|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা... |
|
জি.ওয়ান-এর বেগ আছে, আবেগ নেই |
দুর্বল গল্প, এলোমেলো চিত্রনাট্য। তাও হলিউডি প্রযুক্তিকে সফল চ্যালেঞ্জ। লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায় |
একটা ট্রেন হু হু করে বেরিয়ে যাচ্ছে। কোনও স্টেশনে থামছে না। ট্রেন ভর্তি লোকজন, কাচ্চাবাচ্চা আতঙ্কে ফুটছে। কেউ কিছুটি বুঝতে পারছে নাকী হল। শুধু দূর থেকে নীল চোখে লক্ষ্য স্থির রেখে ধেয়ে আসছেন শাহরুখ খান। একটা পা এই কামরায় তো আরেকটা ওই কামরায়। এই মুহূর্তে ট্রেনের মাথায় তো পর মুহূর্তে পাশ দিয়ে যাওয়া আরেকটা ট্রেনের দরজায়। থামাতেই হবে ট্রেন।
ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস ফুঁড়ে বেরিয়ে গেলেও থামাতে হবে।
এবং সেটাই ঘটল। অবিশ্বাস্য স্বপ্নের মতো ঘটনাটা ঘটেই গেল ভারতীয় সিনেমার পর্দায়।
সৌজন্যে, ‘রা. ওয়ান’।
এমন অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলার পরেও ‘রা.ওয়ান’ নিয়ে লেখার শুরুতেই একটা কথা বলে নিতে হয়।
একটা গল্পকে অনেক দিক থেকে পড়া যায়। একটা ছবিকেও অনেক দিক থেকে দেখা যায়।
প্রশ্ন হল, কোন ছবি কোন দিক থেকে দেখব। ‘রা.ওয়ান’-ও এই টানাপোড়েনের ব্যতিক্রম নয়। তার একটা বড় কারণ অবশ্যই দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকায় ছবিটা নিয়ে নানাবিধ লেখালিখি। এবং ছবি দেখে বিভিন্ন দর্শকের পরস্পর-বিরোধী মতামত।
সত্যি বলতে কী, তাই একটু ভয়ে ভয়েই দেখতে গিয়েছিলাম ছবিটা। কিন্তু ছবি শেষ হওয়ার পর দেখলুম, একগুচ্ছ কচিকাঁচা দিব্যি জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে শেষ টাইটল কার্ডের গানটাও মন দিয়ে গিলছে। তখন মনে হল, আরে! শাহরুখ তো এইটাই চেয়েছিলেন!
আবার সেই প্রশ্নটা ভাবনায় এল। কোন ছবি কোন দিক থেকে দেখব?
ডেভিড ধবনের ছবিতে যশ চোপড়ার মেজাজ আশা করব না নিশ্চয়ই। আলমাদোভরের সঙ্গে ওয়াং কার-ওয়াই গুলিয়ে ফেলব না নিশ্চয়ই। ছেলের জন্য ছবি বানাতে চেয়েছেন বাবা, এইটুকু শুনেই ধাঁ করে গুগাবাবা ভেবে ফেলব না নিশ্চয়ই।
তা হলে ‘রা.ওয়ান’ কেমন ছবি? উত্তরে বলব, ‘রা.ওয়ান’ যেমন হওয়ার কথা, ‘রা.ওয়ান’ তেমনই। |
|
রা.ওয়ান
শাহরুখ, করিনা, অর্জুন, আমন
|
প্লে স্টেশন-প্রজন্মের কথা ভেবে বানানো এক পুতুল-সুপারহিরোর গল্প, চোখ ধাঁধানো আড়ম্বর আর অ্যাকশনের হাউইবাজি। যাঁরা বলছেন, ‘রা.ওয়ান’ আদতে অত্যাধুনিক স্পেশাল এফেক্টস আর কম্পিউটার গ্রাফিক্স, সোজা কথায় এসএফএক্সের কেরামতিতে বানানো ‘শক্তিমান’ আর যাবতীয় হলিউডি সুপারহিরো ছবির টুকলি, তাঁরা আসলে একদম ঠিক বলছেন। ‘রা.ওয়ান’-এর অমলকান্তি এটাই হতে চেয়েছিল।
এস এফ এক্সের যে কেরামতি হলিউড এত কাল দেখিয়ে এসেছে এবং আমরা চোখ ট্যারা করে তাকিয়ে থেকেছি, সেটাই এ দেশে বসে করে দেখিয়ে দিয়েছে ‘রা. ওয়ান’। ‘রা.ওয়ান’ সে অর্থে সত্যিই কোনও ‘মৌলিক’ বা ‘অরিজিনাল’ ছবি নয়। বহু বহু হলিউডি ছবির কাছে তার ঋণ। ‘রা.ওয়ান’-এর আসল ম্যাজিক অন্যত্র হলিউড হাজার কোটি খরচা করে যা করে, সেটাই ১৫০ কোটি টাকায় করে দেখানো। এবং সেখানে ‘রা.ওয়ান’ একশো ভাগ সফল। ‘রা.ওয়ান’ ঘটে যাওয়ার পর আউটসোর্সিং নিয়ে আরও বেশি কড়া হওয়ার জন্য যদি ওবামাকে চাপ দেয় হলিউড, অবাক হব না।
এবং হলিউডকে এই চ্যালেঞ্জটা সফল ভাবে ছুঁড়ে দিতে পারার জন্যই ‘রা.ওয়ান’ শাহরুখের সবচেয়ে ‘অ্যাম্বিশাস’ (ইচ্ছে করেই এই শব্দটার বাংলা করলাম না) ছবি। মুম্বইয়ে লোকাল ট্রেনে যে ‘চেজিং’ দৃশ্যটার কথা গোড়াতেই বললাম, শুধু সেটার জন্যই ভারতীয় ছবির ইতিহাসে ‘রা.ওয়ান’-এর জায়গা পাকা। এবং সেই ইতিহাসের সাক্ষী থাকার জন্যই ‘রা.ওয়ান’ দেখতে যাওয়া উচিত। শাহরুখ অন্য দুই খানকে পিছনে ফেলে দিতে পারলেন কি না, সেই কচকচিতে না গিয়ে।
এবং এই ইতিহাসের ব্যাপারটা ‘রা.ওয়ান’ ছবিটার একটা বড় উপাদানও। ‘ওম শান্তি ওম’ যেমন বলিউডি ঘরানার প্রতিটি নিশানকে নিজের শরীরে গেঁথে নিয়েছিল, ‘রা.ওয়ান’ তেমনই কুর্নিশ করেছে ‘শাহেনশাহ অমিতাভ বচ্চন’ এবং ‘সুপারস্টার রজনীকান্ত’কে (টাইটল কার্ডে এ ভাবেই লেখা হয়েছে দু’জনের নাম)। একটি দৃশ্যে রজনী স্যার তো সরাসরি আবির্ভূতই হয়েছেন, অন্য দৃশ্যে কণ্ঠদান করেছেন শাহেনশাহ। ‘রা.ওয়ান’ ছবিতে ছোট্ট প্রতীক (আমন বর্মা) চাইত, ভিলেন যেন হিরোর চেয়ে শক্তিশালী হয়! তার স্বপ্নদৃশ্যে তাই দুর্দান্ত ভাবে উপস্থিত থাকেন ‘খলনায়ক’ সঞ্জয় দত্ত। কম্পিউটার গেমের পোকা প্রতীকের সেই স্বপ্নকে আকার দিতে গিয়েই প্রতীকের বাবা শেখর সুব্রক্ষ্মণ্যম বানিয়ে ফেলেন একটা নতুন গেম। সেই গেমের ভিলেনই হল রা.ওয়ান ।
অর্থাৎ? দিনে হরিপদ কেরানি আর রাতে সুপারম্যানের গল্পটা এইখানে নতুন মোচড় নিল। সফটওয়্যার শাসিত দুনিয়ায় সত্যিই আজ দই দিয়ে চাউমিন মেখে খাওয়া আপাত ভোম্বল গোছের লোকও বানিয়ে ফেলতে পারে রা.ওয়ানের মতো একটা গেম। এবং সেই আগ্রাসী ভার্চুয়াল জগৎ গিলে নিতে পারে তারই জীবন। প্লে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে রা.ওয়ান তাই জ্যান্ত হয়ে ওঠে, শেখরের প্রাণ যায় আর ছোট্ট প্রতীক বাঁচার তাগিদে জি.ওয়ানকে জাগিয়ে তোলে। তার পর ঘটনার জাল পেরিয়ে রা.ওয়ান আর জি.ওয়ানের লড়াই, যুদ্ধক্ষেত্রটা সেখানে প্লে স্টেশনের ময়দান।
গেমস দুনিয়াকে যে ভাবে এ ছবির চরিত্র করে ফেলা হয়েছে এবং এসএফএক্সের যে জাদু নির্মিত হয়েছে, বলিউড এর আগে তেমনটি দেখেনি। এবং সৃষ্টিসুখের উল্লাসের প্রাবল্যেই হোক বা পশ্চিমী দুনিয়াকে হেঁকে বলার ইচ্ছেতেই হোক, প্রযুক্তির দেখনদারি এ ছবিতে একটু বাড়াবাড়ি মাত্রাতেই আছে। প্রতিটা ফ্রেম যেন চাইছে, আপনি বলে উঠুন, ‘কী দাপট!’ এবং সেই দিকে অতিমাত্রায় নজর দিতে গিয়ে চিত্রনাট্যে গাদা গাদা ফাঁকফোকর।
সেখানে রা-ওয়ানের মতো দুর্ধর্ষ দুশমন শহর দাপিয়ে বেড়ায়, প্রশাসনের নজর পড়ে না। আবার সেই রা.ওয়ানই এত আলগা করে হাত-পা-মুখ বাঁধে, প্রতীকের মতো শিশুও সেটা নিজে নিজে খুলে ফেলে। গল্পের গঠন, চরিত্রের গড়ন, সম্পর্কের নির্মাণে মনোনিবেশের অভাব স্পষ্ট। অথচ গল্পের মূল কাঠামোটা যা, তাতে কিন্তু অনেক মানবিক মুহূর্ত তৈরি হয়ে ওঠার জায়গা ছিল। শাহরুখের ছবি বলে তেমন প্রত্যাশাও ছিল। হল না।
শাহরুখ-করিনাকে বাদ দিলে অর্জুন রামপাল, সাহানা গোস্বামী বা শিশু অভিনেতা আমন বর্মাকেও যতটা ব্যবহার করা যেতে পারত, করা হল না। কাহিনি ও পরিচালনা বিভাগে অনুভব সিংহ তাই লেটার পাবেন না। গানগুলো বেশ ভাল। অ্যাকনের গাওয়া ‘ছম্মক ছল্লোঁ’ ছাড়াও, ‘দিলদারা’ এবং ‘ভারে নয়না’ গান দু’টোর কথা বলতেই হবে।
শাহরুখ-করিনা খুবই ভাল। নীল চোখের পুতুল শাহরুখকে বেশ লাগে। করিনাও দারুণ গ্ল্যামারাস। পাশাপাশি আর একটা কাজ আছে তাঁর। এ ছবিতে করিনার চরিত্রটা খিস্তিখেউড়ের ভাষা নিয়ে গবেষণা করছে। তার মনে হয় সব গালাগালির মধ্যেই কোনও না কোনও ভাবে মেয়েদের আক্রমণ করা আছে, পুরুষরা বাদ কেন?
সুপারহিরোর গল্পে এই প্রসঙ্গটা দেখে চমকালেন? ‘রা.ওয়ান’ ছবির সবটা জুড়েই অগুন্তি শরীরী এবং যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ ঠাট্টার ছড়াছড়ি, যার নিশানা কিন্তু পুরুষ। সুপারহিরো মানেই ‘মর্দ কো দর্দ নেহি হোতা’ জাতীয় পৌরুষের যে বিজ্ঞাপন, ‘রা.ওয়ান’ সেটা একদম গুলিয়ে দেয়।
শেষ বিচারে বলতে হয়, শাহরুখের ছবিতে হৃদয়াবেগের যে বিস্ফোরণ থাকে, সেটা এ ছবিতে সে ভাবে নেই ঠিকই।
তার জায়াগায় অনেকগুলো স্বপ্ন বুনে দেওয়া আছে।
শাহরুখকে চিনে নেওয়ার সেটাই তো অদ্বিতীয় চাবিকাঠি। |
|
|
|
|
|