বাড়ির পুজোকে ঘিরে মর্যাদার ত্রিকোণ লড়াই
রোমাঞ্চকর কাহিনি মোড়া বিত্ত আর মর্যাদার ত্রিকোণ লড়াই আজও চলছে রায়চৌধুরী, রায় ও দুয়ানি পরিবারের। তিন বাড়ির দুর্গোৎসবে তার প্রকাশ। প্রথম দুটি জমিদার বাড়ির দুই শরিকের পুজো। তৃতীয়টি প্রতিবাদের ও অধিকার প্রতিষ্ঠার। বারোয়ারি পুজোর দৌলতে এই তিন বাড়ির পুজো কৌলীন্য হারালেও আজও এর ইতিহাস মুখে মুখে ফেরে।
ইতিহাস অনুযায়ী, ষোড়শ শতকে মারাঠা আমলে বেশ কিছু এলাকা জায়গীর পান (বর্তমান এগরা-২ ব্লক এলাকার কিছু অংশ) রায় পরিবার। তার কিছুকাল পরে চৌধুরী উপাধিও পান তাঁরা। এই বংশের চৌধুরী ফতে সিংহরায়-এর আমলেই নাকি শুরু হয় দুর্গাপুজো। এঁরই উত্তরপুরুষ রাজবল্লভ, শ্রীবল্লভদের আমলে পুজোর ব্যাপক সমৃদ্ধি ঘটে। ইংরেজ শাসনের গোড়ার দিকে জমিদারি পাওয়ার সূত্রে এই পরিবারে ভাঙন ধরে। রায় পদবি নিয়ে একটি পরিবার চলে আসেন মাধবপুর গ্রামে। অন্য শরিক আসেন বৈঁচা (বারানিধি) গ্রামে। দু’পক্ষই স্থাপন করেন পৃথক গড়। পদবি ও মানসিকতার বিভেদ থেকে রায় ও রায়চৌধুরী পরিবারে চালু হল পৃথক পূজারীতিও। এ দিকে, উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ছোঁয়ায় যখন সাধারণ প্রজারাও নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করেছে, তখনই ঘটল সেই ঘটনা।
রায়চৌধুরীদের তখন পড়তি অবস্থা। কিন্তু বিত্তশালী রয়ে গিয়েছেন রায় পরিবার। সেই সময় ধনী জমিদারদের পুজোয় সকলের অংশগ্রহণের অধিকার ছিল না। তৎকালীন ‘দলিত’ মানুষজন মেনেও নিয়েছিলেন সেই রীতি। জনশ্রুতি, জায়গীর ও জমিদারি আমলে দ্বাররক্ষক, পাইক ও বরকন্দাজ হিসেবে এই পরিবারে কাজ করতেন স্থানীয় দুয়ারীরা। ‘দুয়ারী’ নাকি তাঁদের উপাধি। মাধবপুর গ্রামেই রায় পরিবারের জমিদারির গড়ের বাইরেই বাস দুয়ারীদের। সে সময়ই দুয়ারীদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ। বিচক্ষণ ও সুকৌশলী এক পুরুষ বাংলা ও ওড়িশার বিভিন্ন এলাকায় চষে বেড়িয়ে অনেক অর্থ ও সম্পত্তি করেন। সেই পুরুষই নিম্নবর্গীয়দের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় ও রায়বাড়ির পুজোকে টেক্কা দিতেই চালু করেন দুর্গাপুজো। রায় বাড়ির পুজোর প্রায় সম্পূর্ণ অনুসরণ করা হল দুয়ারীবাড়ির পুজোয়। এ পুজোয় সব জাত ও বর্ণের মানুষের ছিল অবাধ অংশগ্রহণ। দুয়ারী পরিবারের নারায়ণ দুয়ারী বলেন, “সে সময় মাতৃ-আরাধনার মাধ্যমে সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তো বটেই, আবার পরিবারের পুজো হলেও তা প্রথম থেকেই রূপ নিয়েছিল বারোয়ারি পুজোর।”
রায় পরিবারের সদস্য বিশ্বম্ভর রায়, প্রণবেশ রায়, বংশীপদ রায়রা বলেন, “জমিদারি পুজোয় সব মানুষেরই অংশগ্রহণ থাকলেও তা অবাধ থাকা সম্ভব ছিল না। দুয়ারীরা পুজো চালু করলেও সেই পুজোয় জাঁকজমক, বৈভব ছিল না। গ্রামবাসীরা মানত বা ব্রত করতেন এখানেই। রায় বাড়ির পুজো ঘিরেই গত দু’ দশকের আগে পর্যন্তও মানুষের ছিল ব্যাপক উন্মাদনা।” রায় ও দুয়ারী বাড়িতে পুজো হয় সতেরো দিনের। জিতাষ্টমী থেকেই ঘটোত্তোলন করে শুরু হয় পুজো। পুজো চলে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত। একচালার প্রতিমা। রীতি, বংশেরই পুরুষ পুরোহিত হয়ে প্রাচীন পুঁথি থেকে মন্ত্র পড়ে পুজো করবেন। রায়রা তা মানলেও অব্রাহ্মণ হওয়ায় মানতে পারেন না দুয়ারীরা। এক সময় বলি দেওয়ার প্রথা থাকলেও এখন আর তা নেই কোনও বাড়িতেই। রয়েছে শুধু নিয়মনিষ্ঠার কঠোরতা। অন্য দিকে, দুয়ারীদের উত্থানের তিন চার দশক পরে অর্থাভাবে পুজো সংক্ষিপ্ত করলেন রায়চৌধুরীরা। আর্থিক অবস্থার দুর্বিপাকে পুজো সতেরো দিন থেকে নেমে এল একমাত্র নবমীর দিনে। প্রতিমার বদলে পুজো পেলেন ঘট। ‘নিশা পূজা’র বদল ঘটে হল ‘দিবা পূজা’। অবস্থার পরিবর্তন ঘটল আবার কয়েক দশক পরে। এখন নতুন মন্দিরে একচালায় দীর্ঘদেহী প্রতিমা গড়ে দেবী পূজা পান রায়চৌধুরী বাড়িতেও। বিকাশ, প্রকাশ রায়চৌধুরীরা জানান, “আর্থিক কারণে নয়, পৃথক জমিদারির সূত্র ধরে পুজোপচারে বৈচিত্র্য আনতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল। তিনটি পুজোই আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।”
বারোয়ারি পুজোর উন্মাদনা সত্ত্বেও আজও এই তিনটি পুজোকে ঘিরে মেতে ওঠেন গ্রামবাসীরা। উধাও হয়েছে জাতের ভেদাভেদ। পুজো এখন সকলের। তবুও ইতিহাসের সূত্র ধরে তিনটি পুজো এলাকায় চিহ্নিত তিনটি নামেজমিদারের (রায় বাড়ি), প্রতিবাদের (দুয়ারী বাড়ি) ও পুনরুত্থানের (রায়চৌধুরী বাড়ি)।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.