‘নামেই তালপুকুর, ঘটি ডোবে না’বাংলার ক্ষয়িষ্ণু জমিদার, বনেদি পরিবারগুলির আর্থিক অবস্থা এই গুটিকয় কথাতেই ফুটে ওঠে। সময়ের চাকায় বাংলার বহু জমিদারবাড়ির পুজো, বনেদিবাড়ির পুজোর জৌলুস এখন ম্রিয়মাণ। তবে উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরের ধরবাড়ির ‘গণেশজননী’কে অবশ্য তা ছুঁতে পারেনি। বা বলা ভাল ছুঁতে দেননি পরিবারের সদস্যেরাই। আর সে জন্যই বোধহয় আর পাঁচটি পারিবারিক পুজোর চেয়ে এই পুজোকে একটু অন্যরকম ভাবে পাওয়া যায়। ধর পরিবারের গণেশজননীর জন্য পুজোর একটি দিন তাই বরাদ্দ রেখে দেন অশোকনগরের মানুষ। অনেকে চলে আসেন ওপার বাংলা থেকেও।
অসুরকে বধ করতে রুদ্রমূর্তির রণচণ্ডী নন, গণেশকে কোলে নিয়ে দেবী এই পরিবারে একেবারেই যেন ঘরের মেয়ে। দশভূজার পরিবর্তে সিংহের পিঠে উপবিষ্ট দ্বিভূজা দেবী ডানহাতে আশীর্বাদ দিচ্ছেন। অস্ত্রহীনা দেবীর দুই পাশে দুই কন্যা। কোলে গণেশ থাকলেও এখানে মায়ের সঙ্গে নেই কার্তিক। রয়েছেন শিব আর নন্দী। তবে ঠাঁই হয়নি অসুরের। এহেন মূর্তির ভাবনার বাইরে ধর পরিবারের এই পুজোর আরও কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ষষ্ঠীর দিন দেবীর বোধনের আগে সর্বসমক্ষে আনা হয় পরিবারের বহু প্রাচীন তালপাতার পুথি। আর এক বৈশিষ্ট্য তথা আকর্ষণ হল, বিখ্যাত দাবা দম্পতি দিব্যেন্দু বড়ুয়া ও সহেলি ধরের নাম জড়িয়ে থাকা। বাড়ির জামাই হিসাবে প্রতিবছর পুজোয় আসেন গ্র্যান্ডমাস্টার। |
সপ্তমীর সকালে গিয়ে দেখা গেল বাড়িতে তৈরি মণ্ডপে পুজো শুরু হয়ে গিয়েছে দেবীর। পরিবারের সদস্যদের তরফে মৃদুল ধর (সহেলি ধরের বাবা) জানালেন, “প্রতি বছর নিয়ম করে মেয়ে-জামাই পুজোয় আসে। পরিবারের অন্যরা কাজের সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও অষ্টমী-নবমীর মধ্যে সকলেই এসে হাজির হন।” তাঁর কাছেই জানা গেল, পুজোর বয়স প্রায় ৩০০ বছর। পুজোর শুরু হয়েছিল ওপার বাংলার বিক্রমপুরের চিত্রকূটে। পরিবারের পূর্বপুরুষ চিত্রকূটের জমিদার কাশীনাথ ধরের হাত ধরে। ১৯৪৮ সালে পুজো স্থানান্তরিত হয় নারায়ণগঞ্জে। তার পরের বছরই পুজো চলে আসে এ পার বাংলায়। এর পরে কলকাতার ঢাকুরিয়া, হাজরা, পার্কসার্কাসের ঝাউতলা হয়ে ১৯৭৬ সালে পুজো চলে আসে উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে।
প্রথম দিকে অবশ্য এই পরিবারে পূজিত হতেন দশভূজাই। পরে তা পাল্টে যায় দ্বিভূজায়। এর পিছনে যে কাহিনী শোনা গেল, তা হল কাশীনাথ ধরের আমলে একবার পুজোর সময় পাঁঠাবলি আটকে যায়। পুজোয় কোনও ত্রুটি হয়েছে ভেবে তিনি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন। তখন পাঁঠাবলি আর না হওয়ার জন্য দেবীর স্বপ্নাদেশ পান তিনি। সেইসঙ্গে রুদ্রমূর্তির পরিবর্তে দ্বিভূজা গণেশজননীর পুজো করতে আদেশ পান। পুজোর আচার উপচার সবকিছুই স্বপ্নে জানতে পারেন জমিদার। পুজোর নিয়ম জানতে বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটে এক পূজারির কাছে নায়েবকে পাঠান তিনি। বারাণসীতে হঠাৎই একটি বালিকা এসে তাঁকে পূজারির কাছে নিয়ে যায়। পূজারির কাছ থেকে তালপাতার পুথি নিয়ে তিনমাস পরে ঘরে ফেরেন নায়েব। ওই পুথিপুজোর মধ্যে দিয়েই শুরু হয় ধর পরিবারে দ্বিভূজা গণেশজননীর পুজো।
পুজোর ক’দিন পরিবারের সদস্যরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। পরিবারের যে সব সদস্য উপার্জন করেন তাঁদের সকলের কাঁধেই পুজোর খরচের ভার। পরিবারের সদস্য ও উপার্জনকারীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাই বেড়েছে পুজোর জাঁকজমকও। প্রাচীনত্ব, ইতিহাস, জৌলুস নিয়ে ধর পরিবারের পুজো এখন অনেকটাই পরিবারের আঙিনা ছাড়িয়ে সর্বজনীন। |