দীর্ঘ কাল পরে দলের মতাদর্শগত অবস্থান সময়োপযোগী করার কাজে হাত দিয়েও নতুন টানাপোড়েনে পড়েছে সিপিএম। দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট এবং পলিটব্যুরোর সদস্য তথা রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই এই টানাপোড়েনের দুই প্রান্তে!
রাজ্যের ‘পরিবর্তিত’ পরিস্থিতিতে বুদ্ধবাবু চান, সিপিএম তাদের ‘গোঁড়ামি’র খোলস ছেড়ে বেরোক। কমিউনিস্ট পার্টি বলতেই যে ‘লৌহ যবনিকার’ ছবি মানুষের মনে গেঁথে আছে, সেই পুরনো ধারণা বদলাতে দল উদ্যোগী হোক। আরও খোলামেলা পরিবেশ গড়ে উঠুক দলের অন্দরে। তা হলে জনসমাজের আরও বিস্তীর্ণ অংশ সিপিএমের সঙ্গে যুক্ত হতে উৎসাহ পাবেন। নির্বাচনী বিপর্যয়ের পরে দলের জনভিত্তির সমস্যা কাটাতে এই পদক্ষেপ সহায়ক হতে পারে বলে বুদ্ধবাবুর মত।
কিন্তু সাধারণ সম্পাদক কারাট ‘উদার’ হওয়ার নামে কমিউনিস্ট পার্টির শ্রেণি চরিত্র শিথিল করার পক্ষপাতী নন। এমন কোনও পদক্ষেপে তিনি উৎসাহী নন, যাতে আরও বেশি ‘বেনোজল’ এই সুযোগে দলে ঢুকে পড়তে পারে। তবুও বুদ্ধবাবুর প্রস্তাব নিয়ে দলে ‘সুস্থ বিতর্কে’ তাঁর আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি চাইছেন, পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটিতে বুদ্ধবাবুর উপস্থিতিতেই এই বিষয়ে আলোচনা হোক। টানাপোড়েন এখানেই।
মতাদর্শগত দলিল ‘আপডেট’ করার কাজ নিয়ে দিল্লিতে পলিটব্যুরোর গত দু’টি বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যার কারণ দেখিয়ে বুদ্ধবাবু সেই বৈঠকগুলিতে যাননি। কিন্তু মতাদর্শগত দলিলের বিষয়ে তাঁর মতামত জানিয়ে ‘নোট’ পাঠিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। সিপিএম সূত্রের খবর, সেই ‘নোট’ নিয়ে দলের শীর্ষ স্তরে এখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে আলোচনা হয়নি। এ বার পশ্চিমবঙ্গে সম্মেলনের প্রস্তুতি-পর্বে রাজ্য কমিটির বৈঠকের জন্য কলকাতায় এসেছিলেন কারাট। আলিমুদ্দিনে রাজ্য কমিটির বৈঠকের ফাঁকে বুদ্ধবাবু, দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেছেন সাধারণ সম্পাদক। বুদ্ধবাবুর সঙ্গে কারাটের আলোচনায় মতাদর্শগত দলিলের বিষয়টি উঠেছিল বলেই সিপিএম সূত্রের খবর। সামনাসামনি বসেই কারাট বুদ্ধবাবুকে অনুরোধ করেছেন, পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে পারলে তিনি যেন যোগ দেন। তা হলে সেখানেই এই নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হতে পারে। প্রসঙ্গত, পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতির প্রক্রিয়ায় আগামী ১১, ১২ ও ১৩ নভেম্বর দিল্লিতে সিপিএমের পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বৈঠক বসছে। বুদ্ধবাবু সেই বৈঠকেও যোগ দিতে শেষ পর্যন্ত যাবেন কি না, এখনও নিশ্চিত নয়।
তবে বুদ্ধবাবু সশরীরে বৈঠকে যান বা না-যান, দলকে ‘উদার’ করার জন্য তাঁর প্রস্তাব নিয়ে সিপিএমের শীর্ষ
স্তরে বিতর্ক রয়েছে। বুদ্ধবাবু মনে করছেন, সময়ের সঙ্গে দলকে উপযোগী হয়ে উঠতে গেলে অনেক বিষয়ে ‘গোঁড়ামি’ কাটাতে হবে। কমিউনিস্টদের মতাদর্শের প্রশ্নে কোনও শিথিলতা বা আপসের কথা তিনি বলেননি বলেই রাজ্য সিপিএম সূত্রের বক্তব্য।
তিনি বলতে চেয়েছেন, দলের জনভিত্তি প্রসারিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপটুকু করা হোক। কিন্তু কারাট-শিবিরের নেতাদের একাংশ মনে করছেন, দলকে ‘উদার’ করার নামে কর্মসূচি নিতে গেলে কমিউনিস্ট পার্টির চরিত্রটাই হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে! সিপিএম শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়াবে কংগ্রেসেরই একটি ‘সম্প্রসারিত সমাজবাদী অংশ’!
পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী বিপর্যয়ের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কারাটের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় কমিটিই ইতিমধ্যে বলেছে, এ রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন সিপিএম তার ‘শ্রেণি অভিমুখ’ হারিয়ে ফেলেছিল। এখন সেই ‘শ্রেণি অভিমুখ’ সংক্রান্ত বিচ্যুতি মেরামতের জন্য দলের অন্দরে চেষ্টা চলছে। সেই সময়েই ‘উদার’ হওয়ার কর্মসূচি নিতে গেলে পরস্পরবিরোধী লক্ষ্যের সংঘাত দেখা দেবে বলে সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একাংশের আশঙ্কা। কারাট-শিবিরের এক নেতার কথায়, “পশ্চিমবঙ্গে দল তো গত কয়েক বছরে যথেষ্টই উদার হয়েছিল। হতে গিয়ে ভরাডুবিও হয়েছে। এর পরেও সেই বিপজ্জনক পথে হাঁটা উচিত কি না, ভেবে দেখতে হবে!”
বুদ্ধবাবুর ‘নোট’ নিয়ে দলে আনুষ্ঠানিক ভাবে এখনও আলোচনা না-হওয়ার মধ্যে অবশ্য ‘অস্বাভাবিক’ কিছু দেখছেন না সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। দলের কেন্দ্রীয় স্তরের এক নেতার বক্তব্য, “মতাদর্শগত মূল দলিলটি নিয়ে আগে আলোচনার পরেই সংশোধনী বা অন্যান্য প্রস্তাব নিয়ে কথা হয়। সেটাই রীতি।” |