আয় ব্যয়ের হিসাব সংসারে যেমন, সরকারেরও তেমনই। আয়ে ঘাটতি হইলে সংসারে যেমন ধার করিতে হয়, সরকারকেও তেমনই ধার করিতে হয়। কোনও অর্থবর্ষে মোট কত টাকা বাজার হইতে ধার করিতে হবে, বৎসরের সূচনায় তাহার একটি হিসাব সরকারের নিকট থাকে। সেই হিসাব বাজেটে পেশ করা হয়। তাহাকে বলা হয় ঋণের বাজেট অনুমান। বর্তমান অর্থবর্ষে যেমন সরকারের অনুমান ছিল, বাজার হইতে মোট এক লক্ষ সাতষট্টি হাজার কোটি টাকা ধার করিতে হইবে। বলিয়া রাখা ভাল, সব সরকারই বাজার হইতে ঋণ করে। স্বাভাবিক অবস্থায় তাহাতে উদ্বিগ্ন হইবার কারণ নাই। কিন্তু, সরকার যখন তাহার বাজেট অনুমান ছাপাইয়া আরও অনেক বেশি ঋণ করিতে উদ্যত হয়, তখন উদ্বেগ স্বাভাবিক। ভারতে এখন সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হইয়াছে। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক জানাইয়াছে, বাজেট অনুমান অপেক্ষা আরও ৫৩,০০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত অর্থ ঋণ করা হইবে। অতিরিক্ত ঋণের পরিমাণ বাজেট নির্ধারিত অঙ্কের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। উদ্বেগের কারণই বটে। অর্থ মন্ত্রক বলিয়াছে, স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ অনুমান অপেক্ষা কম হওয়াতেই এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হইয়াছে। ইহা একটি কারণ হইতে পারে, একমাত্র নহে। বস্তুত, ইহা মুখ্য কারণও নহে। অর্থবর্ষে মোট কত আয় হইবে, বাজেট রচনা করিবার সময় সরকার তাহা অনুমান করার চেষ্টা করে। বাস্তবভিত্তিক অনুমান। এই বৎসরের অনুমানটি ভ্রান্ত প্রমাণিত হইয়াছে। বাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ কমিয়াছে, উৎসাহও কমিয়াছে। শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনের হারও মাঝে মাঝেই উদ্বেগজনক হইয়া উঠিয়াছে। বিনিয়োগ কমিলে আয় কমে, সরকারের রাজস্বের পরিমাণও কমে। ফলে, রাজকোষে টাকার অভাব দেখা দেয়। উল্লেখ্য, অগস্ট মাস পর্যন্ত পাওয়া হিসাবে সরকারের রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ বাজেটে প্রস্তাবিত রাজস্ব ঘাটতির ৬৬ শতাংশে পৌঁছাইয়া গিয়াছে।
পরিস্থিতি সুবিধার নহে। সরকার বাজার হইতে বিপুল পরিমাণ ধার করিলে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের পক্ষে ধার পাওয়া কঠিন হইয়া পড়ে। অর্থনীতির পরিভাষায় ইহার নাম ‘ক্রাউডিং আউট’। বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা যথেষ্ট ঋণ না পাইলে বাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ আরও কমিবে। তাহার ফলে আয়ের পরিমাণও কমিবে। ইহা একটি দুষ্ট চক্রের জন্ম দিতে পারে। সরকারের কর্তব্য, বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে উৎসাহ প্রদান করা। রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ যে গতিতে বাড়িতেছে, তাহাতে বাজেটে প্রস্তাবিত রাজকোষ ঘাটতির মাত্রাটি বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব। এই বৎসর রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ জি ডি পি-র ৪.৬ শতাংশ বা তাহার কমে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান সি রঙ্গরাজন বলিয়াই দিয়াছেন, রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ প্রস্তাবের তুলনায় বেশি হইবে। এই ক্ষেত্রে পথভ্রষ্ট হওয়া বিপজ্জনক হইতে পারে। সমস্যার একটিই স্থায়ী সমাধান আছে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির প্রশ্নটিকে আরও গুরুত্ব দিতে হইবে। গত এক বৎসর ধরিয়া সরকারের প্রধান মাথাব্যথা মূল্যস্ফীতি লইয়া। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আচরণ এখন কার্যত মোল্লা নাসিরুদ্দিনকে মনে পড়াইতেছে। মোল্লা যেমন ঘরে চাবি হারাইয়া বাগানে তাহার সন্ধান করিতেছিলেন কারণ বাগানে আলো ছিল, রিজার্ভ ব্যাঙ্কও সুদের হার বাড়াইয়া মূল্যস্ফীতির সমাধান করিতে চাহিতেছে, কারণ সুদের হার বাড়ানো ব্যাঙ্কের করায়ত্ত। এত দিনে স্পষ্ট, মূল্যবৃদ্ধির সমস্যাটির উৎস আর্থিক নীতি নহে, তাহা ভারতের কাঠামোগত সমস্যার ফল। সুদের হার বাড়াইয়া সেই সমস্যার সমাধান হইবে না, বরং আর্থিক বৃদ্ধির গতিভঙ্গ হইবে। এখনই সাবধান না হইলে ভবিষ্যতে বৃহত্তর বিপদ অপেক্ষা করিয়া থাকিবে। |