হুকিং রুখতে গিয়ে পুলিশের গুলি, হত ২
রণক্ষেত্র মগরাহাটে মৃত্যু বধূ-কিশোরীর
বিদ্যুতের দাম বাড়াতে দিচ্ছে না রাজ্য সরকার। পরামর্শ দিচ্ছে লোকসান কমানোর। সেই লক্ষ্যে হুকিং-বিরোধী অভিযানে নেমে প্রথম দিনেই ধাক্কা খেল বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা। যা নিয়ে গোলমালে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত বহু। এবং যার জেরে আপাতত বন্ধ হুকিং-বিরোধী অভিযানও।
বৃহস্পতিবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাটে প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার এই অভিযান। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশ ৫০ রাউন্ডের বেশি গুলি চালায়। গুলিতে সায়েবা বিবি (৩৫) নামে এক বধূ এবং রেজিনা খাতুন (১৪) নামে এক স্কুলছাত্রীর মৃত্যু হয়। যে প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “শুনেছি, দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। সেটা হয়ে থাকলে খুবই দুর্ভাগ্যজনক, দুঃখজনক এবং লজ্জাজনক। পুলিশ আরও একটু সাবধান হলে ভাল হত।” মৃত্যুর কথা রাতে জেলাশাসক নারায়ণস্বরূপ নিগমও মেনে নেন। তবে কী ভাবে মৃত্যু, তা তিনি বলেননি। তবে ডায়মন্ড হারবার মহকুমা হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই বধূর মাথায় গুলি লেগেছে। ছাত্রীটির মাথায় ও গলায় গুলি লেগেছে। অনেক টানাপোড়েনের পরে পুলিশ মৃতদেহ দু’টি নিজেদের হেফাজতে নিতে পেরেছে। পুলিশের অবশ্য দাবি, শূন্যে গুলি চালানো হয়েছিল।
স্থানীয়দের আরও অভিযোগ, জব্বর নাইয়া নামে এক কিশোরের পেটেও গুলি লাগে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় জব্বরকে কলকাতায় চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলেও খবর। এ ছাড়াও আরও কয়েক জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। উল্টো দিকে পুলিশের অভিযোগ, গ্রামবাসীদের হাতে আক্রান্ত হন বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার কর্মী-ইঞ্জিনিয়ার এবং পুলিশকর্মীরাও। সংঘর্ষে মগরাহাটের ওসি-সহ ১৬ জন পুলিশ জখম হয়েছেন।
নিহত সায়েবা বিবি। ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালে।
এই ঘটনায় কিন্তু গ্রামবাসীদের দোষ দিচ্ছেন না মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “গ্রামবাসীদের দোষ দিচ্ছি না। তাঁদের উত্তেজিত করার পিছনে আমার বিরোধী বন্ধুদের প্ররোচনা থাকতে পারে। তবে, বোমা না গুলি কীসে মৃত্যু হয়েছে, তা তদন্ত না করে এখনই বলা সম্ভব নয়।” একই সঙ্গে তাঁর আশ্বাস, পুলিশের কেউ দোষী হলে সরকার তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। আবার মমতা এ-ও বলেছেন, “পুলিশকে আটকে রাখার অধিকার কারও নেই।” রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায় রাতেই এই ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেন। আইজি (দক্ষিণবঙ্গ)-এর নেতৃত্বে এই ঘটনার তদন্ত হবে বলে প্রশাসন সূত্রের খবর।
এই গুলিচালনার ঘটনা এবং তার পরে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য ঘিরে স্বাভাবিক ভাবেই রাজ্য রাজনীতি এখন উত্তাল। স্থানীয় ভাবে আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যা মেটানো যেত বলে উল্লেখ করে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে বিরোধীদের উস্কানির অভিযোগ করেছেন, তা অত্যন্ত অনুচিত কাজ হয়েছে।” শুক্রবার কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় এবং আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার নেতৃত্বে সিপিএমের একটি প্রতিনিধি দল এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছে। একই ভাবে দল পাঠাচ্ছে শাসক তৃণমূলও। মুকুল রায়ের নেতৃত্বে এই দলে অন্যদের সঙ্গে থাকবেন দলের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায়ও। মৃত্যুর ঘটনার সমালোচনা শোনা গিয়েছে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের মুখেও। প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, “সরকারের পরিবর্তন হলেও ট্রিগার হ্যাপি পুলিশের পরিবর্তন হয়নি।” শুক্রবার এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছে জেলা কংগ্রেসের একটি দল। তারা এসে রিপোর্ট দিলে রাজ্য প্রতিনিধি দল যাবে।
রাজনৈতিক ভাবে যখন সব স্তরেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে, তখন পুলিশ, বিদ্যুৎকর্মী এবং গ্রামবাসী, সব পক্ষকেই এখন সংযত থাকতে অনুরোধ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। আপাতত হুকিং-বিরোধী অভিযান বন্ধ করার নির্দেশও তিনি দিয়েছেন। তিনি বলেন, “যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের জন্য যা যা করণীয়, রাজ্য সরকার অবশ্যই করবে।” গ্রামবাসীদের কাছে তাঁর আবেদন, যাঁদের বিদ্যুতের সংযোগ দরকার, আবেদন করুন। তিনি নিজে ব্যবস্থা করবেন। ঘটনাটি তাঁকে কেন প্রথম থেকে জানানো হল না, সেই প্রশ্ন তুলে ক্ষোভপ্রকাশও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, “আমি মহাকরণেই ছিলাম। আগে জানতে পারলে অন্য ভাবে সমাধান করতাম।”
বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে, বিদ্যুৎ চুরির জন্য প্রতি বছর সংস্থার কোটি-কোটি টাকা লোকসান হয়। মুখ্যমন্ত্রীও বলেন, “আগের সরকারের ভুলে শুধু বিদ্যুৎ খাতেই ২২০০ কোটি টাকার বোঝা এই সরকারের ঘাড়ে চেপে বসেছে।” বৃহস্পতিবার থেকে রাজ্য জুড়ে বিদ্যুৎ চুরি ঠেকাতে অভিযান শুরু হয়। এবং প্রথম অভিযানেই এই ঘটনা।
জখম পুলিশকর্মীরা।
বিদ্যুৎ দফতর এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মগরাহাটের মল্লিকপাড়া, নৈনান, হরিনারায়ণপুর-সহ কয়েকটি গ্রামের বহু বাড়ি-দোকানে হুকিং করে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। ফলে, বৈধ বিদ্যুৎ গ্রাহকরা বিদ্যুৎ পেতে সমস্যায় পড়ছেন। স্থানীয় বিদ্যুৎ কর্তাদের অভিজ্ঞতা, মগরাহাট, ক্যানিং অঞ্চলে ১০০ ইউনিট বিদ্যুৎ লাইনে দেওয়া হলে ৬৫ ইউনিটই চুরি হয়ে যায়। দিন কয়েক আগে বণ্টন সংস্থার মগরাহাট শাখা থেকে বিদ্যুৎ চুরি বন্ধের জন্য মাইকে প্রচার করা হয়। ঘোষণা করা হয়, ৩২০ টাকা দফতরে জমা দিলেই বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু তার পরেও বিদ্যুৎ চুরি বন্ধ হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীও এ দিন জানান, এলাকায় মাইকে প্রচার করা হয়েছিল। তবে তাঁর বক্তব্য, “মাইকে প্রচারের সুবিধা আছে। অসুবিধাও আছে। গ্রামবাসীদের যেমন সচেতন করা যায়, তেমনই কিছু লোক আগাম পরিকল্পনা করার সুযোগও পেয়ে যায়।”
বৃহস্পতিবার মগরাহাটে কী ঘটেছে?
বণ্টন সংস্থার বারুইপুরের ডিভিশনাল ম্যানেজার শুভ্রেন্দু সরকার জানিয়েছেন, নৈনানের দু’টি ট্রান্সফর্মার থেকে হুকিং করে বিদ্যুৎ চুরি করা হচ্ছে। এই অভিযোগ পেয়ে এ দিন দফতরের ৬ জন ইঞ্জিনিয়ার এবং ১০ জন কর্মী অভিযানে গিয়েছিলেন। ট্রান্সফর্মার থেকে ওই অবৈধ লাইন কাটতে গেলেই হাজারখানেক গ্রামবাসী বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। ইট, পাথর, বোতল, লাঠি, ইট, বোমা নিয়ে তাঁরা চড়াও হন বিদ্যুৎকর্মীদের উপরে। তিনটি গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। ইটের আঘাতে বণ্টন সংস্থার এক ইঞ্জিনিয়ার এবং দুই কর্মী আহত হন। তাঁদের বারুইপুর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় বলে সংস্থা সূত্রে খবর। সঙ্গে ৩৫ জন পুলিশও ছিলেন। যাঁদের মধ্যে ৮ জন মহিলা-পুলিশ।
পুলিশের দাবি, ওই গোলমাল থামাতে গিয়ে আক্রান্ত হয় পুলিশও। তাদের দু’টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ফের পুলিশ বাহিনী যাতে আসতে না পারে, সে জন্য রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ করেন বাসিন্দারা। কিন্তু পরে সংলগ্ন চারটি থানা থেকে বিশাল বাহিনী আসে। জনতা তাদের উপরেও চড়াও হয়। শুরু হয় জনতা-পুলিশ খণ্ডযুদ্ধ। পুলিশকে লক্ষ করে ইট, বোমা ছোড়া হয়। জখম হন মগরাহাট থানার ওসি আশিস দাস-সহ ১৬ জন পুলিশকর্মী। পুলিশ পাল্টা লাঠি চালায়, রবার-বুলেট এবং কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, পুলিশ তাঁদের লক্ষ করে গুলিও ছোড়ে। সেই গুলিতেই নৈনানের বাসিন্দা রেজিনা ও সায়রা বিবির মৃত্যু হয়। জনা ছয়েক জখম হন।
শেষ পর্যন্ত লাইন কাটার কাজ ফেলে রেখেই ফিরতে হয় বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার কর্মীদের। পুলিশের একটি গাড়ির খোঁজ মেলেনি। রাতেই ঘটনাস্থলে পৌঁছন পুলিশ সুপার লক্ষ্মীনারায়ণ মিনা এবং জেলাশাসক নিগম। জখম পুলিশদের ডায়মন্ড হারবার মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। রাতে এলাকায় নামে র্যাফ ও বিশাল পুলিশ বাহিনী।

নিজস্ব চিত্র



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.