জোড়া নোবেলজয়ীও তাঁকে বলেছিলেন আধা-বিজ্ঞানী
নকশা ভাঙা নকশায় নোবেল ইজরায়েলির
প্রকৃতির আলপনায় খেয়ালখুশির দখিনা বাতাসের প্রবেশ নিষেধ বিশ্বাস ছিল বিজ্ঞানীদের। তাই এর উল্টো কথা বলার জন্য এক সময় গবেষকদের দল থেকে কার্যত তাড়িয়েই দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। এবং তাঁকেই আজ নোবেল-রসায়নে ‘জারিত’ করার কথা ঘোষণা করল রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সস। তিনি ডানিয়েল শেখটমান।
কঠিন বস্তুর গঠন সম্পর্কে এত দিনের ধারণাটাই বদলে দিয়েছে তাঁর ১৯৮২ সালের এক আবিষ্কার। এত দিন ধরে রসায়নবিদ তথা বিজ্ঞানীরা মনে করে এসেছেন, সব কঠিন বস্তুর কেলাসে (ক্রিস্টাল) পরমাণুগুলি একেবারে অঙ্কে মাপা কঠিন নিয়মে সাজানো। একটি অংশের সঙ্গে আর একটি অংশের হেরফের হওয়ার জো নেই। একই আকৃতি আর বিন্যাসের পুনরাবৃত্তিই প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। এমনকী, জীবদেহের কোষে-কোষে যে ডিএনএ, তাতেও রয়েছে পরমাণুগুলির গতে বাঁধা বিন্যাস, সমবায় এবং সজ্জা। অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দিনের পর দিন চোখ রেখে ডানিয়েলের কিন্তু মনে হয়েছিল অন্য রকম। অ্যালুমিনিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজের মিশ্রণ নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি। তাতে দেখতে পান এক অদ্ভূত ‘মোজায়েক’। পরমাণুগুলি নির্দিষ্ট ছন্দে সাজানো, কিন্তু সেই ছন্দটা যেন অমিত্রাক্ষর। মিল আছে, কিন্তু অন্ত মিলের গতে নয়। বরং কিছুটা ফারাক আছে একটি অংশের সঙ্গে আর একটি অংশের মধ্যে।

ডানিয়েল শেখটমান
সতীর্থদের জানাতে তাঁরা প্রথমে উড়িয়েই দিয়েছিলেন ব্যাপারটা। সতীর্থরা তাঁকে গবেষণা থেকে সরিয়েও দেন। কিন্তু হার মানেননি। “লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন, নিজের বক্তব্যের সমর্থনে। এবং সেই লড়াইয়ের কাছে হার মানতে হয়েছে বাকি বিজ্ঞানীদের। নতুন করে যাচাই করে দেখতে হয়েছে ডানিয়েলের বলা নকশা ভাঙা কেলাস তথা ‘কোয়াসিক্রিস্টাল’-এর অস্তিত্ব।” ডানিয়েলের কাজকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণায়, খোদ নোবেল কমিটিই বলেছে কথাগুলি।
খবরটা পেয়ে কী বলছেন ডানিয়েল? তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া “এটা একটা দারুণ অনুভূতি।” অথচ ১৯৮২-এ ওয়াশিংটনে যখন সহ-গবেষকদের ১০ প্রান্তবিশিষ্ট কেলাসে পাঁচ মাত্রিক মিলের কথা বলেছিলেন, অনেকে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
এর কয়েক মাস পরে গবেষণা থেকে বাদ পড়ে ইজরায়েলে ফিরতে হয় তাঁকে। দেশে ফিরে এক সহকর্মীকে খুঁজে বার করে তাঁর সঙ্গে মিলে শুরু করেন লেখা, যা তিনি বিশ্বাস করেন। কিন্তু সেই নিবন্ধও খারিজ হয়ে যায়।
জোড়া নোবেল পুরস্কারজয়ী বিজ্ঞানী লিনিয়াস পাওলিংও উড়িয়ে দিয়েছিলেন বিষয়টা। বলেছিলেন, “ডানিয়েলের বলা উচিত, কোয়াসি (মেকি বা আধা)-ক্রিস্টাল বলে কিছু হয় না, হয় আধা-বিজ্ঞানী।” শেষে ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয় ডানিয়েলের নিবন্ধ। সাড়া পড়ে বিজ্ঞানী মহলে। ১৯৮৭ সাল নাগাদ ডানিয়েলের কিছু ফরাসি ও জাপানি বন্ধু এমন বড় মাপের কেলাস তৈরি করেন, যার এক্স-রে ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ঠিক মতো দেখা সম্ভব হয়।
রুপো ও অ্যালুমিনিয়ামের মিশ্রণের কোয়াসিক্রিস্টাল
তার পরে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। নোবেল কমিটি উল্লেখ করেছে, “এর পর থেকেই গবেষণাগারে তৈরি হচ্ছে কোয়াসিক্রিস্টাল। একটি সুইডিশ সংস্থা সব চেয়ে টেকসই ইস্পাত তৈরি করেছে এ থেকেই। দাড়ি কামানোর ব্লেড থেকে শুরু করে চোখের অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত অতিসূক্ষ্ম সূচও তৈরি হচ্ছে এই কোয়াসিক্রিস্টাল থেকে। ফ্রাইং প্যানের উপরের আস্তরণে, ইঞ্জিনের তাপ নিরোধক ব্যবস্থায় এবং এলইডি-তে এর ব্যবহার নিয়ে এখন পরীক্ষা চলছে।”
ডানিয়েলের আবিষ্কারের আর একটি বিশেষ দিকের কথা উল্লেখ করেছে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সস। সেটাও কম চিত্তাকর্ষক নয়। তা হল, নকশা ভাঙা নকশার এই ধারণাটা যে ডানিয়েলের আবিষ্কার, তা কিন্তু নয়।
সেই ষোড়শ শতকের ইসলামি স্থাপত্যেও দারুণ ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে এটা। একই নকশায় কিছু কিছু বদল এনে সে সময়ই ইসলামি ভাস্কররা তৈরি করেছিলেন পাঁচ মাত্রার আপাত-সুষম কারুকার্য। অথচ খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে তার একটি অংশ মোটেই আর একটি অংশের পুনরাবৃত্তি নয়।
আগরায় ৪০০ বছরের ইতিমাদ আল-দাওলার সমাধি
১৬০০ সালে ইরানের ইস্পাহানে তৈরি হয়েছিল দরবি ইমামের মসজিদ। এর কয়েক বছর পর, ১৬২২ সালে নুর জহানের সময়ে আগরায় তৈরি হয়েছিল ইতিমাদ আল-দাওলার সমাধি। দু’টিতেই নকশার ওই বিশেষ বৈশিষ্ট্য আজও নজরে পড়ে। নজরে পড়ে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে রাখা ধাতুর ত্রিমাত্রিক কেলাসেও।
ইসলামি স্থাপত্যরীতির সঙ্গে প্রকৃতির রসায়নের এই অদ্ভূত মিল যিনি আবিষ্কার করেছেন, ঘটনাচক্রে তিনি ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েলের মানুষ। হাইফার ইজরায়েল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অধ্যাপক। ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে হয়-তো এ এক আশ্চর্য সমাপতন!
কিংবা প্রকৃতির রসায়নটাই এমন!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.