সন্ধ্যা নামতে না নামতেই পথে জনতার ঢল। অলিগলিতে জনস্রোত। তিল ধারণের জায়গা নেই মণ্ডপের ভিতরে। সপ্তমীর সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত হুগলির বিভিন্ন প্রান্তে চেটেপুটে পুজোর রকমারি আয়োজনের স্বাদ নিলেন দর্শনার্থীরা। গত কয়েক বছর ধরেই হুগলিতে থিমপুজোর জোয়ার এসেছে ভাল রকম। এ বারেও শ্রীরামপুর, বৈদ্যবাটি বা চুঁচুড়া থিমের পুজোর স্রোতে ভেসেছেন উৎসবের আনন্দে উদ্বেল মানুষ।
বহু উদ্যোক্তাই পরিবেশের কথা মাথায় রেখে তাঁদের পুজো পরিকল্পনা সাজিয়েছেন। শ্রীরামপুরের বঙ্গলক্ষ্মী বাই লেনের পুজোয় পরিবেশ দূষণের নানা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। দূষণ থেকে জীবজগতের ক্ষতির মাত্রা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। দূষণ রোধ করতে গাছগাছালি লাগানোর প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরা হয়েছে। উত্তরপাড়ার জয়কৃষ্ণ স্ট্রিটে আপনাদের দুর্গাপুজো কমিটি তাদের মণ্ডপে পরিবেশ দূষণ এবং তা রোধ করা সংক্রান্ত বিভিন্ন পোস্টার লাগিয়েছে।
একই ভাবে সাধারণ মানুষের জন্য পরামর্শ থাকছে ভদ্রকালী ইউথ কোর এবং উত্তরপাড়া চরকডাঙা অ্যাসোসিয়েশনের পুজোতেও। বৈদ্যবাটির নিমাইতীর্থ রোড মধ্যাঞ্চল পুজো কমিটি গাছের চারা বিলি করেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। প্রশাসনের তরফেও এ বার জোর দেওয়া হয়েছিল দূষণ রোধ সংক্রান্ত প্রচারের উপর। জেলার বহু পুজো কমিটিই সেই নিয়ে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
পরিবেশ নিয়ে চিন্তাভাবনার পাশাপাশি থিমের বৈচিত্রে একে অপরকে টেক্কা দিতে তৈরি পুজোগুলি। কোন্নগর দক্ষিণপাড়া সর্বজনীনের পুজো এ বার ৫৯ বছরে পড়ল। প্রতিমা, কাঠের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি মণ্ডপ, চন্দননগরের আলোর বৈচিত্র্য এ বারেও দলে দলে মানুষকে টেনে আনছে। ভদ্রকালী ইউথ কোরের মণ্ডপ নির্মিত হয়েছে রবীন্দ্রভাবনায়। স্লেট-পেন্সিলে সহজ পাঠ ছাড়াও কবির বিভিন্ন বয়স এবং বিশেষ মূহূর্তের ছবি তুলে ধরা হয়েছে। মণ্ডপের ভিতরে লেজারের মাধ্যমে বিভিন্ন আঁকিবুকি কচিকাঁচাদের আনন্দ দিচ্ছে।
শ্রীরামপুরের জগন্নাথ ঘাট লেনের মণ্ডপ তৈরি হয়েছে রাবণের যজ্ঞগৃহের আদলে। ‘ধার্মিক রাবণ’কে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এখানে। মণ্ডপের ভিতরের কারুকার্য প্রশংসনীয়। ১৯-এর পল্লির মণ্ডপে থাকছে সুদৃশ্য বিভিন্ন মডেল।
মাহেশ কলোনী সর্বজনীন হাজির হয়েছে মিথিলার মধুবনী শিল্পের কাজ নিয়ে। পট বা কাঠ খোদাই করে তৈরি করা মডেল নজর কাড়ছে দর্শনার্থীদের। প্রতিমা এবং মণ্ডপে নজর কেড়েছে ভাগীরথী লেন ভিতরের মাঠ। সদগোপপাড়ার প্রকাশ সঙ্ঘের পুজোটি হচ্ছে ছিমছাম পরিবেশে। ঢুলিপাড়ার শ্রীরামপুর সেবা সমিতির পুজো ভাবনায় উঠে এসেছে ‘কবিপ্রণাম’। স্লেট-পেন্সিলে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ‘সহজ পাঠ’। বৈচিত্রে দর্শকদের নজর কাড়ছে টিনবাজার সর্বজনীনের পুজোটিও। হরিভক্তি প্রদয়িনী সভা, বান্ধব সমিতি, হরবাবুর ঘাট, চিত্তরঞ্জন অ্যাথলেটিক ক্লাব, গড়গড়ি ঘাট সর্বজনীনের মতো ঐতিহ্যবাহী পুজোগুলি এ বারও ভিড় টানছে।
হুগলি-চুঁচুড়াতেও থিমের ছড়াছড়ি। চুঁচুড়ার কামারপাড়া সর্বজনীনের পুজোর থিম ‘চোখের আলো’। দেশ বিদেশের ১২৫ রকম বিভিন্ন আকারের লক্ষাধিক প্রদীপ দিয়ে মণ্ডপ নির্মাণ করা হয়েছে। পার্বতী রায় গলি সর্বজনীনের মণ্ডপ এবং প্রতিমা তৈরি হয়েছে বিস্কুট দিয়ে। খড়ুয়াবাজার সর্বজনীনে উঠে এসেছে সাঁওতাল পরগনা। জঙ্গলমহলে আদিবাসী নারী-পুরুষের জীবনযাত্রা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এখানে।
ছোটদের প্রিয় টম অ্যান্ড জেরির গল্প সম্বলিত কার্টুন চরিত্র মিকি মাউস হাজির ঠাকুরগলি সুকান্ত সঙ্ঘে। হর-গৌরীতলা সর্বজনীনের মণ্ডপে গেলে দেখা যাবে বাঁশ, টালি, টেরাকোটার চোখ ধাঁধানো কাজ। মতিবাগান আমরা ক’জন ক্লাবের পুজোয় কাচের উপর প্লাস্টিক রঙের প্রলেপ নজর কাড়বে।
এই পুজোর থিম ‘আঁকিবুকির আয়নায় দেবীবন্দনা’। পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে মুনি-ঋষিদের তপস্যার কাহিনী তুলে ধরেছে পেয়ারাবাগান উদয় সঙ্ঘ। বিভিন্ন আকারের নৌকার মাধ্যমে ছোটবেলার স্মৃতি তুলে ধরেছে ৪৬ বছরের পুরনো শ্যামবাবুর ঘাট সর্বজনীন। পাহাড়ের উপর কৈলাস মন্দিরে খোদাই করা কারুকার্য দেখতে যেতে হবে হুগলি স্টেশন দুর্গোৎসব কমিটির পুজো মণ্ডপে।
হীরক জয়ন্তী বর্ষে চকবাজার সর্বজনীন দুগোৎসব কমিটির পুজোর থিম শক্তিরূপে সনাতনী। মাদুর, ঝুড়ি, কুলো, পাখা দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ পাঠ’ তুলে ধরা হয়েছে ব্যান্ডেলের কেওটা উজ্জ্বল সঙ্ঘের পুজোয়। ৪০ ফুট উঁচু মণ্ডপে প্রবেশ কতরলে চোখে পড়বে সহজপাঠের যাবতীয় সংকলন। লালপেড়ে শাড়িতে গ্রাম্য মহিলার বেশে দেবী দুর্গা।
নারকেল গাছের বিভিন্ন অংশ দিয়ে তৈরি হয়েছে রবীন্দ্রনগর সর্বজনীনের মণ্ডপ। তপস্যারত সাধক বামাক্ষ্যাপাকে দেখা যাবে কুমারগলি সর্বজনীনের পুজোয়। তারাপীঠ শ্মশানের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে এখানকার পুজোয়। ব্যান্ডেল স্টেশন রোড সর্বজনীনের মণ্ডপ তৈরি হয়েছে পরিবেশ বান্ধব উপকরণ দিয়ে তৈরি মণ্ডপ। থাকছে হস্তশিল্পের সুদৃশ্য মডেল। নজর কাড়ছে সাবেক প্রতিমা। |