লন্ডনের মঞ্চে ম্যাকবেথ। ষোড়শ শতকের ইংল্যান্ড সেই নাটক দেখে অভিভূত। নাট্যকারকে ঘিরে দর্শকদের উচ্ছ্বাস বাঁধ মানছে না।
এক কোণে, দর্শকাসনে বসে সেই দৃশ্য দেখছেন এক যুবক। ভাবছেন, এই অভিনন্দন তো আসলে আমারই প্রাপ্য। শেক্সপিয়র নন, তিনিই যে ম্যাকবেথের আসল নাট্যকার!
হ্যামলেট, ম্যাকবেথ বা কিং লিয়ার। এই নাটকগুলো কি সত্যিই শেক্সপিয়রের লেখা? অনেক দিনের পুরনো এই বিতর্ক ফের মাথা চাড়া দিচ্ছে নতুন এক সিনেমার হাত ধরে।
‘অ্যাননিমাস’। জার্মান পরিচালক রোলান্ড এমেরিখের এই ছবিটি আজ মুক্তি পেল লন্ডনে। এর আগে লন্ডন চলচ্চিত্র উৎসবেই ছবিটি ঘিরে যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি হয়। কারণ আর কিছুই নয়, ছবির বিষয়বস্তু। পরিচালকেরই কথায়, “সাহিত্য জগতের সব থেকে বড় নামটির পাশে ‘জুয়াচোর’ লিখে দিলে বিতর্ক তো হবেই!”
কী বলছে ‘অ্যাননিমাস’? ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে সেই পুরনো এক ফর্মুলা শেক্সপিয়রের নাটকগুলো অন্য কারও লেখা! কার লেখা, সে নিয়েও বিস্তর তত্ত্ব রয়েছে। তালিকাটি বেশ চমকপ্রদ শেক্সপিয়রের সমসাময়িক দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন, আর এক সমসাময়িক ট্র্যাজেডি লেখক ক্রিস্টোফার মার্লো, ‘ডন কিহোতে’র লেখক, স্পেনের মিগুয়েল সার্ভেন্তিস, এমন কী, রানি প্রথম এলিজাবেথও রয়েছেন তাতে। সেই তালিকাতেই নবতম সংযোজন, এডওয়ার্ড দ্য ভ্যের, অক্সফোর্ডের ষোড়শ আর্ল। তিনিই নাকি শেক্সপিরীয় নাটকগুলোর আসল লেখক, দাবি ‘অ্যাননিমাস’-এর। |
কী ভাবে এডওয়ার্ডের লেখা নিজের বলে চালাতে শুরু করলেন শেক্সপিয়র? এমেরিখের ছবিতে দেখানো হয়েছে, কিশোর বয়স থেকেই লেখালিখি করতেন এডওয়ার্ড। কিন্তু অভিজাত পরিবারের ছেলে বলে নিজের নামে সেই সব লেখা প্রকাশ করতে পারতেন না। তখনকার ইংরেজ সমাজের সেটাই নাকি নিয়মকানুন। নিজের নামে না হলেও নিজের লেখা নাটকগুলো প্রযোজনা করাতে চাইতেন এডওয়ার্ড। এমন এক জনকে খুঁজতেন, যার নাম ‘ধার করে’ তিনি নাটকগুলো দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে পারবেন।
সেই ব্যক্তিই নাকি শেক্সপিয়র! ‘অ্যাননিমাস’-এর ভাষায়, “প্রায় নিরক্ষর, এক দ্বিতীয় সারির অভিনেতা, এক লাইন লেখারও যার ক্ষমতা ছিল না।” কিন্তু এমনই ভবিতব্য, লন্ডনের মঞ্চে একের পর এক মঞ্চস্থ হচ্ছে ম্যাকবেথ, মার্চেন্ট অফ ভেনিস, টেমপেস্ট। আর ‘শেক্সপিয়র’ নামটি ‘শ্রেষ্ঠ নাট্যকার’-এর সমার্থক হয়ে উঠছে। সে খ্যাতির ব্যাপ্তি এতটাই যে, রানি এলিজাবেথের কাছেও পৌঁছে যাচ্ছে শেক্সপিয়রের নাম।
এখানেই কাহিনির মোচড়। শেক্সপিয়রের রচনার ‘সব থেকে বড় অনুরাগী’ কল্পনাতেও ভাবেননি, এই সব নাটক এমন এক জনের লেখা, প্রথম জীবনে যার প্রেম প্রত্যাখান করেছিলেন তিনি। ‘আসল শেক্সপিয়র’ এডওয়ার্ড এই নাটকে রানি এলিজাবেথের প্রথম জীবনের প্রেমিক। সিনেমার ক্লাইম্যাক্সে এসে রানি জানতে পারেন, সত্যিটা কী। কিন্তু তত ক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
শেক্সপিয়রকে ঘিরে এই ধরনের তত্ত্ব অবশ্য অভিনব বা আনকোরা নয়। শেক্সপিয়র-বিশেষজ্ঞ স্ট্যানলি ওয়েলস জানিয়েছেন, এ ধরনের একটা গুজব প্রথম শোনা যায় ১৮৫৬ সালে, কবির মৃত্যুর ২৪০ বছর পরে। ডেলিয়া বেকন নামে এক মার্কিন মহিলা স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-অ্যাভনের ট্রিনিটি গির্জায় গিয়ে কবর খুঁড়ে শেক্সপিয়রের দেহ বার করে দেখতে চেয়েছিলেন, ‘আসল’ শেক্সপিয়র কে। তাঁর সেই উদ্দেশ্য অবশ্য সফল হয়নি। ওয়েলসের কথায়, “এখন পর্যন্ত ৭৭ জনকে ‘আসল শেক্সপিয়র’ ভাবা হয়েছে। বেশির ভাগ তত্ত্বেরই কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। নেহাতই মনগড়া কথা।”
মনগড়া হলেও, নামটা যে হেতু শেক্সপিয়র, তাই যে কোনও তত্ত্ব নিয়েই জলঘোলা হবে। আর সেই ঘোলাজলেই এ বার মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন নির্দেশক এমেরিখ। এর আগে ‘ইনডিপেনডেন্স ডে’, ‘গডজিলা’, ‘২০১২’-এর মতো কল্পবিজ্ঞান-নির্ভর ছবি বানিয়েছেন তিনি।
‘স্পেশ্যাল এফেক্টে’র দৌলতে সে সব ছবি বক্স অফিসে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। অন্য পথে চলে এ বার এমেরিখের অস্ত্র সাহিত্যের ইতিহাস। এই সপ্তাহান্তে একই সঙ্গে মুক্তি পাওয়া শাহরুখের ‘রা-ওয়ান’ ও স্পিলবার্গের ‘টিনটিন’-এর সঙ্গে বক্স অফিসে সে ছবি টক্কর দিতে পারবে কিনা, বলে দেবেন সাড়ে চারশো বছরের এক বৃদ্ধ।
তাঁর নাম উইলিয়াম শেক্সপিয়র। |