জোট ভাঙা ভাবনায় নেই
‘পরিণত’ তৃণমূল নেত্রীর
তটা গর্জন, ঠিক ততটা বর্ষণ এখন করবেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে চাপ সৃষ্টি করলেও এখনই ইউপিএ-র উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করার মতো চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত তিনি নিতে চান না।
তৃণমূল সূত্র বলছে, এটা হল লেনিনের এক কদম এগিয়ে দু’কদম পিছোনোর রণকৌশল। নরসিংহ রাওয়ের আমলে আবেগতাড়িত হয়ে মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন মমতা। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময়েও তিনি মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। সেটাও ছিল অনেকটাই চটজলদি সিদ্ধান্ত। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, এই প্রতিবর্ত ক্রিয়ার রাজনীতি এখন মমতা অনেকটাই বদলে ফেলেছেন। এখন তিনি অনেক বেশি পরিণত।
এই মুহূর্তে যদি কংগ্রেস-তৃণমূল গাঁটছড়া ছিন্ন হয়, তা হলে সিপিএম এবং বিজেপি আহ্লাদিত হবে। বস্তুত, সেই লক্ষ্যে আসরেও নেমে পড়েছে বিজেপি। মমতাকে কটাক্ষ করে দলের মুখপাত্র শাহনওয়াজ হুসেন আজ বলেছেন, “আমরা আশা করব, পেট্রোলের দাম বাড়ার পর মমতা তার বিরোধিতা করে যে সাহস দেখিয়েছিলেন, তাতে অনড় থাকবেন। মূল্যবৃদ্ধিতে তিনি এত উদ্বিগ্ন ছিলেন, কিন্তু রাতারাতি সেই উদ্বেগ কী করে উধাও হয়ে দেল, গোটা দেশ তা জানতে চায়। মমতার থেকে কড়া সিদ্ধান্তই আমরা প্রত্যাশা করি।”
কিন্তু ‘কড়া সিদ্ধান্ত’ নিলে মমতারই রাজনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনা। সুতরাং কংগ্রেসের সঙ্গে সংঘাত এবং সমন্বয় এই দু’টি নিয়েই এগোবেন মমতা। যাকে বলা যেতে পারে জোট রাজনীতির দ্বন্দ্ববাদ।
নরসিংহ রাও যখন প্রধানমন্ত্রী তখন সিপিএমের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ দাবি করে ধর্মতলায় ধর্নায় বসেছিলেন কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী মমতা। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ধর্নায় বসে পড়ায় রাও সরকার অস্বস্তিতে পড়ে। তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় তৃণমূল নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করেন, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রতিমন্ত্রী ভুবনেশ চতুর্বেদী প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে মমতাকে চিঠি পাঠাবেন। তাতে বলা হবে, প্রধানমন্ত্রী নিজে বিষয়টি নিয়ে খতিয়ে দেখবেন এবং যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সেই বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ভুবনেশের ফ্যাক্স পৌঁছে গেল কলকাতায়। কিন্তু মমতা ধর্না প্রত্যাহার করলেন না। কারণ ওই চিঠিতে সিপিএমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুনির্দিষ্ট আশ্বাস ছিল না।
সে দিন মমতার আচরণে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন প্রণববাবু। কিন্তু মমতা আপস করতে রাজি হননি। তার পরের ইতিহাস সবার জানা। ব্রিগেডে সিপিএমের ‘মৃত্যুঘণ্টা’ বাজিয়ে মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন মমতা। পরের দিন সকালে দিল্লিতে মমতার ব্যক্তিগত সচিব প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে তাঁর পদত্যাগপত্র জমা দেন।
অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলেও মূল্যবৃদ্ধি থেকে শুরু করে তহলকা কাণ্ড বিভিন্ন বিষয়ে বারবার প্রতিবাদ জানিয়েছেন মমতা। যখন শেষ পর্যন্ত তিনি সরকার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন, তখন তৃণমূলের বেশ কিছু নেতা চেয়েছিলেন এমন কড়া সিদ্ধান্ত নেওয়া না হোক। কিন্তু সে দিনও মমতা আপস করেননি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মমতার অনেক বদল হয়েছে। তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, সাম্প্রদায়িক অশান্তি হতে পারে এই আশঙ্কায় আবেগতাড়িত হয়ে তিনি গোলমাল থামাতে ভবানীপুর থানায় পৌঁছে গিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে কোনও চটজলদি সিদ্ধান্ত নিতে তিনি আর আর চাইছেন না।
তা হলে পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে এ ভাবে বিরোধিতা কেন করলেন মমতা?
গত কয়েক দিনে যা ঘটেছে তা বিশ্লেষণ করে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা মনে করেছেন, মমতার আসল লক্ষ্য নর্থ বা সাউথ ব্লক নয়। তাঁর লক্ষ্য সাধারণ মানুষ। তৃণমূলের ইস্তেহারে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ করা হয়েছে।
মূল্যবৃদ্ধি বরাবরই শাসক দলের বিরুদ্ধে প্রচারের হাতিয়ার হয়। মমতা সিপিএমের হাতে এই হাতিয়ার তুলে দিতে চান না। তাই ক্ষমতায় থেকেও নিজেই মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে সরব হয়ে এই পরিসরটা সিপিএমের কাছ থেকে কেড়ে নিতে চেয়েছেন তিনি।
অতীতে এই কৌশল সিপিএম-ও অবলম্বন করত। ইউপিএ-র প্রথম দফায় যখন তারা কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থক, তখন মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে একের পর এক কড়া বিবৃতি দিয়েছে সিপিএম পলিটব্যুরো। কিন্তু সমর্থন প্রত্যাহার করেনি। মমতাও সেই একই কৌশল অবলম্বন করেছেন।
তিস্তা চুক্তি থেকে শুরু করে বহু বিষয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে মমতার দূরত্ব বাড়ছে। কিন্তু জোট ভেঙে যাক, সেটা তিনি চান না। কারণ, সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। আগামী মে মাসে ভোট হওয়ার কথা থাকলেও আইন অনুসারে তা ছ’মাস এগিয়ে আনা যায়। ফলে ফেব্রুয়ারিতেও ওই ভোট হতে পারে। রাজ্যে তৃণমূল প্রধান শক্তি হলেও পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ভেঙে যাক এটা মমতার কাঙ্ক্ষিত নয়। কেন্দ্রে জোট ভাঙলে রাজ্যেও তার অনিবার্য প্রভাব পড়বে। কংগ্রেসের মন্ত্রীরা মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে প্রবল বিরোধিতা শুরু করবেন। পাশাপাশি মমতা রেলমন্ত্রী থাকাকালীন রাজ্যের জন্য যে সব প্রকল্পের সূচনা করেছিলেন, তৃণমূল রেলমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিলে সেগুলিও মুখ থুবড়ে পড়বে।
তবে শরিক রাজনীতির ক্ষেত্রে ঘটনা সর্বদাই তার নিজস্ব গতিতে চলে। ইচ্ছা না-থাকলেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, অঘটন ঘটে যায়। অতীতে এমন উদাহরণ যথেষ্ট রয়েছে। সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হোক, চাইছেন না মমতা। আবার একই সঙ্গে তিনি এ-ও বুঝতে পারছেন যে, মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতির মতো বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে দেশ জুড়ে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে কংগ্রেস। তাই ধাপে ধাপে কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব কী ভাবে বাড়াবেন, নিজেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন করবেন সেটাও তাঁর চিন্তার মধ্যে রয়েছে। তবে আপাতত মমতা চান স্নায়ুর যুদ্ধে জিততে। কিন্তু অতীতের মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত না নিয়েই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.