এই প্রশ্নও উঠেছে। তদন্তকারী এক অফিসারের মন্তব্য, “যাঁদের যাঁদের গাফিলতি পাওয়া যাবে, তাঁদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড়া হবে না। এ ব্যাপারে মহাকরণ থেকে নির্দেশ এসেছে।”
আমরি-কাণ্ডে ইতিমধ্যে হাসপাতালের সাত ডিরেক্টরকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। যাঁদের এক জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গ্রেফতার করা হয়েছে হাসপাতালের এক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও এক ম্যানেজারকেও। শুক্রবার রাহুল তোদি, আদিত্যবর্ধন অগ্রবাল এবং প্রীতি সুরেখা নামে তিন আমরি-কর্তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। সেই মতো ওই তিন জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করবে কলকাতা পুলিশ। গোয়েন্দাদের সন্দেহ, ওঁরা কলকাতার বাইরে পালিয়ে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ‘লুক আউট’ নোটিসও জারি করা হতে পারে বলে লালবাজার সূত্রের খবর।

কী ভাবে ছড়াল আগুন
রাতে বেসমেন্টে ধূমপান চলছিল
বন্ধ করা ছিল স্মোক অ্যালার্ম
আধপোড়া সিগারেট কেউ ছুড়ে ফেলেন
সেটি গিয়ে পড়ে পাশে রাখা তুলোর স্তূপে
আগুন ছড়িয়ে পড়লে নেভানোর চেষ্টা হয়
আগুনের শিখা না-দেখে কর্মীরা নিশ্চিন্ত হন
আগুন কিন্তু ধিকিধিকি জ্বলছিলই
আগুন ছড়ায় বেসমেন্টের অন্যত্র
সেই আগুন আর নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি
এসি ডাক্ট দিয়ে ধোঁয়া উপরে উঠে যায়
তদন্তের অনুমান
জলে কেন নিভল না তুলোর আগুন
তুলো বা খড়ের গাদার আগুন ধিকিধিকি জ্বলে।
তুলোর বিভিন্ন স্তরে বাতাস আটকে থাকায় জল উপরের স্তরে লেগে পিছলে যায়, নীচের স্তরে পৌঁছতে পারে না।
উপরে ধোঁয়া দেখে আগুন নিভেছে মনে হলেও নীচের আগুন জ্বলতেই থাকে।
তুলোর আগুন তাই নেভাতে হয় খুব বেশি জল দিয়ে।
সূত্র: দমকল
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.