|
|
|
|
এই ৪ দিনের অপেক্ষায় প্রহর গোনে ঢাকি গ্রাম |
আনন্দ মণ্ডল • মেদিনীপুর |
ওঁরা কেউ জুতো সেলাই করেন, কেউ রিকশা চালান, কেউ বা দিনমজুরি করেন। ‘দিন আনি দিন খাই’ সংসারে পুজোর সময়েই যেটুকু অতিরিক্ত আয়। কিন্তু এই আর্থিক টানটুকুই সব নয়, পিতৃপুরুষের পেশা এখনও সযত্নে আঁকড়ে থাকার পিছনে রয়েছে রক্তের টান, শিল্প-সাধনা। তাই তো বছরভর এই চার দিনের অপেক্ষাতে থাকেন ওঁরা। ওঁদের ঢাকের বোলে দশভূজার আরাধনা হয় সার্থক।
পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাটের বোরোডাঙি, ছাতিন্দা, পাইকপাড়া, ধর্মবেড়, যোগীবেড়, শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লকের বামনআড়া শিউরি, চণ্ডীপুরের হাঁসচড়া, মহিষাদলের গোপালপুরের ঢাকি পাড়াগুলি এখন প্রায় ফাঁকা। মূলত তফসিলি জাতিভুক্ত এই সব পরিবারের অধিকাংশ পুরুষ সদস্যই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন এখন। কেউ কেউ রাজ্য ছাড়িয়ে দেশে কেউ বা বিদেশে।
পাখি যেমন সহজাত দক্ষতায় বাসা বোনে, ঢাকি পরিবারের ছেলেরা তেমনই বাপ-ঠাকুরদার হাত ধরে ঢাক-ঢোল-কাঁসি বাজাতে শিখে যায় ছেলেবেলাতেই। আর একটু বড় হলেই তিন-চার জনের দল গড়ে মণ্ডপে-মণ্ডপে যাওয়া শুরু। দেবী আরাধনার সঙ্গেই চলে শিল্প-সাধনা। বংশ পরম্পরায় গুরুনির্ভর এই শিল্প হাইটেক যুগেও সমান প্রাসঙ্গিক। আজও দুর্গাপুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ঢাকের সেই আদি-অকৃত্রিম বোল।
কোলাঘাটের পাইকপাড়ি গ্রামের শ্যামল প্রামাণিকও ঢাক বাজানো শিখেছেন বাবার কাছেই। বছর চল্লিশের শ্যামলের জুতো সারাইয়ের দোকান কোলাঘাট বাজারে। এ বার কোলাঘাটেরই একটি মণ্ডপে ঢাক বাজানোর দায়িত্বে তিনি। শ্যামলের কথায়, “বছরের ক’দিন আর ঢাক বাজানোর সুযোগ পাই। তাই পুজো এলে এই সুযোগ ছাড়তে পারি না। রোজগারও হয়। কিন্তু সেটাই সব নয়। টানটাই আসল।” ওই গ্রামেরই ঢাকি উত্তম ঘোড়ই বছরের অন্য সময় রিকশা চালান। বছর সাঁইত্রিশের উত্তম বলেন, “দাদু কালীপদ ও কাকা ভানু ঘোড়ই ছিলেন নাম করা ঢাকি। বাবা-কাকার কাছ থেকেই ঢাক বাজানো শিখেছি। তবে, আমরা এটাকে পেশা নয়, সাধনা হিসাবে দেখি। কিন্তু পরিবারের এই পরম্পরা কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারব তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।” আগে ভিন্ রাজ্যে ঢাক বাজাতে গেলেও এ বার কোলাঘাটেরই একটি মণ্ডপে ঢাক বাজাচ্ছেন উত্তম। তিনি বলেন, “পারিশ্রমিক তেমন মেলে না। ন্যূনতম যে সম্মানটুকু আশা করি, সেটাও এখন আর তেমন মেলে না। ফলে এই প্রজন্ম আর ঢাক বাজাতে চায় না। দিন দিন ঢাকির সংখ্যা কমছে।”
চণ্ডীপুরের হাঁসচড়ার মনোরঞ্জন দাস, মঙ্গল দাস, রতন দাসেরা জুতো সেলাইয়ের কাজ করেন বছরের অন্য সময়। ৭২ বছরের প্রবীণ মনোরঞ্জন বলেন, “গত ৫৫ বছর ধরে ঢাক বাজাচ্ছি। এ বারও গ্রামেরই পুজোমণ্ডপে ঢাক বাজাব।” হাঁসচড়ার অনেক ঢাকি অবশ্য চলে গিয়েছেন ভিন্ রাজ্যের পুজো মণ্ডপে। মঙ্গল, রতন গিয়েছেন বেঙ্গালুরুতে। বছরভরের দারিদ্র ভুলে ঢাক-ঢোল-কাঁসির বাজনায় ওঁরাই মাতিয়ে তুলবে পুজোর মণ্ডপ। |
|
|
|
|
|