বিজ্ঞান ও প্রজুক্তি: বিতর্কে ইন্ধন কুরি-পৌত্রের
চাঁদে পা না ক্যানসারের ওষুধ
আবিষ্কার, কোনটি বড় সাফল্য

ত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে প্রশ্নটার সামনে দাঁড়িয়েছিল নায়ক সিদ্ধার্থ। চাকরিপ্রার্থী বেকার যুবকটির কাছে ইন্টারভিউ বোর্ড জানতে চেয়েছিল: মানুষের সবচেয়ে বিস্ময়কর সাফল্য কী?
চিন্তার জগতে নিজের অবস্থান ঘোষণা করতে ১৯৭১ সালে সত্যজিতের নায়ক জবাব দিয়েছিল: ভিয়েতনামে আমেরিকান সেনার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই।
অবাক ও বিরক্ত ইন্টারভিউ বোর্ড ছুড়েছিল পাল্টা প্রশ্ন: মানুষের চাঁদে পৌঁছানো নয়?
“না” জবাব দিয়েছিল সিদ্ধার্থ। তার যুক্তি, “সেটা অনুমান করা গিয়েছিল। কিন্তু ভিয়েতনামের হতদরিদ্র, অশিক্ষিত মানুষগুলো যে পেন্টাগনের পেশীশক্তির সঙ্গে পাঞ্জা কষবে, ভাবা যায়নি।”
ঠিক চার দশক পরে ফিরে এসেছে প্রশ্নটা— মানুষের চন্দ্রবিজয় ঠিক কত বড় সাফল্য? যার মাধ্যমে বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন এক বিজ্ঞানী। পিয়ের জোলিও। জন্মসূত্রে যিনি দুই নোবেলজয়ী মাদাম ও পিয়ের কুরি’র নাতি। আইরিন ও ফ্রেডরিক কুরি’র সন্তান অশীতিপর এই বিজ্ঞানী কলকাতায় এসেছিলেন সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের এক সেমিনারে। আন্তর্জাতিক রসায়নবিদ্যাবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনাচক্রটিতে তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘অতীত ও বর্তমানের গবেষণা।’
আর সেখানেই তাঁর ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য। আধুনিক গবেষণা বড় বেশি রাজনীতি-নির্ভর এটা বোঝাতে গিয়ে জোলিও বলেন, “গবেষণার মূল্য বিচার করাটা রাজনীতিবিদদের কাজ নয়।” ষাটের দশকে আমেরিকার চন্দ্রাভিযানের দৃষ্টান্ত টেনে তাঁর বক্তব্য, “তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তাঁর দেশের নাগরিককে চাঁদে পাঠিয়ে বলেছিলেন, এ অকল্পনীয় সাফল্য।” জোলিও-র প্রশ্ন, “সত্যিই কি তা-ই? কোন কাজটা বড়? চাঁদে মানুষ পাঠানো, নাকি ক্যানসারের ওষুধ আবিষ্কার?”

পিয়ের জোলিও
এবং এর পরেই তাঁর মন্তব্য, “আসলে রাজনীতিকের কাছে অগ্রাধিকার পায় রাজনৈতিক লক্ষ্য।” রুশ-মার্কিন ‘ঠান্ডা লড়াই’-এর দিকে আঙুল তুলে ফরাসি বিজ্ঞানীর অভিযোগ: সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে ‘স্পুটনিক’ পাঠানোয় আমেরিকার আঁতে ঘা লেগেছিল। পাল্টা জবাব দিতেই চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছিল তারা।
অতএব, চাঁদ না ক্যানসার? কোনটা জয় করা বড় সাফল্য? জোলিও-র মন্তব্য ঘিরে নানা বিজ্ঞানীর নানান ভাবনা।
সাহা ইনস্টিটিউটের জীব-বিজ্ঞানী অভিজিৎ চক্রবর্তীর কথায়, “জোলিও ঠিক বলেছেন। আর্মস্ট্রংদের চাঁদে নামা কঠিন ছিল বটে, তবে অভাবনীয় সাফল্য নয়। মানুষ জানত, কী ভাবে যাওয়া যেতে পারে। শুধু কারিগরিটা জানা ছিল না। বহু ব্যয়ে তা মিলেছিল। কিন্তু ক্যানসারের ওষুধ? তার খোঁজ পাওয়া যে কি কঠিন, গবেষকেরা টের পাচ্ছেন। কারিগরির নয়, মৌল বিজ্ঞানের কোন পর্যায়ে পৌঁছালে তা মিলবে, এখনও বোঝা যাচ্ছে না।”
তবে পরমাণু শক্তি কমিশনের ‘হোমি ভাবা’ অধ্যাপক বিকাশ সিংহ জোলিও-র বক্তব্যে কিঞ্চিৎ বিস্মিত। পরিহাসভরে তাঁর মন্তব্য, “এ বোধহয় চিরন্তন ফরাসি মানসিকতারই প্রকাশ!” কেন?
বিকাশবাবুর ব্যাখ্যা, “মাদাম কুরির দেশের লোক বরাবর কর্মের চেয়ে চিন্তাকে বেশি মূল্য দিয়েছে। যেন তাত্ত্বিক গবেষণা ফলিতচর্চার চেয়ে বেশি কদরের যোগ্য! যে হেতু চন্দ্রবিজয়ের পিছনে মৌল গবেষণার তুলনায় প্রযুক্তির সাফল্য বেশি, তাই জোলিও-র মনে হয়েছে, একে ততটা গুরুত্ব না দিলেও চলে! আমি মানি না।”
‘চাঁদ বনাম ক্যানসার’ বিতর্কে জোলিও-র সঙ্গে একমত নন মুম্বইয়ে টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের বিজ্ঞানী নবকুমার মণ্ডলও। তাঁর সাফ কথা, “সন্দেহ নেই, ক্যানসারের ওষুধ পেলে মানুষের ভীষণ মঙ্গল হবে। তবে মহাকাশ অভিযানে মানুষের উপকার হয়নি, এটা মানি কী করে? দূর-যোগাযোগের এই যে অকল্পনীয় উন্নতি, ইলেকট্রনিক যন্ত্র ছোট হতে হতে আঙুলের আকারে এসে গেছে, এ সবই তো সম্ভব হল ষাটের দশকের ওই অভিযানেরই সূত্রে!”
কিন্তু বিজ্ঞান-গবেষণায় রাজনীতিকের ভূমিকা? এ ব্যাপারে জোলিও-র ‘তত্ত্ব’ নিয়ে ওঁরা কী বলছেন?
নবকুমারবাবু আদৌ মনে করেন না, রাজনীতিবিদেরা বিজ্ঞান গবেষণার লক্ষ্য নির্ধারণের অযোগ্য। বরং তাঁর যুক্তি, “এখন ব্যয়বহুল গবেষণায় সরকারি অনুদান লাগে। দেশের জনগণ যাঁদের ভোট দেন, সেই সরকার ওরফে রাজনীতিবিদেরা অনুদান অনুমোদন করেন। সুতরাং ওঁদের জনগণের আশা-আকাঙ্খার কথা মনে রাখতে হয়।” তাঁর আরও দাবি, “বিশ্বের কোথাও বিজ্ঞানীদের বাদ রেখে রাজনীতিকেরা অনুদান ঠিক করেন না। “ঠান্ডা লড়াইয়ের জেরেই রবার্ট কেনেডি চাঁদে মানুষ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সিদ্ধান্তটা নিশ্চয় ওঁর একার ছিল না। সামিল হয়েছিলেন কিছু বিজ্ঞানীও।” বলছেন তিনি।
কলকাতায় ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টারের বিজ্ঞানী দীনেশ শ্রীবাস্তব কিন্তু রাজনীতি ও গবেষণা প্রসঙ্গে নবকুমারবাবুর সুরে সুর মেলাননি। তাঁর কথায়, “রাজনীতিকেরা জনগণের আশা-আকঙ্খা ঠিকঠাক তুলে ধরেন কি না, বলতে পারব না। সুতরাং ওঁদের গবেষণা-অনুদান নির্ধারণ সম্পর্কেও মন্তব্য করব না।” কিন্তু ‘চাঁদ বনাম ক্যানসার’ বিতর্কে দীনেশের জোলিও-বিরোধিতার সুর বেশ চড়া “মহাকাশ গবেষণার ফলে প্রযুক্তির যে অসংখ্য সুফল, সেগুলোকে অবজ্ঞা করা মানে বিজ্ঞানের আশীর্বাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। ভারতের মহাকাশচর্চা শুধু ক্ষেপণাস্ত্রের কথা মাথায় রেখে এমন যাঁরা বলেন, তাঁরা না-জেনে বলেন।”
এই প্রসঙ্গে আর্মস্ট্রং-অলড্রিনের চাঁদে অবতরণের কথা তুলে এনেছেন দীনেশ। বলছেন, “অনেকেই জানেন না, কতখানি ঝুঁকি নিয়েছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানীরা। ওঁদের ফেরত না-আসার আশঙ্কা এতটাই ছিল যে, নিক্সন দু’টো টেলিভিশন-বক্তৃতা তৈরি রেখেছিলেন। একটা অভিযান সফল হলে দেবেন, অন্যটা ব্যর্থ হলে।” দীনেশ এ-ও জানাচ্ছেন, “না-দেওয়া বক্তৃতাটি আমি পড়েছি। ওতে নিক্সন বলতে চেয়েছিলেন, অভিযান ব্যর্থ হোক, তবু আশার আলো দেখুক মানুষ।”
জ্ঞান আহরণের লক্ষ্যে বিজ্ঞানের এই নির্ভীক অভিযানকে ছোট করে দেখতে মোটেই রাজি নন বিকাশ-দীনেশ-নবকুমারেরা।

সামনে এল ব্ল্যাক হোলের নয়া তথ্য
এই প্রথম ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানতে পারা গেল বলে দাবি করেছেন এক দল জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তাঁরা প্রথমে বেশ কয়েকটি দূরবীক্ষণ এবং উপগ্রহের মাধ্যমে পৃথিবী থেকে ‘সিগনাস এক্স-১’ ব্ল্যাকহোলটির দূরত্ব মাপেন। এই দূরত্বের সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন পদ্ধতিতে গণনা করে তাঁরা জানিয়েছেন, প্রায় ৬০ লক্ষ বছর আগে ব্ল্যাকহোলটির সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়াও ‘সিগনাস এক্স-১’-র ঘনত্ব এবং ওজনও বের করতে পেরেছেন বলে দাবি ওই বিজ্ঞানীদের। তাঁদের এই গবেষণা ‘অ্যাস্ট্রোফিজিকাল জার্নাল লেটারস’-নামের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে ৬ হাজার ৭০ আলোকবর্ষ দূরের ‘সিগনাস এক্স-১’ নিস্তড়িত। সামনের সব কিছু এমনকী আলো পর্যন্ত শুষে নেওয়ায় ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে এর আগে খুব কম তথ্যই পাওয়া গিয়েছে। ফলে ব্ল্যাকহোল বরাবরই বিজ্ঞানীদের কৌতুহলের বিষয়। ৬০ লক্ষ বছর আগের ‘সিগনাস এক্স-১’ সম্পর্কে এত তথ্য পাওয়ায় উচ্ছ্বসিত ‘হাভার্ড স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’-এর বিজ্ঞানীরা। মুখ্য গবেষক মার্ক রেড জানান, এই তথ্য থেকে ব্ল্যাক হোলের সৃষ্টির রহস্য উদ্ধার করা যাবে বলে আশাবাদী তিনি।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.