প্রবন্ধ ১...
উমা ফিরায়ো না আর
বারেও পুজোর মুখে আগমনী গানে বেজেছে মেনকার আর্তি ‘এনে উমা ফিরায়ো না আর’। চার দিনের পুজোর পর কোথাও যেন একটা অতৃপ্তি থেকে যায়, ভক্ত থেকে পাড়ার থিম পুজোর কর্তাদের। কিন্তু না, নিয়মের নড়চড় করা যায় না। সমাজের নিয়ম তো মেনকারা বানান না, মেনকারা ঘরে থাকেন, বাইরের জগৎকে তাঁর কথা শুনলে কি আর চলে? পুরুষমানুষেরা থাকেন বাইরের জগতে। বাইরের নিয়ম পুরুষদের বানানো। নিয়মকানুনের কড়াকড়ি পুরুষরা মানবেন-ই। ফলে, শিবঠাকুরের কাছে দুগ্গা যদি দশমী পর্যন্তই অনুমতি নিয়ে থাকেন, তা হলে সে অনুমতির নড়চড় করবেন না হিমালয়। তিনিও তো পুরুষমানুষ। তাই মা মেনকার শেষ আবেদন নবমী নিশি পোহায়ো না। কিন্তু উষা হোক বা সুয্যিঠাকুর, নিয়মের নিগড়েই চলেন। তাই নবমী নিশি পোহায়। কিন্তু এ কী ঘটনা! নবমী নিশি শুধু নয়, দশমীর নিশিও পোহাল। তবু মা দুগ্গার ফিরে যাওয়ার নামগন্ধ নেই।
তা হলে কী কী কথোপকথন হতে পারে মা-মেয়েতে বা বাবা-মেয়েতে? বা জয়া-বিজয়া যদি এসে থাকে, তাদের সঙ্গে পার্বতীর? পাড়াপ্রতিবেশীর সঙ্গে? একাদশীর দিন থেকে শুরু হবে প্রশ্ন হ্যাঁরে, ও দিকে সব ঠিকঠাক তো? দ্বাদশীর দিন মা বলবেন, কোনও গোলমাল হয়নি তো জামাইয়ের সঙ্গে? তার পর যত দিন যাবে, সমবেত কৌতূহল প্রথমে, সব ঠিকঠাক তো? কোনও গোলমাল বাধেনি তো? তার পর শুরু হবে উপদেশ দান: ও রকম একটু আধটু অ-বনিবনা হয় সব বাড়িতেই, তা বলে এত দিন বাপের বাড়িতে থাকা মোটেই ভাল দেখায় না। এর পর এই ‘ভাল দেখায় না’-র সহজ প্রশ্রয় কখন বদলে যাবে কঠিন অনুশাসনে। শ্বশুরবাড়ি থাকতে বিবাহিতা মেয়ে বাপের বাড়ি থাকে কোন লজ্জায়? কোনও গোলমালের গন্ধ পেলে বাড়ির পুরুষরা চাইবেন মধ্যস্থতা করতে। মানে তাঁদের মেয়েটিকে যেন আগের মতো কষ্ট-অবহেলা সইতে না-হয়। প্রয়োজনে মেয়ের হয়ে ক্ষমা চাওয়া, মেয়ে যদি কোনও ভুল করে থাকে, একটু মানিয়ে-বুঝিয়ে নিন শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িটাই যে মেয়ের আসল বাড়ি, সেটা মেয়েটা এখনও বোঝে না, ভাবে যে বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকতেই পারে... ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই উপমহাদেশে, ধর্মনির্বিশেষে পুরুষশাসন মেয়েদের, এবং ছেলেদেরও, শিখিয়েছে বিবাহিতা মেয়ের ‘আসল’ জায়গা হল শ্বশুরবাড়ি। বিয়ে মানে বাপের বাড়ির উপর অধিকার চিরতরে চলে যাওয়া। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে অন্নগ্রহণ করবেন না মেয়ের সাক্ষাৎপ্রার্থী পিতারা। সেই নিয়ে কাহিনির এখনও সিরিয়ালে কী সমাদর। বহু পরিবারের মেয়েরা এক ছাদের তলায় মা-বাবা শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে বসবাস করলেও বাপের বাড়িতে বিবাহিতা মেয়ে আর বিবাহিত ছেলের যে বসবাসের সমান আইনি অধিকার আছে, সেটা সমাজ এখনও মানে না।
অবশ্য বাপের বাড়িতে বিবাহিতা মেয়েদের থাকার অধিকার এখনও শুধুমাত্র হিন্দু মেয়েদেরই আছে। তাও সেটা আইনসিদ্ধ হয়েছে ২০০৫ সালের অক্টোবরে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের (১৯৫৬) ২৩ ধারা তুলে দেওয়ায়। তার আগে সে অধিকার ছিল শুধু বিধবা, স্বামীপরিত্যক্তা আর বিবাহবিচ্ছিন্না মেয়েদের। মনে করা হত, এত ঘটা করে পণ দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে তো পৈতৃক সম্পত্তিতে তার উত্তরাধিকারের অংশ পেয়েই গেছে। তা হলে মেয়েকে আবার বাপের বাড়িতে থাকার অধিকার দেওয়া কেন? আর তার পিছনে আর একটা কারণ ধরা হত যে, শ্বশুরবাড়ি বা স্বামীর বাড়িই একটি বিবাহিতা মেয়ের যথাযথ স্থান। কাজেই বাপের বাড়িতে বিধবা, স্বামীপরিত্যক্তা আর বিবাহবিচ্ছিন্না ছাড়া বিবাহিতা সব মেয়ের থাকার অধিকার স্বীকার করে নিলে আসলে বিয়েগুলোই ভাঙবে। যেন মেয়েরা সেই আইনি অধিকার কায়েম করতে পর দিন থেকেই বাপের বাড়ির দখল নিতে কোমর বেঁধে নামবে! তা হয়নি। হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের এই সংশোধনী মন্ত্রিসভা পাশ করে দিলেও এই নিয়ে মামলা বেড়েছে এমন কোনও সংবাদ এখনও নেই।
এ তো গেল আইনি দিক। আইনের সাহায্য নিয়ে বাপের বাড়িতে অধিকার কায়েম করতে চান ক’জন মেয়ে? ন্যায়সঙ্গত হলেও আইনি লড়াই লড়তে গিয়ে আসলে সেই মেয়ে যে ‘হিংসুটে’ ভিলেনে রূপান্তরিত হবেন, মেয়েরা সেটা বিলক্ষণ জানেন। অধিকাংশ মেয়ে চান বাপের বাড়ির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে, যাতে শ্বশুরবাড়িতে বিরোধের মুখে পড়লে বাপের বাড়ির শেষ আশ্রয়টাও হারিয়ে না-যায়। তাই সম্প্রদায়নির্বিশেষ বেশির ভাগ মেয়েই বাপের বাড়ির সম্পত্তির ন্যায্য দখলও স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেন। তাঁদের সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে সেটা পরিষ্কার জানা সত্ত্বেও। কিন্তু বাপের বাড়িতে মেয়েদের যে পূর্ণ আইনি অধিকার আছে, সেটা জানেনই বা ক’জন মেয়ে? জানলেও সমাজের চাপে বিশ্বাস করেন ক’জন? স্বামী বা শ্বশুরবাড়িতে গোলমালের কথা ছেড়েই দিলাম, প্রশ্নহীন ভাবে, তির্যক মন্তব্যের সামনে বাপের বাড়িতে এমনিতে এসে ক’টা দিন কাটিয়ে দিতে সাহস পান ক’জন? বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েদের কোনও নিজস্ব সময় থাকে না সেটা ধরে নিয়েও লিখছি, বাপের বাড়িতে কটা দিন শুধুমাত্র অবসরের জন্য কাটিয়ে যাওয়ার সামাজিক আর পারিবারিক অধিকার পান ক’জন?
আর অত্যাচারের শিকার যদি হন মা দুগ্গারা? হ্যাঁ, আমাদের সরকার সে জন্য অনেক আইন করেছে। থাকার কথা সুরক্ষা আধিকারিকদের। অবশ্য শুধু শ্বশুরবাড়ি বা স্বামীর বাড়িই নয়, যে কোনও জায়গাতেই মেয়েরা যাতে বার বার নির্যাতনের শিকার না-হন, সেটা দেখা, শিকার হলে কী করে আবেদন করতে হবে, সহায়তা কী কী ও কোথায় পাওয়া যাবে, সে আঘাতের চিকিৎসা হোক বা ক্ষতিপূরণ, আশ্রয়ের ব্যবস্থা হোক বা আইনি সহায়তা, পুলিশি সাহায্য হোক বা বাড়িতে নিরাপদে থাকার অধিকার সুনিশ্চিত করা, সেই প্রতিবিধানগুলিই সুরক্ষা আধিকারিকদের দেখার কথা। আইনের বিধানে পুলিশ কী করবে, বিচারব্যবস্থা কী করবে, অত্যাচারিতার কী কী ধরনের পরিষেবার প্রয়োজন হতে পারে, সেই পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা কারা হবে, তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য কী কী, সেই সব কথাই বলা হয়েছে।
শুধু বাপের বাড়ির লোকেরা যদি অত্যাচারিতা মেয়েটিকে বার বার ফিরিয়ে দেয় পরিবারের সম্মানরক্ষার নামে, তাদের কোনও শাস্তির কথা বলা নেই। তাই মেয়েকে বিড়াল পার করানোর মতো বিয়ে দিলে কোনও অভিভাবকের শাস্তি হয় না। বার বার ফিরে এসে মেয়ে যদি শেষে আত্মহত্যা করে, পরিবারের শোকটাকেই সবাই বড় করে দেখেন, বৈষম্যকে নয়। ধর্ষিতাকে পরিবারের সম্মানরক্ষার নামে ধর্ষণকারীর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়, তার পর যখন মেয়েটিকে ‘নষ্ট মেয়ে’ শুনে শুনে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়, তখন পরিবারের শাস্তি হয় না। এই প্রশ্ন তুললেই আসে প্রতিপ্রশ্ন: বাপের বাড়িতে মেয়েটির কিছু হলে তার দায় কে নেবে?
আমরা সামাজিক মানুষ, নাগরিক, রাষ্ট্র এ প্রশ্নের ভদ্র-সভ্য একটা জবাব তৈরি করতে পারিনি বলে প্রশ্নটা তোলার অধিকারও আমাদের থাকবে না?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.