প্রতি শনিবার ও রবিবার শহরের নানা এলাকায় তাঁদের দেখতে পাওয়া যায়। অঙ্গ বিকৃতির জন্য কারও হাত অচল, কারও পা। স্বাভাবিক কাজকর্মে অক্ষম। দোরে দোরে ঘুরে সাহায্যের প্রত্যাশী। সোমবার সপ্তমীর সকালে তাঁদেরই দেখা গেল অন্য চেহারায়। কেউ ট্রাঙ্ক থেকে বার করে এনেছেন সস্তার নতুন প্যান্ট। কারও গায়ে ফুটপাতের টি শার্ট। মাথায় লাল ফিতে লাগানো মেয়েকে কোলে নিয়ে সেন্ট্রাল কলোনির পুজো মণ্ডপে যখন শঙ্কর রায় যখন নামলেন মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। সারদা সেবক সঙ্ঘের মণ্ডপে ঢোকার পরে আর বাসে ফিরতেই চায় না সালমা খাতুন। মণ্ডপে মোট কটা জলের বোতল রয়েছে তা গুনে দেখতে চায় সে। অনেক বুঝিয়ে তাকে বাসে ফেরালেন ভোলারাম পাল। চোখের জল মুছে ভোলারামবাবু বললেন, “কুষ্ঠ রোগী বলে আমাদের থেকে লোকে দশ হাত দূরে থাকে। বড় পুজোর মণ্ডপে আমরা ঢুকতেই পারতাম না। কোনও দিনও ভাবিনি এ ভাবে বাসে চড়ে ঠাকুর দেখার সুযোগ পাব।” বাস ভাড়া করে ওঁদের ঘোরানোর পরিকল্পনা শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এসজেডিএ) চেয়ারম্যান রুদ্রনাথ ভট্টাচার্যের। পেশায় চিকিৎসক রুদ্রনাথবাবু বহুদিন ধরে পতিত-পীড়িতদের সাহায্যের জন্য নানা ধরনের সেবামূলক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। বিধায়ক হলে ব্যবস্থা বাড়েছে। তা সত্ত্বেও সেই পীড়িতদের পাশে দাঁড়ানোর জায়গা থেকে যে তিনি এতটুকুও সরেননি তা-ই যেন তাঁদের বুঝিয়ে দিলেন মহাসপ্তমীর দিন। দার্জিলিং মোড়ের কুষ্ঠ রোগীদের পাড়া ‘চেতনা’র বাসিন্দারা। ষষ্ঠীতে গাঁধী জয়ন্তী উপলক্ষে চেতনার বাসিন্দাদের নতুন পোশাক দেওয়া হয়েছিল। বাসে করে দিনভর ঠাকুর দেখলেন চেতনার ৭১ জন আবাসিক। অষ্টমীর দুপুরে চেতনার বাসিন্দাদের মহাভোজের ব্যবস্থা রয়েছে। মেনু বিরিয়ানি, মাংস, মিষ্টি। এদিনই তার আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছে সেখানে। এসজেডিএ-র চেয়ারম্যান বলেন, “দীর্ঘদিন ধরেই চেতনার বাসিন্দাদের সঙ্গে আমার পরিচয়। গত তিন-চার দশক ধরে চেতনার বাসিন্দাদের চিকিৎসক বলতে গেলে আমিই। প্রতি বছর পুজোয় কিছু করার চেষ্টা করি। এ বার ঠিক করেছিলাম বাসে করে পুজো মণ্ডপ ঘোরাব। সকলের মুখে হাসি দেখে ভালই লাগছে।” এদিন সবচেয়ে খুশি বোধহয় চেতনার ছোটরা। অর্জুন, অঞ্জলি, সালমা, সমীরদের বকবক যেন শেষ হতেই চায় না। ছোট ভাই অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে বাসে চড়ে প্রতিমা দেখতে বার হয়েছিল ষষ্ঠী শ্রেণির ছাত্রী অঞ্জলি ঋষিদেব। জাতীয় তরুণ সঙ্ঘের মণ্ডপ থেকে বার হয়ে অর্জুনের বায়না, ঠাণ্ডা পানীয় খাবে। অঞ্জলির মুখ করুণ। পয়সা কোথায়! ঘটনাটি নজর এড়ায়নি ভোলারামবাবুর। ছোটদের একত্র করে তিনি কিনে দিলেন ঠাণ্ডা পানীয়। ওই পানীয় শেষ হয়ে গেলেও খালি বোতল হাত থেকে ফেলতে রাজি নয় অর্জুন। ভোলারামবাবু বললেন, “ডাক্তারবাবু ঠিকই বুঝেছিলেন। মণ্ডপে গিয়ে বাচ্চারা কিছু না কিছু খাওয়ার জন্য বায়না ধরবে। আজ আশ্রম থেকে আমরা বার হওয়ার সময়েই আমার হাতে সেই জন্য টাকা দিয়েছিলেন।”
তা মণ্ডপ কেমন ঘুরলেন? সেন্ট্রাল কলোনির সামনে দাঁড়িয়ে ফুলকুমারী দেবী বললেন, “কী সুন্দর! কোনও দিনও ভাবিনি এসব দেখতে পারব।” ফেরার পথে মহানন্দা স্পোর্টি ক্লাবের মণ্ডপের সামনে ব্যাগি বাউরি কপালে দু’হাত ঠেকিয়ে প্রমাণ করে বললেন, “এতই যখন দিলে ঠাকুর, ছেলেমেয়েগুলোকে সুস্থ রেখ। আমাদের এই কাল রোগ যেন তাঁদের না-ধরে।” |