ভাঁড়ারের করুণ দশা। প্রতিদিনের কাজ চালাতেই হিমশিম। এই অবস্থায় বুধবার সুরক্ষা নিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে মুখোমুখি বিশেষ বৈঠকে টাকার দাবিতে সরব হলেন রেলের বিভিন্ন জোনের জেনারেল ম্যানেজারেরা। তাঁদের এক জন বৈঠকে মন্ত্রীকে শুনিয়েও দেন সে কথা। তাঁর কথায়, “যাত্রী নিরাপত্তা ও সুরক্ষা খাতে আমাদের টাকা দিন। না হলে যে কোনও দিন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।” মন্ত্রক সূত্রের খবর, একটা সময় রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী বলেই দেন, “সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হলে ট্রেন চালাতে হবে না। ঝুঁকি নিয়ে চালানোর থেকে ট্রেন বন্ধ রাখা হোক।” পরে অবশ্য জিএম-দের আশ্বস্ত করে দীনেশ বলেন, “নিরাপত্তা প্রশ্নে আপনারা ঠিক টাকা পেয়ে যাবেন। চিন্তা করবেন না।”
আট বছর ধরে ভাড়া বৃদ্ধি না হওয়া, বেতন-পেনশনের ঊর্ধ্বমুখী খরচ, আয়ের বিকল্প রাস্তা খুঁজে না পাওয়া, পিপিপি মডেলের ব্যর্থতা নানবিধ কারণেই গত কয়েক বছর ধরে রেলের ভাঁড়ারে টান পড়ছিল। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে, ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশ মেনে বর্ধিত বেতন ও পেনশন, যে খাতে রেলের প্রতি বছর ১৬ হাজার কোটি টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছে, যাতে প্রতিটি
জোনে নিয়মমাফিক রক্ষণাবেক্ষণের কাজে টাকা দিতেই হিমশিম খাচ্ছে রেল মন্ত্রক। ফলে আটকে যাচ্ছে ট্র্যাক, সেতু মেরামতি বা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ। এক কথায় রেলের আর্থিক বেহাল অবস্থার প্রভাব এখন পড়তে শুরু করেছে যাত্রী নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও।
বাধ্য হয়েই গত কাল রেলমন্ত্রীর সামনে মুখ খোলেন জিএম-রা। মন্ত্রক জানিয়েছে, বৈঠকে দীনেশ জানিয়ে দেন, নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনও আপস নয়। পরিস্থিতি গুরুতর হলে তিনি প্রথমে ট্রেন বন্ধ করে দেওয়ার কথা বললেও
পরে অবশ্য ‘যে ভাবে হোক নিরাপত্তা সংক্রান্ত খাতে দ্রুত টাকা জোগাড় করে দেওয়ার’ আশ্বাস দেন। দীনেশের বক্তব্য, “যাত্রী নিরাপত্তা নিয়ে কোনও ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।”
ক’দিন আগেই রেল প্রতিমন্ত্রী কে মুনিয়াপ্পা জানিয়েছেন, আপাতত রেলের ভাড়া বাড়ছে না। অথচ মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী, রেলকে ঠিক মতো চালাতে গেলে ২০০৪ সালের তুলনায় অন্তত ৮৮ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়া উচিত। কিন্তু রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে সে কাজ করতেই পারছে না রেল মন্ত্রক।
এই পরিস্থিতিতে রেলের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য অর্থের জোগান দিতে মন্ত্রকের অধীনস্থ ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফিনান্স কর্পোরেশন (আইআরএফসি) বাজারে বন্ড ছাড়তে চলেছে। ঠিক হয়েছে, বন্ড ছেড়ে বাজার থেকে দশ হাজার কোটি টাকা তোলা হবে। লক্ষ্য রেলের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটানো, নতুন রেক কেনা, মেরামতি-রক্ষণাবেক্ষণ-সহ চলতি প্রকল্পের কাজে গতি আনা। এ ছাড়াও, রেল বিকাশ নিগম লিমিটেড (আরভিএনএল)-এর অধীনে রেলের যে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলি রয়েছে, সেগুলির রূপায়ণে ওই টাকা ব্যবহার করা হবে। প্রসঙ্গত, কলকাতার নতুন চারটি মেট্রো-সহ রাজ্যের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলি রূপায়ণের দায়িত্ব রয়েছে আরভিএনএল-এর হাতে। মন্ত্রকের একটি সূত্র জানিয়েছে, বন্ড ছেড়ে পাওয়া দশ হাজার কোটি টাকার একটি বড় অংশই খরচ হবে বাংলার রেল প্রকল্পগুলির জন্য। ঠিক হয়েছে, বছরের শেষ দিকে অথবা নতুন বছরের গোড়ায় ওই আয়কর মুক্ত বন্ড বাজারে ছাড়বে রেল মন্ত্রক।
কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক ছাড়পত্র দেওয়ার পরে মন্ত্রক বন্ড ছাড়া নিয়ে ‘আইআরএফসি’ অধিকর্তার নেতৃত্বে দু’টি কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে কমিটি ওই বন্ড ছাড়ার বিষয়ে আর্থিক ও আইনি দিকগুলি খতিয়ে দেখবে। দীনেশের আমলে বন্ড ছেড়ে টাকা তোলার সিদ্ধান্ত হলেও ওই রাস্তা দেখিয়েছেন প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতার পেশ করা এ বছরের বাজেট নথি বলছে, চলতি আর্থিক বছরে (২০১১-১২) আইআরএফসি বাজার থেকে ২০,৫৯৪ কোটি টাকা তুলবে। যে টাকার মধ্যে দশ হাজার কোটি টাকা তোলা হবে আয়কর মুক্ত বন্ডের মাধ্যমে। মমতা গত রেল বাজেটে নিত্যযাত্রীদের জন্য যে ৫০টি নতুন ট্রেনের ঘোষণা করেছিলেন, সেগুলির জন্য রেক কেনা ছাড়াও কাঁচরাপাড়া ওয়ার্কশপের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন, পুরনো রেকের মেরামতি ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আসবে ওই বন্ডের মাধ্যমে। অর্থের একাংশ ব্যবহার করা হবে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ক্ষেত্রগুলিতেও। |