|
|
|
|
গতির আগুনে |
সচিনের ‘নিশানে’ পূর্ণ হল মুগ্ধতার উড়ান
মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য • নয়াদিল্লি |
|
|
দুপুর পৌনে তিনটের গনগনে সূর্য। পিট লেনের উপরে প্যাডক ক্লাব থেকে শুরু করে ভিভিআইপি গ্যালারিতে তখন ক্রিকেটের মহাতারকারা। আর বলিউডের বিস্ফোরণ। উল্টো দিকের গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড ফেটে পড়ছে মুহুর্মুহু। ‘ওই তো শাহরুখ!’ ‘আরে, দীপিকা ওই দিকে!’ ‘ওই দ্যাখ ইমরান খান!’ ‘ওটা প্রীতি জিন্টা না?’ ‘দ্যাখ দ্যাখ যুবরাজ!’ পঞ্চাশ ছুঁইছুঁইয়ের চোখেমুখেও টিন এজারের উত্তেজনা।
আচমকা থেমে গেল সব। এক পলকের অদ্ভুত স্তব্ধতা। আর তার পরেই সেই নেশা লাগানো শব্দটা। ভ্রু...ম, ভ্রু...ম, ভ্রু...ম।
দিনের শেষে সেলিব্রিটি-সমুদ্রের সব গর্জন ঢেকে দিয়ে মহানায়ক এই শব্দটা। আর গাড়ি-মানুষের যুগলবন্দির সেই খেলাটা, যেখানে এক গ্ল্যাডিয়েটর গতির তরবারিতে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গেলেন বাকি সব চ্যালেঞ্জ। সেবাস্তিয়ান ভেটেল শুরুতেই লিড নিলেন এবং বাকি রেসে রইলেন সকলের নাগালের বাইরে।
যেন নিখুঁত চিত্রনাট্য। ভেটেলের প্রথম ভারতীয় গ্রাঁ প্রি জয়, শুমাখারের জ্বলে ওঠা, ফিলিপে মাসা বনাম লুইস হ্যামিল্টন ট্র্যাক-নাটকের পঞ্চম অধ্যায়, কার্তিকেয়নের দারুণ রেস, আদ্রিয়ান সুটিলের নবম হয়ে ফোর্স ইন্ডিয়াকে দুই পয়েন্ট, সচিন-শুমাখার সাক্ষাৎ, শাহরুখের হাই প্রোফাইল উপস্থিতি এবং মায়াবতী বনাম কংগ্রেস নিঃশব্দ যুদ্ধ!
ভেটেলের হাতে মায়াবতী যখন ট্রফি তুলে দিচ্ছেন, রবার্ট বঢরা তখনও দর্শকাসনে ছিলেন কি না জানা নেই। ঐতিহাসিক ভারতীয় রেসে গাঁধী পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন তিনিই। বেলা একটা নাগাদ প্যাডক অঞ্চলে যখন ধরা গিয়েছিল প্রিয়ঙ্কা বঢরার স্বামীকে, তিনি জানিয়েছিলেন কার্তিকেয়নের জন্য গলা ফাটাবেন। তার একটু আগেই জে পি গোষ্ঠীর অন্যতম কর্ণধার মনোজ গৌর বলে গিয়েছেন, “আমরা কাউকে আমন্ত্রণ জানাতে ত্রুটি রাখিনি। কেউ ভুল বুঝলে কিছু করার নেই। রাহুল গাঁধীও এখানে আমন্ত্রিত।” রবার্টের কাছে জানতে চাওয়া হল, রাহুল কি আসছেন? “বলতে পারব না,” বলে এগিয়ে গেলেন তিনি। ফর্মুলা ওয়ানের প্রোটোকল হল, যে দেশে রেস হবে বিজয়ীর হাতে ট্রফি তুলে দেবেন সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী। সেই প্রোটোকল ভাঙল ভারতীয় রেসে!
|
|
জয়ের পর সেবাস্তিয়ান ভেটেল। ছবি: গেটি ইমেজেস |
বুদ্ধ সার্কিট অবশ্য রাজনীতি নয়, জাতীয়তাবাদের রঙেই বর্ণময় ছিল আজ। হরভজন সিংহ থেকে শাহরুখ খান সবাই এ দিন প্রকাশ্যে বললেন, ‘আমরা শুধু ফোর্স ইন্ডিয়া আর কার্তিকেয়নের পাশে।’ রেস শুরু হওয়ার পরে অবশ্য অনেকেই গলা ফাটালেন ফর্মুলা ওয়ানের বিশ্বখ্যাত নায়কদের জন্যই।
কাঁটায় কাঁটায় তিনটেয় শুরু হল রেস এবং প্রথম ল্যাপেই অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ লাফিয়ে বেড়ে গেল রুবেন্স ব্যারিকেলো এবং পাস্তর মালদোনাদোর দুই উইলিয়ামসে ঠোকাঠুকি লেগে যাওয়ায়। এই সময়েই ঠিক পিছনে থাকা স্যবার দলের কামুই কোবিয়াশির গাড়িতে ধাক্কা লাগে। তাঁর রেস সেখানেই
শেষ। ক্ষতি হয়েছিল ভার্জিন রেসিংয়ের টিমো গ্লকের গাড়িরও। তিনি দুই ল্যাপ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে হাল ছেড়ে দিলেন।
ভারতীয়দের ভাগ্য ভাল, ওই ধাক্কাধাক্কিতে কার্তিকেয়নের গাড়ির ‘নাক’টা তুবড়ে গেলেও বড় কোনও ক্ষতি হল না। স্টার্টিং লাইনে একেবারে শেষ থেকে শুরু করলেও এ দিন দুর্দান্ত চালিয়ে সতেরোয় শেষ করলেন
ভারতের ঘরের ছেলে। যান্ত্রিক ত্রুটিতে সেবাস্তিয়েন বুয়েমির টরো রসো থেমে আর চললই না। কিন্তু ষাট ল্যাপের রেসের আসল নাটকটা ঘটল চব্বিশ নম্বর ল্যাপে। ফিলিপে মাসার ফেরারি হঠাৎ কাছে চলে এসে কোণঠাসা করে দিল লুইস হ্যামিল্টনের ম্যাকলারেনকে। যাওয়ার কোনও জায়গা না পেয়ে মাসার গাড়িতে ধাক্কা মারলেন হ্যামিল্টন। এমনিতেই দুই চালকের প্রায় মুখ দেখাদেখি নেই। অথচ এ দিন রেসের আগে পরপর দুর্ঘটনায় প্রয়াত ‘ইন্ডি কার’ তারকা ড্যান ওয়েলডন এবং ‘মোটো জি পি’ চালক মার্কো সিমোনসেলির জন্য এক মিনিটের নীরবতা পালনের সময় হ্যামিল্টন জড়িয়ে ধরেছিলেন মাসাকে।
ক্ষণস্থায়ী হল সেই শান্তিপ্রক্রিয়া। চব্বিশতম ল্যাপের পর টিম রেডিওয় ক্ষিপ্ত হ্যামিল্টনের গলা ভেসে এল, “ফিলিপে আমায় একদম চেপে দিল।” গাড়িরও ক্ষতি। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, এই নিয়ে মাসার সঙ্গে হ্যামিল্টনের এটা পঞ্চম ধাক্কা। মোনাকো, সিলভারস্টোন, জাপান, সিঙ্গাপুরের পর এ বার ভারতে। রেস স্টুয়ার্ডরা সঙ্গে সঙ্গে ঘটনার তদন্ত করে দোষী সাব্যস্ত করলেন মাসাকে। তাঁর শাস্তি হল ‘ড্রাইভ থ্রু পেনাল্টি’। মানে ল্যাপের শেষে পিট লেনে ঢুকে ঘণ্টায় মাত্র ৮০ কিলোমিটার গতিতে গোটা পিট লেন পার করে আবার রেসে ফেরা। যা করতে করতে অনেকটা পিছিয়ে গেলেন মাসা। দুর্ভোগের তখনও বাকি ছিল ব্রাজিলীয়ের। বত্রিশ নম্বর ল্যাপে যোগ্যতা অর্জন পর্বের মতোই আবার রাস্তার ধারের উঁচু অংশে লেগে ভাঙল তাঁর সাসপেনশন এবং আউট! রেসের পরে শাস্তিকে চ্যালেঞ্জ করে মাসা বললেন, “যত দ্রুত সম্ভব এই ভারত সফর ভুলতে চাই।” সাত নম্বরে শেষ করলেন হ্যামিল্টন। বড় ধাক্কা খেল তাঁর চ্যাম্পিয়নশিপে রানার আপ হওয়ার বাসনা। “কী আর বলব? ভীষণ হতাশ। ব্রিটেনে ফিরে মাথা ঠান্ডা করে আবার খেলায় ফিরতে হবে,” বলে আর দাঁড়ালেন না হ্যামিল্টন। গত ক’দিন চুপচাপ থাকা জেনসন বাটন আর ফের্নান্দো আলোনসো দ্বিতীয় আর তৃতীয় হলেন।
মাত্র দিন কয়েক আগে ভারত-ইংল্যান্ডের এক দিনের ম্যাচ দেখতে ইডেনমুখো হয়েছিলেন বড়জোর হাজার কুড়ি লোক। আর আজ বুদ্ধ সার্কিটের দর্শকাসনে বসে রুদ্ধশ্বাসে রেস দেখলেন ৯৪ হাজার ৮০০ দর্শক! এই দর্শকদেরই একটা বড় অংশ ক্যামেরার সামনে, জনতার মুগ্ধ নজরের সামনে থাকতে অভ্যস্ত। অথচ রবিবার তাঁরা নিছক গ্যালারিতে বসা অত্যুৎসাহী ভক্ত। বীরেন্দ্র সহবাগ যেমন রেসের আগে পিট লেনে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, “আমার কাছে এটা সারা জীবনের একটা সুযোগ।” ডোনা আর সানাকে নিয়ে সৌরভের পৌঁছতে একটু দেরি হল। তার আগেই ফোর্স ইন্ডিয়ার পিটে বান্ধবী গীতা বসরার সঙ্গে পোজ দিয়ে ছবি তুলে যাওয়ার আগে হরভজন বলেছেন, “আমি খুব উত্তেজিত। আগে কখনও ফর্মুলা ওয়ান দেখিনি, কিন্তু সচিনের কাছে অনেক গল্প শুনেছি। সত্যি বলতে, আই অ্যাম হিয়ার টু হ্যাভ ফান।” সমর্থন করছিলেন ফোর্স ইন্ডিয়াকে, কিন্তু জয় চাইছিলেন হ্যামিল্টনের। |
দুই বন্ধু
|
বুদ্ধ ইন্টারন্যাশনাল সার্কিটে সচিন-শুমাখার। রবিবার। ছবি: পিটিআই |
ভারতীয় গ্রাঁ প্রি-তে লেডি গাগাকে এনে ‘হ্যাভিং ফান’-এর মানেটাই বদলে দিয়েছেন যিনি, সেই অর্জুন রামপাল ভেটেলের জন্য গলা ফাটাতে এসে বললেন, “এই রেসটা ভারতের মুকুটে নতুন মণি।” ‘রা-ওয়ান’-এর প্রধান খলনায়ক কিন্তু ফর্মুলা ওয়ানের দিনে নতুন ছবি নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ। দীপিকা পাডুকোনের দাবি, কার্তিকেয়ন কোন খেলার সঙ্গে যুক্ত, তা তিনি জানেন না। এ দিকে তিনি ফোর্স ইন্ডিয়ার সমর্থক। সানিয়া মির্জার সমর্থনও ফোর্স ইন্ডিয়ার দিকে। এরই ফাঁকে হন্তদন্ত লেসলি লুইস। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্র্যাকে জাতীয় সঙ্গীত গাইবার কথা তাঁর, লাকি আলির, কে কে-র এবং দলের মেহেন্দির। প্রত্যেকেই ফর্মুলা ওয়ানে ‘নতুন’ এবং উত্তেজিত। উদ্বিগ্ন লেসলি বললেন, “দারুণ একটা গিটারের ঝংকার রেখেছিলাম গানে। কিন্তু সিকিউরিটি আমার গিটারখানাই আটকে দিল!” আমিরের ভাগ্নে ইমরান খানের অন্য সওয়াল। “এত ভাল রেস সার্কিট বানাতে পারলে আমাদের এ বার রাস্তাগুলোও ভাল বানানো উচিত।”
দুই ছেলের হাত ধরে সুজান রোশন, মেয়েকে নিয়ে নীনা গুপ্ত, বাবা অনিল কপূর, বোন আর পুরো পরিবারের সঙ্গে সোনম কপূররা এসেছিলেন ‘পরিবেশটার আমেজ নিতেই’। তবে যাঁর জন্য অপেক্ষার পারদটা বেশি চড়ছিল, সেই শাহরুখ খান পিট লেনে এলেন বেশ পরে। ফোর্স ইন্ডিয়ার বিল্ডিংয়ে বিজয় মাল্য, সুব্রত রায় আর এফআইএ (আন্তর্জাতিক অটোমোবাইল ফেডারেশন)-এর প্রেসিডেন্ট জাঁ টডের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক সেরে বেরোলেন যখন, ততক্ষণে ড্রাইভারদের প্যারেড শেষ। শাহরুখের গলায় বাড়তি উচ্ছ্বাস, “দারুণ লাগছে। দিল্লির আবহাওয়াটাও ফর্মুলা ওয়ানের জন্য আদর্শ।”
সেলিব্রিটি-নদীটা তখনও বর্ষার পাগলা ঝোরা হয়নি। জে কে রেসিংয়ের প্রধান বুদ্ধ সার্কিটের তারিফ করছিলেন এক দিকে। আর এক দিকে মাইকেল শুমাখার এবং নারায়ণ কার্তিকেয়নের এক সময়ের মালিক, জর্ডন দলের একদা সর্বেসর্বা এডি জর্ডন ইট রঙের পাঞ্জাবি চাপিয়ে বুম হাতে সাংবাদিকের নতুন ভূমিকায়। সেই সময় কথা হচ্ছিল ফর্মুলা ওয়ান প্রধান বার্নি একলেস্টোনের সঙ্গে। “ফর্মুলা ওয়ানকে ভারতে ক্রিকেটের পরেই জনপ্রিয়তায় দু’নম্বরে তুলে আনতে হলে সচিনের মতো তারকাকে দরকার।” একটু আগেই বলে গিয়েছেন ফর্মুলা ওয়ানের কিংবদন্তি জ্যাক স্টিউয়ার্ট। তিনি বিশ্বাস করেন, সচিনের উপস্থিতি আর আগ্রহ মোটর রেসিংকে ভারতের সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবে। তাঁর কথার অনুরণন একলেস্টোনের গলাতেও। সচিনের থেকেও মাথায় ইঞ্চি ছয়েক ছোট, আর ‘রঙ্গিলা’ বলে বিশ্ববিখ্যাত একলেস্টোন বললেন, “সচিন ফর্মুলা ওয়ানটা সত্যিই বোঝে। ওর জন্য এ দেশের তরুণ প্রজন্মও ফর্মুলা ওয়ানে আগ্রহী হবে।”
দিনের শেষে ভেটেলের ফিনিশ লাইন পার করার চেকার ফ্ল্যাগটা দুলে যাচ্ছিল সচিনের হাতেই।
ভারতীয় রেসের শেষ লগ্নে এটাই বোধ হয় আসল ছবি! |
|
|
|
|
|