|
|
|
|
উত্তর-দক্ষিণের লড়াইয়ে উত্তাল বহরমপুর |
অনল আবেদিন • বহরমপুর |
বহরমপুরে পুজোর লড়াই-এ দক্ষিণের কাছে উত্তরের সম্মান রক্ষা করাটাই ওখন কোটি টাকার প্রশ্নের সামিল।
অন্য পুজো কমিটির কথা ছেড়েই দেওয়া যাক। শহরের উত্তর প্রান্তের খাগড়া এলাকার সোনার দেবীপ্রতিমা ও ডায়মন্ডের সপরিবার মা চন্ডীর কাছে যুদ্ধের প্রথম রাউন্ডেই কুপোকাত বহরমপুরের বুক চিরে চলে যাওয়া ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের দক্ষিণ দিকের যাবতীয় প্রতিমা ও মণ্ডপ। পঞ্চমী ও ষষ্ঠীর রাতেই সোনার দেবীপ্রতিমা ও ডায়মন্ডের সপরিবার মা চন্ডীর দর্শন পেতে প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ প্রতীক্ষার লাইন পড়েছে। ওই লাইন সপ্তমীর রাত থেকে পরবর্তী রাতগুলিতে কোথায় গিয়ে পৌঁছবে তার অনুমান করা আপাতত কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। অথচ গত বছরও দশর্কদের কাছে ব্রাত্য ছিল বহরমপুর শহররে ঘিঞ্জি ওই খাগড়া এলাকা।
উত্তরের সঙ্গে টক্করের ক্ষেত্রে দক্ষিণ-বহরমপুরের মান অবশ্য কোনও মতে রেখেছে তিনটি পুজো কমিটি শ্রী সংঘ, অভ্যুদয় ও বাবুলবোনা পুজো কমিটি। সে ক্ষেত্রে উত্তর-বহরমপুরের ওই তালিকায় রয়েছে সৈয়দাবাদ নবরূপ সংঘ, খাগড়া পাউন্ড রোড, ভৈরবতলা, সেবা মিলনী, সাধক নরেন্দ্র স্মৃতি সংঘ, ভট্টাচার্য পাড়া, বাবুপাড়া, আমরা ক’ জনের মতো প্রায় ডজন খানেক পুজো মণ্ডপ। এ ছাড়াও উত্তর-বহরমপুরের ভাগ্যে রয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কাশিমবাজারের ছোট রাজবাড়ি, খাগড়ার মজুমদার পরিবারের আদি দুর্গাবাড়ি ও সেনবাড়ির মতো রাজা-জমিদার-বনেদি বাড়ির ঐতিহ্যের পুজো। ওই সব ঐতিহ্যের পুজো অবশ্য বরাবারই ছিল। এ বার তার সঙ্গে জুড়েছে দু পক্ষের জেদ।
কেমন সেই জেদাজেদি?
দক্ষিণ-শহরের শ্রী সংঘ বিশাল আয়তনের রানিপুকুরের উপরে গড়ে তুলেছে বিশাল মণ্ডপয় ওই মণ্ডপের ভিতর গাইসাল রেল দুর্ঘটনার ‘পুনরাবৃত্তি’ ঘটিয়ে রক্তদানের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি দর্শক টানার প্রতিযোগিতায় টেক্কা দিতে চেয়েছে। একই উদ্দেশ্যে আস্ত আগ্রাফোর্টটাই যেন অভ্যূদয় সংঘ তুলে নিয়ে গিয়েছে তাদের পুজো মণ্ডপে। বাবুলবোনা পুজো কমিটি কর্তারা পুজোর বাজারে নিজেদের বুক চওড়া করতে মুম্বই-এর গেট ওয়ে অব ইন্ডিয়াকেই যেন বসিয়ে দিয়েছে উত্তর ও দক্ষিণের সীমান্ত বরাবর ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে। কিন্তু শহরের আদি এলাকা, নবাবি আমলে পত্তনি গড়া শহরের উত্তর এলাকার খাগড়া কেন হার মানবে বৃটিশ গোরা সৈন্যদের প্রয়োজনে দক্ষিণ এলাকায় গড়ে ওঠা ‘অর্বাচীন’ শহর গোরাবাজারের কাছে? ফলে খড়্গহস্ত উত্তর প্রান্ত।
নিজের ইজ্জত রাখতে এক নম্বর বাবুপাড়া সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি আস্ত একটি সাঁওতাল পল্লিকেই ওই পুজো মণ্ডপ প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। তাদের পুজো মণ্ডপ প্রাঙ্গণ জুড়ে ৭-৮টি মাটির ঘরে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি নিয়ে বাস করছে সাঁওতাল পরিবার। পুজো কর্তাদের কথায় ওই সাঁওতাল পরিবার গুলিকে কয়েক দিনের জন্য নবগ্রাম এলাকা থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছে। কুড়ে ঘরের তৈরি মণ্ডপে সামনে রয়েছে হাঁস ও মাছচাষের জন্য পুকুর। সাধক নরেন্দ্র স্মৃতি সংঘের মণ্ডপটি যেন আস্ত গ্রান্টহল ভবন, বটতলা ভট্টাচার্য পাড়ার মণ্ডপের সঙ্গে মহাকরণের অমিল খুঁজে পাওয়া সত্যিই মুশকিল। আর সেবা মিলনীতে বিশাল নারকেল গাছ কেটে সেই গুড়ি দিয়ে প্রতিমা থেকে সহজপাঠের ‘থিম’ পর্যন্ত সবই সৃষ্টি করা হয়েছে, এমনকী মণ্ডপটিও।
ভৈরবতলা পুজো কমিটির মণ্ডপ গড়া হয়েছে আমেরিকার টেক্সাস এলাকার মীনাক্ষী দেবস্থানম মন্দিরের আদলে। ৬০ ফুট উঁচু ওই মণ্ডপের ভিতরে রয়েছে বনকাপাসি সাজে সজ্জিত রাজরাজেশ্বরীর দেবীপ্রতিমা। পুজোয় সেরার শিরোপা জিততে লড়াই কেবল উত্তর-দক্ষিণেই নয়। যুদ্ধ বেধেছে উত্তরের পুজো কমিটিগুলোর মধ্যেও। পাউন্ড রোড বাগানপাড়া (পশ্চিম) আর খাগড়া পাউন্ড রোড সর্বজনীন দুই মণ্ডপের মধ্যে দূরত্ব বড়জোর একশো মিটার। কিন্তু ওইটুকু দূরত্বে দু’টো পুজো কমিটির মধ্যে কি হাড্ডাহাড্ডি লড়াই-ই না বেঁধেছে! পাউন্ড রোড বাগানপাড়া (পশ্চিম) ৫ লক্ষ টুকরো ডায়মন্ড দিয়ে গড়েছে সপরিবার দেবী দুর্গা। মায় অসুর থেকে সিংহ-সহ প্যাঁচা, এমনকী ইঁদুরও বাদ যায়নি।
খাগড়া পাউন্ড রোড সর্বজনীনের পাল্টা দাবি, “কমিটির প্রায় ৯০টি সদস্য পরিবারের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ২ কেজি সোনা দিয়ে গড়া হয়েছে সপরিবার দেবীপ্রতিমা থেকে অসুর ও তাঁদের বাহন-সহ সবাইকেই।” তবে সোনা-হিরের বৈভব-বিতর্কের লড়াই-এ নেই অনতি দূরের নবরূপ সংঘ। মাটির হাঁড়ি-কলসি থেকে মৃৎ শিল্পের নানান উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে মণ্ডপ থেকে শুরু করে টেরাকোটার শৈলিতে প্রতিমা পর্যন্ত সব কিছুই। তাঁদের দাবি, শ্লিল্পের টানের কাছে হার মেনেছে বিত্তের অহংকার! দেবীর আরাধনা নাকি তাতেই সার্থক ও সফল! |
|
|
|
|
|