কিছু পুরনো কালে অষ্টমীর ভোগের মতোই পুজোয় গানের জলসা ছিল স্বতঃসিদ্ধ। নতুন জামার
মতোই আপ্যায়ন পেত নতুন গান। রাতজাগা সব শিহরনে মজুত থাকত সুরেলা কণ্ঠ, আশ্চর্য সুর,
স্টারদের চর্মচক্ষে দেখার বোনাস। আয়ু কিছু বাড়ত বইকি।
অবন বসু |
আপনারা দয়া করে একটু চুপ করে বসুন! ঘোষকের কথায় যদিও কাজ হল না তেমন। ফলে আবারও চিৎকার, হইচই। অবিলম্বেই পরবর্তী ঘোষণা: এ বার আপনাদের সামনে আসছেন বাংলার মঞ্চ ও চলচ্চিত্র জগতের দুই শ্রেষ্ঠ কৌতুকাভিনেতা জহর রায় এবং নৃপতি চট্টোপাধ্যায়! ব্যস্, হট্টগোল থেমে পিন-পড়া স্বব্ধতা, রেশ কাটতে না কাটতেই গোটা মাঠ প্রচণ্ড করতালির শব্দে ফেটে পড়ল!
সত্তর দশকের গোড়ার দিক। উত্তর শহরতলির সবচেয়ে খোলামেলা আর সেরা মাঠ বলতেই তখন সাহেবি ময়দান। আকাশছোঁয়া বড় বড় সেগুন, শিরীষ আর মেহগনি-ঘেরা মাঠ। হাজার কয়েক লোকের ময়দানে বসা শারদীয় জলসা-রাতেই হঠাৎ অমন লোভনীয় ঘোষণা আর তার ততোধিক স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া!
এরই মাঝে ময়দানের মন-মাতানো জলসার রাত। বাৎসরিক সেই মেহফিলের গুণিজন-তালিকায় কে নেই! প্রতিমা, উৎপলা, সতীনাথ, হেমন্ত, তরুণ, দ্বিজেন, মানবেন্দ্র, আরতি, সুদাম দিকপাল-সমাবেশ! সেই সঙ্গেই তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী, এক-দেড় ঘণ্টা গানের ফাঁকে ধুরন্ধর কোনও আবৃত্তিকার কি হরবোলা শিল্পী, কৌতুকাভিনেতা বা মূকাভিনেতারও অন্য ধারার বিনোদন।
ঘোষণা-প্রসঙ্গে আবার ফিরে যাই। মনে আছে, অত বড় অডিয়েন্সকে শান্ত করার জন্য দুই স্বনামধন্যের নাম ঘোষণা করা হলেও প্রথমে এলেন জহর রায়। আর এসেই ওঁর বাচনভঙ্গিতে এমন একেকটি হাসির বোমা ফাটাতে লাগলেন যে, গোটা মাঠেই হাসির ঢেউ। পরের ধাক্কায় শ্রোতাদের অনুরোধে ওঁর কিছু কমেডি-ছবির সংলাপ ও অভিনয়। হাসতে হাসতে দর্শকদের অবস্থা শোচনীয়।
ওঁর সময়সীমা ততক্ষণে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যেতে উদ্যোক্তারা পড়লেন চরম অস্বস্তিতে। তার ওপর সেরা-আকর্ষণ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে স্টেজ দিতে হবে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে। ফলে উইংয়ের এক পাশ থেকে বেরিয়ে এল একফালি চিরকুট... এবং জহর তা পড়া মাত্রই এক লাফে মঞ্চের একেবারে সামনে এসে কেমন ভয়-পাওয়া গলায় বললেন, “একটা খুব সব্বোনাশ হয়েছে মশাই! আর থাকা যাবে না এখানে!” পরক্ষণেই সামনের দিক থেকে ‘কেন? কেন? কেন?’ অজস্র প্রশ্নের ঢেউ। এ বার আড়চোখে গ্রিনরুমের দিকটা দেখেই জহর অনেকটা গলা নামিয়ে বললেন, “ওই যে ওরা জানিয়ে গেল, এর পর প্রহ্লাদ নাকি তার জহ্লাদের মতো চেহারা নিয়ে আসছে আপনাদের আহ্লাদ দিতে! তা, এর পরও কি আমার সাহস করে থাকা উচিত, বলুন? কাজেই চলি। নমস্কার।” |
এখনও সেই নিশিবাসরের অন্য রসরাজ নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের কথা বলা বাকি। যদিও তিনি মঞ্চে এসেছিলেন মধ্যরাতপার করে। তা, মানুষজনকে চমকে দিয়েই নৃপতি এলেন কেমন অসুস্থ রোগীর মতো কাঁপা পায়ে এটা-ওটা ধরে। আর মাইকের সামনে দাঁড়ালেন যখন, শ্রোতাদের মাথায় হাত! এ কী! সর্বজনপ্রিয় ওঁর সেই দরাজ গলা কোথায়? ক্ষীণ কণ্ঠের টুকরোটাকরার সারমর্ম এই যে সবে মাত্র এক সাংঘাতিক হৃদরোগের ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছেন উনি। ফলে অনুষ্ঠান করার অবস্থায় নেই। শ্রোতারা যেন ওঁকে ক্ষমা করেন...ইত্যাদি ইত্যাদি।
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই শ্রোতাদের চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল চার দিক থেকে ‘কমেডিয়ানের নামে এ রকম হেঁপো রুগি নিয়ে আসার মানে কী! এ তো রীতমতো লোক ঠকানো!’ হইচই-চিৎকারে সে এক যাচ্ছেতাই অবস্থা। কিন্তু তার মধ্যেই লোকে হঠাৎ কেমন এক ধাক্কায় চুপ করে গেল একটা চেনা গলার বাজখাঁই হুঙ্কার কানে আসতে। নৃপতি ততক্ষণে উচ্চতম স্বরগ্রামে এবং অডিয়েন্সের দিকে দীর্ঘ তর্জনী উঁচিয়েই বলতে শুরু করেছেন“শাহজাদি! মৃত্যুভয় দেখাও কাহারে? জানো না কি, তাতার বালক সিংহশিশু সনে করে খেলা!” ইত্যাদি তখনকার মঞ্চখ্যাত এক নাট্য সংলাপ।
আসলে কারও মাথাতেই আসেনি যে, অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসাবেই ওই রোগগ্রস্ততার অভিনয়! গোটা ব্যাপারটাকে চরম মুনশিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন যিনি, সেই নৃপতিই লাটাই ধরে রেখেছিলেন টাইমিং ব্যাপারটির। ‘এ জীবনে মোর যত কিছু ব্যথা’ বা ‘তোমার জীবনে ফুলের মেলা’ ছেলেবেলায় প্রথম শোনা জলসাতেই। দেবীপক্ষের রাতগুলোতে ঘুম ভেঙে হঠাৎ হঠাৎ কানে এসেছে ‘কে তুমি আমারে ডাকো’ বা ‘হয়তো কিছুই নাহি পাব’-র অথৈ আবেশ।
গান যারা ভালবাসে, তাদের এই এক রোগ। কাছে হোক বা দূরে হোক, জলসার টান কিছুতেই যায় না।
আর এক অভিজ্ঞতা: মাঝরাতের কিছু পরে জলসা যখন প্রায় শেষের মুখে। শ্যামল মিত্রের গাড়ি প্যান্ডেল ছেড়েছে। ঠিক তখনই স্থানীয় কিছু যুবকের জোরাজুরিতে অনেকটা ওই সমাপ্তি-সংগীত গাওয়ানোর শর্তেই শেষ শিল্পী হিসাবে যাঁকে মঞ্চে তোলা হল, তাঁকে দেখে তো মাঠভর্তি লোকের আক্কেল গুড়ুম! ঝাড়া সাত ফুটের কাছাকাছি কালো-কুচকুচে মানুষটির পরনে আবলুশ-কালো পাঞ্জাবি! স্লেটরঙা একটা প্যান্ট আর কাপড়ের জুতো। মাথায় কুচিকুচি চুল। আর রক্তজবার মতো চোখ!
গোটা অডিয়েন্সের সেই হতবাক অবস্থার মধ্যেই মাইকে ঘোষণা হল, “ইনি একজন আফ্রিকান ট্যুরিস্ট। এবং শখের গায়ক। ক’দিনের জন্য শহরে এসেছেন এখানকার পুজো দেখতে। এঁর গলায় আজকের অনুষ্ঠানের শেষ গানটি শুনতে অনুরোধ জানাই।” ইতস্তত করেও সকলে বসার পর দেখি, আকর্ষণের চেয়ে সবার কৌতূহলই বড়। লোকটা এখানে এল কার সঙ্গে? গাইবেই বা কী?
তা, শ্রোতাদের দিকে হাতজোড় করে, মাথা ঝুঁকিয়ে সেই দূরদেশি ভদ্রলোক শুধু বললেন, “নোম্স্কর।” এর বেশি ভাষাও বোধহয় ওঁর জানা ছিল না। ফলে শব্দটুকু শেষ হওয়া মাত্রই মঞ্চের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে জ্বালানো হল শুধু একটি লাল রঙের জোরালো ফোকাস শিল্পীকে যা অনুসরণ করবে প্রতিটি পদক্ষেপে।
লাল-কালো মঞ্চের দৃশ্যরূপ তখন গা-ছমছমে! ওই অবস্থার মধ্যে হাতজোড় করে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই অতিথি-শিল্পী হঠাৎ এক অনবদ্য বিকৃত উচ্চারণ আর যথেষ্ট শুদ্ধ সুর মিলিয়েই জোরালো গলায় গেয়ে উঠলেন, ‘জোডি টর ডাকস্ উনিকোউ নাআআআসে...’!
হ্যাঁ, ওই একটি গানেই দুই গোলার্ধের দুই ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন বেশ, এমনকী ভিন্ন রূপেরও সব ব্যবধান ঘুচে গেছিল সে রাতে! |