ঘুমের বৈজ্ঞানিক রহস্যটা এত দিনে বোধহয় খুঁজে পেলেন বিজ্ঞানীরা! আর বস্টনে বসে সে রহস্যের সমাধান করলেন এক প্রবাসী বাঙালি। নাম সুবিমল দত্ত।
মস্তিষ্কের কোন অঞ্চলটি ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে তা বিজ্ঞানীদের জানা হয়ে গিয়েছে বহু দিন আগেই। সেই অঞ্চলের নাম পেডিংকুলোপন্টাইন টেগমেন্টাম নিউক্লিয়াস (পিপিটি)। কিন্তু কীভাবে মস্তিষ্কের ওই কোষগুলি ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে তা রহস্যই থেকে গিয়েছিল। তবে এর পিছনে যে কোনও রাসায়নিক রয়েছে সে ব্যাপারে স্নায়ুবিদরা নিশ্চিত ছিলেন। কারণ, যে কোনও স্নায়বিক উদ্দীপনা বাহিত হয় রাসায়নিক পদার্থ (নিউরোট্রান্সমিটার)-এর মাধম্যেই। ঘুমের ক্ষেত্রে ওই রাসায়নিকের স্বরূপটা কী সেটা এত দিন ছিল একটা রহস্য। আমেরিকার বস্টন ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের এক দল গবেষকের দাবি, তাঁরা ওই রহস্য উন্মোচিত করেছেন। আর এই ঘুম-গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন এক বাঙালি, বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘুম ও স্নায়ুবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সুবিমল দত্ত।
|
সুবিমল দত্ত |
‘দ্য জার্নাল অব নিউরোসায়েন্স’-এর ২৩ নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত তাঁদের গবেষণাপত্রে বস্টন ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের গবেষকেরা দাবি করেছেন, মস্তিষ্কের পিপিটি-র স্নায়ুকোষে থাকা রাসায়নিক পদার্থ ক্যালসিয়াম/ক্যালমোডুলিন কাইনেজই হল সেই রাসায়নিক, যা ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে। গবেষকেরা জানাচ্ছেন, ওই রাসায়নিকটি আসলে একটি উৎসচেক। ঘুমের সঙ্গে যার সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক। অর্থাৎ উৎসেচকটি সক্রিয় হলে ঘুম ভেঙে যায়। আর সেটি অপেক্ষাকৃত নিষ্ক্রিয় হয়ে এলে ঘুম এসে যায়। গবেষকদের দাবি, ওই উৎসেচকটি মস্তিষ্কের অন্য অনেক কোষেই থাকে। পিপিটিতেও তার উপস্থিতি আগেই জানা গিয়েছিল। কিন্তু ঘুমের নিয়ন্ত্রক যে ওই উৎসেচকই তা তাঁরা প্রমাণ করেছেন বলে বস্টনের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের দাবি। তাঁদের আশা, ওই উৎসেচকটিকে রাসায়নিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অনিদ্রা রোগ থেকে মুক্তি পাবেন বহু মানুষ।
ঘুমের রহস্যটা যে আসলে কী তা সমাধানের জন্য স্নায়ুবিদরা চেষ্টা চালাচ্ছেন বহুদিন ধরেই। এ দিকে রহস্য উন্মোচিত না হওয়ায় অনিদ্রা রোগ ঠেকাতে নানা ধরনের ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে রোগীদের। স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, যে কোনও ধরনের ঘুমের ওষুধ দীর্ঘদিন ধরে খেলে শরীরে তার কুপ্রভাব পড়ে। অধিক ঘুমের ওষুধ খাওয়ায় অনেকে পঙ্গু হয়ে পড়ছেন। মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে অনেকের। আবার এই রোগ ডায়াবেটিস, মানসিক অস্থিরতা এবং হৃদ্পিণ্ডের দুর্বলতাও বাড়িয়ে দেয় বলেও দাবি স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞদের। এই অবস্থায় ক্যালসিয়াম/ক্যালমোডুলিন কাইনেজ আশার আলো দেখাচ্ছে বলে মনে করেছেন গবেষক দলের প্রধান সুবিমলবাবু।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সুবিমলবাবু বলেন, “আমাদের গবেষণার সূত্র ধরে অনিদ্রা এবং সংশ্লিষ্ট শারীরিক সমস্যা থেকে পাকাপাকি ভাবে মুক্তি পাওয়ার উপায় পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।” তাঁদের গবেষণার গুরুত্ব কতটা? সুবিমলবাবুর ব্যাখ্যা, “ঘুম নিয়ে অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং গবেষণাগারে কাজ চলছে। কোনও একটা রাসায়নিক উদ্দীপক যে ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে তা বলছিলেন সবাই। ওই উদ্দীপকের স্বরূপটা খুঁজে বের করার চেষ্টাও করছেন। আমরা সেই লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছনোর চেষ্টা করেছি।”
প্রবাসী বাঙালি বিজ্ঞানী বলেন, “ঘুম কার কেমন হবে তা অনেকটাই নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজকর্মের মধ্যে কতটা ভারসাম্য রয়েছে তার উপরে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং মানসিক গঠনের উপরে। মস্তিষ্কের পেডিংকুলোপন্টাইন টেগমেন্টাম (পিপিটি) নামে একটি নিউক্লিয়াস ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু কোন রাসায়ানিক পদার্থটি পিপিটি-র কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে তা আমরা দেখতে চাইছিলাম।”
সুবিমলবাবু যেখানে স্নায়ুবিদ্যার প্রথম পাঠ নিয়েছেন সেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিদ্যার অধ্যাপক তুষার ঘোষ বলেন, “ক্যালসিয়াম/ক্যালমোডুলিন কাইনেজ যে একটি নিউরোট্রান্সমিটার তা ২০ বছর আগেই প্রমাণিত হয়েছে। স্মৃতিশক্তি নিয়ন্ত্রণে এর একটা বড় ভূমিকা আছে। তবে ঘুমও যে ওই রাসায়নিকটি নিয়ন্ত্রণ করে সেটা জানা ছিল না। ঘুম নিয়ে গবেষণায় বস্টনের বিজ্ঞানীরা নতুন একটা দিগন্ত খুলে দিলেন। ভবিষ্যতের গবেষকদের কাছে গবেষণার অন্য দিক খুলে গেল।” ওই উৎসেচকটি যে ঘুমের নিয়ন্ত্রক রাসায়নিক তা বোঝা গেল কী ভাবে? গবেষণাপত্রে সুবিমলবাবুরা বলেছেন, “কে এন ৯০ নামে একটি এমন রাসায়নিক পদার্থ (ইনহিবিটর) যা উৎসেচকটিকে নিষ্ক্রিয় করে। জেগে থাকা ইঁদুরের মস্তিষ্কের পিপিটি-র কোষগুলিতে আমরা কে এন ৯০ প্রয়োগ করে দেখেছি তারা ঘুমিয়ে পড়ছে। আবার ওই ইনহিবিটরের প্রতিক্রিয়া শেষ হওয়া মাত্রই দেখা যাচ্ছে উৎসেচকটি সক্রিয় হয়ে পড়ছে। ঘুমন্ত ইঁদুর জেগে উঠছে।” দিনের বিভিন্ন সময়ে ইনহিবিটরের পরিমাণ বাড়িয়ে কমিয়ে পরীক্ষা চালান গবেষকেরা। সুবিমলবাবুদের দাবি, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁরা একই ফল পেয়েছেন। আর তা থেকেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, ঘুমের সঙ্গে ক্যালসিয়াম/ক্যালমোডুলিন কাইনেজর একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। |