প্রতি পক্ষ
চলমান জীবন
লের কি আখর হয় কোনও? পৃথিবীতে কারও নাম লেখা থাকে জলের অক্ষরে? যদি জল দিয়েই ছবিতে স্বাক্ষর আঁকেন কোনও শিল্পী, জল-ছবি ধরে রাখে তাঁর নাম?
এই সব প্রশ্ন তাঁর সামনে রাখা হয়নি, কিন্তু রাখাই যেত। কারণ, তাঁর পরিচয় বহুবিধ, বহু-মাত্রিক, ক্যানভাস থেকে ক্যামেরা পর্যন্ত দৃশ্য-শিল্পের নানা শাখায় তাঁর বিচরণ, কিন্তু পরেশ মাইতি বললেই কাগজের গায়ে জলের দাগ ক্রমশ গড়িয়ে চলে, আর গড়াতে গড়াতে এই রাজ্য, এই দেশ, এই মহাদেশ ছাড়িয়ে ক্রমে ভেনিস, প্যারিস, লন্ডন... আসলে জল সব সময় বিম্ব তৈরি করে, আর সেটাই আমাকে টানে, বললেন পরেশ। হেমন্তের এক অপরাহ্নে সিমা গ্যালারি-র বাইরে হলুদ রৌদ্রে ভাসছে কলকাতা। হাওয়ায় এখনও হিম নেই, ঠিক, কিন্তু কয়েক মাস আগের তিতকুটে আর্দ্রতাও উধাও। জানলার কাচে শিল্পীর আলতো ছায়া। সে দিকে তাকিয়েই কি ঈষৎ আনমনা হলেন তিনি? এক দিকে বিম্ব আর অন্য দিকে জগৎ, একটি মায়া এবং অন্যটি প্রকৃত...না কি তা নয়, কে বলে দেবে, কোনটি কখন কার কাছে সত্য হয়ে দেখা দেবে... যখন জলরঙের কাজ করেন, তখন ঠিক কার কাছে সমর্পণ করেন নিজেকে?
বস্তু না বিম্ব?
পরেশ হাসলেন, জলের এই গড়িয়ে যাওয়াটা একটা অদ্ভুত কাণ্ড, জানেন, আপনি জানেন সে গড়াবে, কিন্তু ঠিক কতটা গড়াবে, সব সময় তা নিয়ন্ত্রণ করা শক্ত। মানে, পুরোপুরি আপনি যতটুকু চাইবেন, ততটুকুই গড়াবে, তার বেশি আর একটুও নয়, এ ভাবে তো কাজ করা যায় না। ফলে, অনিশ্চিতের কাছে কিছুটা আত্মসমর্পণ করতেই হয়।
কেমন সেই আত্মসমর্পণ?
বিচিত্র। কখনও কখনও দারুণ লাগে, ঠিক যা চাইছিলাম, অবিকল সে রকমই হল, বা অনেকটা সেই রকম হল। আবার, জলের এই গড়ানে ধর্ম মাঝে মাঝে দারুণ নিষ্ঠুর। ধরুন, বেশ বড় মাপের একটা ছবি আপনি প্রায় শেষ করে এনেছেন। হঠাৎ, কোথাও একটা ফোঁটা পড়ে গেল, একটা দাগ...কিচ্ছু করার নেই, গোটা কাজটা আপনাকে ফেলে দিতে হবে। ভাবুন, প্রায় ফিনিশ করে আনা একটা কাজ...তখন এত কষ্ট হয়...এ ভাবে যে কত ছবি ফেলে দিয়েছি, একেবারে ঠিকঠাক ছবি, কোথাও কোনও সমস্যা নেই, কিন্তু ওই যে... কোত্থেকে একটা দাগ এসে পড়ল।
আর এই কাজ করার আনন্দ? সেটা কী রকম?
হাসছেন পরেশ। তাঁর সামনে গ্যালারিতে ‘শেষ লেখা’ প্রদর্শনীর বিভিন্ন ছবি। একটি ছবির দিকে তাকালেন, বললেন, ওই দিকে চলুন, বলছি।
একটি ছবিতে অন্ধকারের ফাঁকে উঁকি দিয়েছে আশ্চর্য একটা লাল। ভোরের আকাশের লাল। সেই রক্তিমাভার দিকে আঙুল তুললেন পরেশ, বললেন, জলরঙের কাজে আমি এ রকম লাল সাধারণত আনি না, আগেও এনেছি বলে মনে পড়ে না... কিন্তু, লালের প্রয়োগ তো আপনার ছবিতে খুব নিজস্ব ধাঁচেই আসে।
আসে, ঠিক, কিন্তু জলরঙে এই লালটা আমি আগে আনিনি। অথচ, এই ছবিটায় লাল রংটা এল। ছবিটাই দাবি করল, লাল রং ওর প্রয়োজন। আমি দিলাম। যখন শেষ হল ছবিটা, একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। মনে হল, এই ছবিটা তো চলে যাবে প্রদর্শনীতে, কিন্তু এই লালটা আমি আমার কাছে রাখতে চাই। এই লাল-ছোঁয়ানো ছবিটা আমি আমার কাছে রাখতে চাই।
কী করলেন?
ভাবলাম, এই ছবি আরও একটা আঁকব। কারও জন্য না, একেবারে নিজের জন্য। হঠাৎ করে আমার কাছে ধরা দিয়েছে যে লালের আভা, তার একটা ছোঁয়াচ নিজের কাছেও রাখতে চাই। সব সময় এ রকম হয় না, কিন্তু মাঝে মাঝে, বলতে গেলে কদাচিৎই এই ধরনের ইচ্ছে হয়, এই ছবিটার ক্ষেত্রে সেই ইচ্ছেটা হল।
কথা বলতে বলতে পরেশ একটু থামলেন। ছবিটার দিকে তাকালেন। তাকিয়েই থাকলেন। আলতো আঙুল ছোঁয়ালেন ছবির কাচে। তার পরে ফিরে তাকালেন। বললেন, পারলাম না, জানেন। কিছুতেই পারলাম না। এই যে ছবিটা এঁকেছি, তার একটা অবিকল প্রতিরূপ তৈরি করতে চাইলাম, কিন্তু কিছুতেই আর সেটা হয়ে উঠল না। রঙও কি মাঝে মাঝে এমন লুকোচুরি খেলে শিল্পীর সঙ্গে? পরেশ এক মুহূর্ত বিষণ্ণ, তার পরে বললেন, একেবারে এল না বলব না, কারণ তার পর থেকে আমার ছবিতে দেখা দিতে থাকল লাল। অন্য ছবিতেও। কী ভাবে সে এল, কী ভাবে তাকে আমি গ্রহণ করলাম, একটা বর্ণবিন্যাসের মধ্যে কী ভাবে ঠাঁই দিলাম তাকে, সেই কাহিনি একান্তই শিল্পীর নিজস্ব।
ঠিক, কিন্তু শিল্পের পাশাপশি শিল্পের সেই রান্নাঘরে উঁকি দেওয়াটাও কি দর্শকের একটি গভীর মনোবাসনা নয়?
মানছেন পরেশ, কিন্তু তার সঙ্গেই জানিয়ে দিচ্ছেন, নিজের হাতে, তুলিতে, প্যালেট-এ সেই রঙের বোধটিকে গ্রহণ না করলে, ধারণ না করলে সেই অনুভবটির নাগাল পাওয়া কঠিন। বললেন, কী ভাবে সেটা হয়, তা বোঝানো খুব শক্ত। ধরুন, এই যে জগৎটা প্রতি মুহূর্তে আপনার চার পাশে অজস্র ছবি নির্মাণ করে চলেছে, তারই কোনও একটিকে তো আপনি ধরবেন আপনার আঁকা কোনও নিসর্গ-দৃশ্যে, কিন্তু কোনটিকে ধরবেন?
মনে রাখা ভাল, পরেশ মাইতি ছবি-করিয়েও বটে। ছবি অর্থে ফিল্ম। সুতরাং, তিনি যখন চলমান ছবি-ধারার কথা বলেন, তখন সিনেমার অনুষঙ্গ মনে আসবেই। সুতরাং, অনিবার্য ভাবেই পরের প্রশ্নটি হল, তা হলে কি বলবেন, সেকেন্ডে যে চব্বিশটা ফ্রেম বয়ে চলেছে, তারই কোনও একটিকে বুঝি ধরতে চান চিত্রপটে?
পরেশ হাসলেন, চাই। কিন্তু সিনেমার সঙ্গে এই কাজটার একটা মৌলিক ফারাক আছে। সিনেমা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলে। সে সেকেন্ডে চব্বিশটা ফ্রেমই পায়, তার পরে সেই হিসেব নিয়ে আরও সেকেন্ড, আরও মিনিট, আরও ঘণ্টা ধরে এগিয়ে চলে। ছবিতে সেই জিনিসটা সম্ভব নয়। আপনার সামনে একখণ্ড কাগজ। তার মাপ বিভিন্ন হতে পারে। কিন্তু, ওই যে তার চার দিকের সীমানা, তারই মাঝে আপনাকে আঁকতে হবে। ছবিটা শেষ করতে হবে। ওই সীমানাটি চূড়ান্ত।
মজা এই যে, সেই বিধিবদ্ধ সীমারেখার মধ্যে থেকেই খেলা করতে হবে অসীমের সঙ্গে। পরেশ মাইতি তা জানেন।
সুতরাং, ছবির ফ্রেম যেখানে ফুরোয়, সেখান থেকেই শুরু হয় অন্য একটা ছবি। ঠিক যে ভাবে গড়িয়ে চলে জল। কিংবা, আমাদের জীবন। অনন্তের দিকে।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.