মাকুতে বাসা বেঁধেছে মাকড়সা
পেশা বদলে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন তাঁতশিল্পীরা
বাড়ি লাগোয়া তাঁতঘর বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে বহু দিন।
দশটা তাঁতে এখন মাকড়সার জাল। আগে পুজোর সময়ে শাড়ির জোগান দিতে হিমসিম খেতে হত ফুলিয়ার শেফালি দত্ত, আরতি বসাকদের। তাঁত বোনার কাজে কর্মচারীও রাখতে হয়েছিল কয়েক জন। উৎসবের মরসুমে মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে সুতো কিনে শাড়ি বুনে মহাজনকে ফিরিয়ে দিতেন টাকা। তারপরেও হাতে থাকত কিছু। সে দিন হারিয়ে গিয়েছে। সুতোর আকাশ ছোঁয়া দাম আর যন্ত্রচালিত তাঁতের রমরমায় ভাটা পড়েছে ফুলিয়ার টাঙ্গাইল তাঁত শিল্পে।
কালনা মহকুমার প্রায় দু’লক্ষ মানুষ তাঁতশিল্পের উপরে নির্ভরশীল। গত পাঁচ বছর ধরে মহকুমায় তাঁত শিল্পীদের সংখ্যা কমছে। অন্য কাজের সন্ধানে তাঁরা ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। সাহাপুর এলাকার হাফিজুল শেখ, দুলাল দেবনাথরা দু’বছর আগেও এই পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন তাঁরা নির্মাণ শ্রমিক। তাঁদের কথায়, “সারা দিন ধরে তাঁত বুনে ১৫০ টাকারও কম মজুরি মেলে। সেখানে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করলে দিনে দু-আড়াইশো টাকা পর্যন্ত মজুরি মেলে। তাই বাধ্য হয়েই এই পেশা ছোড়তে হল।” ছবিটা প্রায় একইরকম বর্ধমানের সমুদ্রগড়েও। অনেকেই চেনা মাকুর বদলে এখন ইট-পাথর টানছেন, কোন ভিন শহরে। পুজোর সময়ে ক’দিনর জন্য ঘরে ফিরে তাঁরা আক্ষেপ করেন, “বড় খারাপ লাগে, জানেন!”
টাঙ্গাইল শাড়ির মতো হস্তশিল্পে সস্তার বাজার ধরতে ভাগ বসিয়েছে যন্ত্রচালিত তাঁত। আর সুতোর দাম বেড়ে যাওয়ায় মহাজনের সুদ মেটাতে সর্বস্বান্ত হয়েছেন ফুলিয়ার টাঙ্গাইল তাঁতশিল্পীরা। একের পর এক বন্ধ হয়েছে হস্তচালিত তাঁত। টাঙ্গাইল শিল্পীরা নিজের পারিবারিক পেশা ছেড়ে অন্য পেশার খোঁজে ভিটে ছেড়েছেন। শেফালির স্বামী সেন্টুও কাঠের কাজ করতে চড়া সুদে টাকা ধার করে সৌদি আরব চলে গিয়েছেন। আরতি সংসার চালাতে চরকায় সুতো কাটেন। মেরে কেটে দিনে চল্লিশ টাকার বেশি আয় হয় না। তিনি বলেন, ‘‘অনেকবার ভেবেছি তাঁতঘরটা বিক্রি করে নিজের ঘরটা সারাবো। মন মানে না। বংশের তাঁত, স্বামী কেরলে জোগাড়ের কাজ করে।”
মনোজিত সরকারের বাড়িতে চারটে তাঁত। নিজে বোনেন, নিজেই বেচেন। মনোজিতবাবুর অভিযোগ, ‘‘দু’দিনে একটা শাড়ি বুনে বড়জোর আয় ১৩০ টাকা। এর থেকে ভিন রাজ্যে গিয়ে মজুর খাটলেও দিনে ৩০০টাকা আয় হত। অসুস্থ বাবা-মাকে ছেড়ে যেতে পারি না। পুজোয় কত নতুন নকশার শাড়ি বুনলাম, কিন্তু নিজের মা, বউকে শাড়ি দিতে পারিনি।’’ ফুলিয়া পাড়া, বুঁইচা, মালিপাড়ার মিন্টু বসাক, কৃষ্ণ বিশ্বাস, সমর সরকার, প্রকাশ ঘোষ এমন অসংখ্য নাম যাঁরা জন্ম থেকে তাঁতশিল্পটাকে আয়ত্ত্ব করেও অভাবের তাড়নায় ভিন রাজ্যে গিয়ে অন্য পেশা নিয়েছেন।
সমুদ্রগড়ের এক তাঁতি হাফিজ শেখ বলেন, “এক জন দক্ষ তাঁতশিল্পীর এক একটি কাপড় বুনতে সময় লাগে দু’দিন। এই কাজ করতে গিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। পায়ের পেশী ও চোখের উপরে চাপ পড়ে। তবুও একটি কাপড় বুনে ৩০০ টাকার বেশি মজুরি মেলে না। বাধ্য হয়েই এখন এলাকার শিল্পীরা ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন অন্য পেশার খোঁজে।” নতুন প্রজন্মও আর পুরনো পেশার দিকে হাত বাড়ান না।
গত এক দশকে শুধু টাঙ্গাইল শাড়িই নয়, ফুলিয়ার তাঁত শিল্পীদের বোনা বিভিন্ন ধরনের টাঙ্গাইল পোশাক বিশ্বের বাজারে নজর কেড়েছে। বদলেছে টাঙ্গাইল শাড়ির ব্যবসায়ীদের জীবন যাত্রা, আর্থিক পরিস্থিতি। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে শাড়ি বিক্রি করা টাঙ্গাইল শাড়ি বিক্রেতারা এখন ‘গদিওয়ালা’। এই ব্যবসায়ীদের একাংশের হাত ধরেই টাঙ্গাইলেও ভেজাল মিশেছে। উদার বাজারনীতিতে হস্তশিল্পের জায়গা কেড়ে নিচ্ছে যন্ত্রচালিত তাঁত। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছেন ফুলিয়ার টাঙ্গাইল তাঁতর শিল্পীরা।
ফুলিয়ার তাঁতিদের সংগঠিত করতে ১৯৭৭ সালে গঠিত হয় ফুলিয়া তন্তুবায় সমিতি। সমিতির দীর্ঘদিনের পৃষ্ঠপোষক হরিপদ বসাক বলেন, ‘‘সমিতির হাত ধরে টাঙ্গাইল শাড়ি অনেক বড় বাজার পেয়েছে। কিন্তু গরিব তাঁতিদের জীবিকা এখন প্রশ্নের মুখে। টাঙ্গাইল শিল্পটাকে আমরা অনেক লড়াই করে দাঁড় করাতে পারলেও তার সব শিল্পীকে ধরে রাখতে পারছি না। কয়েকটি সমিতি কাজ করছে। সরকারি সাহায্য পেতে কাগজে-কলমে ব্যাঙের ছাতার মতো বহু সমিতি গজিয়েছে।’’ ৪০ হাজার হস্তচালিত টাঙ্গাইল তাঁত চলত ফুলিয়ায়। এখন মেরেকেটে ১৫ হাজার চলে।
কে জানে আর ক’দিন মাকুর শব্দে মুখর থাকবে ফুলিয়া, সমুদ্রগড়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.