গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সভা শেষে ব্রিটিশ আমলের ঝুলন্ত সেতু পার হচ্ছিলেন শতাধিক মানুষ। বাড়তি ভারে আচমকা দড়ি ছিঁড়ে সেতুটি খাদে পড়ায় শনিবার সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ দার্জিলিঙের অদূরে বিজনবাড়ির চুংথুং চা বাগানের কাছে মারা গেলেন অন্তত ২২ জন। শিশু, মহিলা-সহ অন্তত ১০০ জন খাদে ও নীচে খরস্রোতা ছোটা রঙ্গিত নদীতে পড়ে যান। ফলে মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা। রাত পর্যন্ত ৫০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। সার্চলাইট, মশাল জ্বালিয়ে বাকিদের খোঁজ চলছে।
|
উত্তরবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত আইজি ডি টি লেপচা বলেন, “রাত ১১টা পর্যন্ত ২২ জনের দেহ মিলেছে। তার মধ্যে দু’টি শিশু। সবাই বিজনবাড়ি ও দার্জিলিং এলাকার বাসিন্দা। ১২টা দেহ দার্জিলিং হাসপাতালে রয়েছে। বাকিগুলি বিজনবাড়িতে।” দার্জিলিং হাসপাতালে আহতদের তদারকিতে থাকা স্পেশাল আই জি (দার্জিলিং) এন রমেশবাবু জানান, হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের মধ্যে জনা তিরিশের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁদের শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে পাঠানোর কাজ শুরু হয়েছে। মোর্চার সাংগঠনিক সম্পাদক ঈশামণি পাখরিন বলেছেন, “ঘটনার সময়ে অনেক শিশু ও মহিলা ওই সেতুতে ছিল। অনেকের খোঁজ মিলছে না। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা উদ্ধারের কাজে নেমেছেন। পুলিশ-প্রশাসন, দমকলও রয়েছে। তবে রাতের বেলায় পাহাড়ি নদীতে নেমে উদ্ধারের কাজ করা বেশ কঠিন। সে জন্য সমস্যা হচ্ছে।” রাতেই ব্যাংডুবি সেনা ছাউনি থেকে উদ্ধারকারী দল রওনা হয়েছে। আহতদের বিজনবাড়ি, দার্জিলিং, জোড়বাংলো, কার্শিয়াং এলাকার হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। জখমদের রক্তের প্রয়োজন হলে যাতে অসুবিধে না হয়, সে জন্য সর্বত্রই ব্লাড ব্যাঙ্ক খোলা রাখা হয়েছে।
খবর পেয়েই দ্রুত উদ্ধার ও চিকিৎসার কাজ করার জন্য উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ-সহ হাসপাতালগুলিতে কন্ট্রোল রুম খোলার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “মর্মান্তিক ঘটনা। |
ছোটা রঙ্গিত নদীর উপরে এই সেই কাঠের ঝুলন্ত সেতু। |
আহতদের চিকিৎসার সব দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। মৃতদের পরিবারকেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। সব অফিসারদের সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে উদ্ধার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছি। চিকিৎসায় যাতে কোনও ত্রুটি না হয়, তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর রাজ্য সরকার।” আজ, রবিবার মুখ্যমন্ত্রীরও দার্জিলিঙে যাওয়ার কথা রয়েছে। তাঁর সঙ্গে যেতে পারেন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী ও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। রাতেই কলকাতা থেকে রওনা দিয়েছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব ও শিলিগুড়ির বিধায়ক রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য।
সরকারি সূত্রের খবর, ১৯৪২ সালে প্রায় ২২৫ ফুট দীর্ঘ ওই ঝুলন্ত সেতুটি চুংথুং চা বাগানে যাতায়াতের জন্য তৈরি হয়। পরে আরও কয়েকটি চা বাগান গড়ে ওঠে। জেলা পরিষদ থাকাকালীন কয়েকবার সেতু মেরামত করা হয়। গোর্খা পার্বত্য পরিষদের বিজনবাড়ির প্রাক্তন সিপিএম কাউন্সিলর কে বি ওয়াতার বলেন, “সুবাস ঘিসিংয়ের আমলে ১৯৮৮ সালে সেতুটি মেরামত করা হয়েছিল। তার পরে আর সংস্কার হয়নি। আমরা এখনও ওই সেতুটা পেরনোর সময়ে ভয়ে ভয়ে থাকি।” রাজ্যের প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য প্রায় একই সুরে বলেন, “পুলিশ কেন অত জনকে ওই জীর্ণ সেতুর উপরে উঠতে দিল, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তবে এই সময়ে সবার এক সঙ্গে দুর্ঘটনাগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। আমরা দলীয় ভাবে যথাসাধ্য করব।” |
এ দিন মোর্চার সভা ছিল চুংথুং চা বাগানের মাঠে। সেতু থেকে বড়জোর দেড়শো মিটার দূরে। সেখানে বিমল গুরুঙ্গ, রোশন গিরিরাও ছিলেন। বিজনবাড়ি কলেজের সেই শিলান্যাস অনুষ্ঠান শেষে সেতু পেরোচ্ছিলেন শতাধিক মানুষ। স্থানীয় সূত্রে খবর, প্রথমে সেতুর পশ্চিম প্রান্তের দড়ি ছিঁড়ে যায়। কয়েকজন সেতু ধরে ঝুলতে থাকেন। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে অন্য প্রান্তের দড়িও ছিঁড়ে যায়। সেতু-সহ বহু মানুষ অন্ধকার খাদে পড়ে যান।
দার্জিলিঙের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন বলেন, “সেতুটি খুবই পুরনো। এক সঙ্গে বহু মানুষ উঠে পড়াতেই এই দুর্ঘটনা বলে মনে হচ্ছে। উদ্ধার শুরু করেছি।” মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি বলেন, “মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হওয়ায় প্রচুর ভিড় হয়েছিল। সেতুর উপরে বহু মানুষ ছিলেন। ভিড়ের চাপেই দুর্ঘটনা ঘটে।”
চলতি মাসেই গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার উদ্যোগে দার্জিলিং জুড়ে এক মাস ব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছে। |
সেতু-কথা |
• কাঠের তৈরি ঝুলন্ত সেতু |
• ২২৫ ফুট লম্বা |
• সত্তর বছরের পুরনো |
• বিজনবাড়ি থেকে চুংথাং চা বাগানের পথে |
• ছোটা রঙ্গিত নদীর উপরে |
• নদী খরস্রোতা, ভর্তি বোল্ডার |
• সেতুতে তখন শতাধিক মানুষের ভিড় |
• পশ্চিম দিকের আঙটা খুলে দুর্ঘটনা |
|
পাহাড়ের তিন মহকুমা জুড়ে ক’দিন ধরেই একের পর এক অনুষ্ঠান হচ্ছিল। দার্জিলিং শহর থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে বিজনবাড়ি বাজার পাশেই ওই সেতুটি রয়েছে। অন্য পারে সিংতাম, সোম, রিশিহাট-সহ ১৫ চা বাগান এলাকা। সেতুটি দিয়ে হেঁটে ওই পথে দার্জিলিঙেও যাওয়া যায়। সেতুটির পাশেই একটি মাঠ রয়েছে। কাঠের পাটাতন, লোহার রেলিং এবং মোটা দড়ির সাহায্যে সেতুটি ঝোলানো ছিল।
বিজনবাড়ি ও দার্জিলিংয়ের দমকলের ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করে। পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারাও উদ্ধারের কাজে যোগ দেন। দমকল সূত্রের খবর, ছোটা রঙ্গিত নদীর তীব্র স্রোতের জন্য উদ্ধার কাজ ব্যাহত হচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, বেশ কিছু মানুষ নদীর জেলে ভেসে গিয়েছেন।
দমকলের ডেপুটি ডিরেক্টর উদয় অধিকারী বলেন, “আমরা যতটা সম্ভব উদ্ধার কাজে গতি আনার চেষ্টা করছি। ওখানে নদী বেশি গভীর নয়। কিন্তু নদীর কাছে বড় বড় পাথর রয়েছে। পাথরের আঘাতেই মানুষ মারা গিয়েছেন।”
|