|
|
|
|
‘রাজপুত্র’ থাকেন মাটির বাড়িতে, পুজোয় সর্বজন |
কিংশুক গুপ্ত • লালগড় |
যুগ বদলেছে, অস্ত গিয়েছে রাজ-মহিমা। রাজবাড়ি জীর্ণ। তাই রাজবংশের উত্তরপুরুষ ‘রাজপুত্র’কে থাকতে হচ্ছে মাটির বাড়িতে। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য নেই, নেই জৌলুসও। তবু পারিবারিক ঐতিহ্য ও স্থানীয় মানুষের আবেগকে মর্যাদা দিতে প্রতি বছর দুর্গাপুজোর আয়োজন করে আসছেন লালগড়ের সাহসরায় রাজপরিবারের উত্তরসূরিরা। এক সময়ে রাজাদের ব্যবহৃত অস্ত্রের পুজো হয় এখনও অষ্টমীর দিন।
পুজোর বয়স চারশো পেরিয়েছে। রাজপরিবারের পুরনো দস্তাবেজের তথ্য বলছে, বহু বছর আগে লালগড়ের অনতি দূরে শাঁখাখুল্যায় সাহসরায় বংশের রাজত্ব ছিল। পরে রাজা স্বরূপনারায়ণ সাহসরায় লালগড়ে প্রাসাদ নির্মাণ করেন। আর কাছেই তৈরি করেন এক দুর্গামন্দির। এখনও জীর্ণ রাজবাড়ির কাছের সেই দুর্গামন্দিরেই হয় দুর্গাপুজো। মন্দিরের গর্ভগৃহের দেওয়ালে খোদাই রয়েছে চুন-সুরকির দুর্গা। দুর্গাপুজোর পাঁচ দিন এই মূর্তিকেই পুজো করা হয়। দুর্গার পাশে লক্ষ্মী ও সরস্বতী থাকলেও, কার্তিক-গণেশ নেই। অনেকের মতে সিংহবাহিনীর দু’পাশের জয়া-বিজয়াই পরবর্তীকালে লক্ষ্মী ও সরস্বতীতে পরিণত হয়েছেন। |
|
সাহসরায় বংশের ‘শেষ রাজা’ ছিলেন পৃথ্বীশনারায়ণ। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র দর্পনারায়ণ সাহসরায় বর্তমানে পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে প্রতি বছর পুজো করছেন। প্রতিবছরই চুনসুরকির প্রতিমায় নবকলেবর হয়। পুজো হয় বিশুদ্ধ-সিদ্ধান্ত মতে। এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট, দেবীকে নিবেদন করা হয় বিশেষ এক সিদ্ধচালের ভোগ। কয়েকশো বছর ধরে এই প্রথাই চলে আসছে। তবে এই প্রথার কোনও ‘ব্যাখ্যা’ জানা নেই দর্পনারায়ণবাবুদের। লোকসংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের অবশ্য বক্তব্য, “রাঢ়বঙ্গের এই অঞ্চলের রাজপরিবারের দুর্গাপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানা জনশ্রুতি। সম্ভবত দুর্গাকে ঘরের মেয়ে উমা কল্পনা করেই সিদ্ধ চালের ভোগ দেওয়ার প্রথা চালু হয়েছিল।” স্থানীয় গবেষক পঙ্কজকুমার মণ্ডলের আবার মত, “সিদ্ধচাল তৈরি করতে খরচ বেশি। আতপ চালে খরচ কম। রাজ-আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবেই দেবীকে হয়তো বেশি দামের সিদ্ধচালের ভোগ নিবেদনের প্রথা চালু হয়েছিল।”
দর্পনারায়ণবাবু জানান, সপ্তমী, সন্ধিপুজো ও নবমীতে আখ, চালকুমড়ো, শশা ও জামির বলি দেওয়া হয়। মহাষ্টমীতে সিংহবাহিনী ও কুমারী পুজোও হয়। ওই দিনই পুরুষানুক্রমে রাজাদের ব্যবহৃত তলোয়ার, যা ‘ধূপখাঁড়া’ নামে পরিচিত, সেটিরও পুজো হয়। জনশ্রুতি, ওই ধূপখাঁড়া দিয়েই বর্গিহামলা প্রতিহত করে কয়েকশো বর্গির শিরোশ্ছেদ করেছিলেন সাহসরায় বংশের রাজারা।
দর্পনারায়ণবাবুর আক্ষেপ, ঐতিহ্যের দুর্গাপুজো চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার খরচ অনেক। সরকার থেকে বার্ষিক দেবত্র বাবদ যে টাকা দেওয়া হয়, তাতে পুজোর খরচ ওঠে না। অনেক কষ্ট করেই এখন পুজো চালাতে হয়। দর্পনারায়ণবাবু বলেন, “জানি না এ ভাবে কতদিন পারব।” রাজপরিবার এখন বিভিন্ন শরিকে ভাগ হয়ে গিয়েছে। জীর্ণ রাজবাড়িটিতে কয়েকটি পরিবার থাকেন। কিন্তু খোদ ‘রাজপুত্র’ দর্পনারায়ণবাবুর ভাগের অংশটি এতটাই জীর্ণ যে তিনি কিছুটা দূরে আখড়াগোড়ায় টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট মাটির বাড়িতে স্ত্রী-পুত্রকন্যাদের নিয়ে থাকেন।
সঙ্কটের মধ্যেও পুজো আসে। অব্যক্ত এক আনন্দের সুর খেলে যায় মনে। রাজাও আজ প্রজার সমাসনে। সাহসরায়দের পুজোও তাই এক অর্থে সর্বজনীন। গত দু’বছর পুজোর আনন্দে ছায়া ফেলেছিল অশান্তি। এ বার পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। শরৎআলোয় তাই উদ্ভাসিত লালগড়। |
|
|
|
|
|