রাজনীতিতে কোনও পূর্ণচ্ছেদ নেই। এই বিশ্বাসকে পুঁজি করেই সিপিএম ধীরে ধীরে ভবিষ্যতের চলার রাস্তা খুঁজে বার করতে তৎপর হচ্ছে। দিল্লিতে সদ্যসমাপ্ত পলিটব্যুরো বৈঠকের পরে দলের রাজ্য সম্পাদক প্রকাশ কারাট বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে এখনও পরিস্থিতির সে ভাবে কোনও বদল হয়নি। এই অবস্থায় আগামী বছর এপ্রিলে পার্টি কংগ্রেসে দলের আশু রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণের চেষ্টা করছেন সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্ব।
সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য নিরুপম সেন দলের দৈনিক মুখপত্রের শারদ সংখ্যায় ‘বাধা পেরিয়ে এগোতে হবে’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘বর্তমান সময়ে আমাদের রাজ্যে বামপন্থী আন্দোলন এক নতুন পথে প্রবেশ করেছে। দীর্ঘ সাড়ে তিন দশক ক্ষমতাসীন থাকার কারণে বর্তমানে বামপন্থী আন্দোলনের বেশির ভাগ সক্রিয় কর্মী, সদস্য, বিশেষ ভাবে সিপিএমের যাঁরা সদস্য, তাঁদের সিংহভাগেরই বিরোধী দলে থাকার অভিজ্ঞতা নেই।...এঁরা আজ নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি।...বর্তমান পরিস্থিতির উপযোগী করে নিজেদের গড়ে তুলতে যে মতাদর্শগত বিশ্বাস ও কর্মধারা প্রয়োজন, তার জন্য সকলকে প্রস্তুত হতে হবে’। নিরুপমবাবু বলেন, এটা শুধু নতুন কর্মীদের ক্ষেত্রে নয়, পুরনোদেরও বিরোধী দলে কাজ করার জন্য নতুন ভাবনাচিন্তা নিয়ে প্রস্তুত হতে হবে।
আসলে শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, গোটা পৃথিবী জুড়েই সমাজতন্ত্রের পরিবর্তন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। ভারতেও সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্ব, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক ‘পরিবর্তনে’র পরে, দলীয় মতাদর্শের পরিবর্তন নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন। চিনের কমিউনিস্ট পার্টির ৯০তম প্রতিষ্ঠাবর্ষে হু জিন তাও এক ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়েছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, সমকালীন চিনে দুর্নীতি, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, অযোগ্যতা, ক্ষমতার মোহে আক্রান্ত কমিউনিস্ট পার্টি। চিনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতির পুনর্মূল্যায়ন করার কথাও বলেছেন হু জিন তাও।
এই পটভূমিতে এপ্রিলের পার্টি কংগ্রেস দলের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সিপিএমের বেশ কিছু নেতা মনে করছেন, জাতীয় স্তরে প্রকাশ কারাট-সীতারাম ইয়েচুরির মাধ্যমে ইউপিএ বিরোধিতাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে প্রচারের আলোয় থাকুক সিপিএম। পাশাপাশি, রাজ্য স্তরে বিধানসভায় বিরোধী দল হিসেবে সিপিএম সূর্যকান্ত মিশ্রের নেতৃত্বে ‘সহযোগিতা’র রাস্তায় যেমন হাঁটছেন, তেমন হাঁটুন। কিন্তু সাংগঠনিক স্তরে দলের এখন ‘অ্যাকটিভ ইনারসিয়া’ বা সক্রিয় নিষ্ক্রিয়তার রণকৌশল নেওয়া উচিত। প্রকৃতির নিয়মে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সম্পর্কে ক্রমশ মানুষের ‘মোহভঙ্গ’ হবে, এমনটাই আশা সিপিএম নেতৃত্বের। সেই ‘মোহভঙ্গে’র প্রক্রিয়ায় দল যত কম সক্রিয় অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে, ততই ভাল। বছরখানেক পরে আন্দোলনের কর্মসূচি স্থির করা উচিত। যে কথা দলের রাজ্য কমিটির তরফে প্রকাশিত একটি পুজো সংখ্যায় স্পষ্ট করেই ব্যাখ্যা করেছেন সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য তথা রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু।
এই এক বছরের ভিতর বরং দলের দুর্বলতাগুলিকে কাটিয়ে তোলার চেষ্টায় ব্রতী হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন সিপিএম নেতারা। দলের প্রবীণ কাণ্ডারী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এ বার শারদ সংখ্যায় সম্ভবত এই কারণেই কোনও রাজনৈতিক বিশ্লেষণে না-গিয়ে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে। তবে সেই নিবন্ধেও তিনি বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েত ইউনিয়নের যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা, ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্র’ তা সমর্থন করেননি। এ সম্পর্কে তিনি সন্দিহান ছিলেন যে, কত দিন এই ব্যবস্থা এমন ভাবে চলতে পারবে। বুদ্ধবাবু লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনা আজ ভীষণ ভাবে ‘প্রাসঙ্গিক’। বামপন্থী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথকে অবজ্ঞা করা ভুল হয়েছিল বলে মেনে নিয়েই তিনি বলেছেন, ভবিষ্যতে বামপন্থী আন্দোলনে রবীন্দ্র-ভাবনার প্রাসঙ্গিকতা থাকবে।
নিরুপমবাবুও তাঁর নিবন্ধে স্বীকার করে নিয়েছেন, দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ যেমন এক দিকে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে প্রসারিত করেছে, তেমনই অন্য দিকে ক্ষমতাকে ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করার প্রবণতাও দেখা দিয়েছে। যে কোনও উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার একটি অগণতান্ত্রিক ঝোঁক অনেকের মধ্যেই প্রবল হয়েছে। উপর থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। জমি-বিতর্কে দলের বাইরে শুধু নয়, দলের ভিতরেও যে বহু বামপন্থী বিদ্বজ্জন বিরোধিতার অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, তাতে দলের ভিত্তি আরও দুর্বল হয়েছে।
দলীয় শারদ সংখ্যায় বিমানবাবুও তাঁর নিবন্ধে বলেছেন, রাজ্য সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুসারে গ্রাম ও শহরের মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ তৈরি করে ভোটের সময়ে মত বিনিময়ের যথেষ্ট চেষ্টা করতে দল ব্যর্থ হয়েছে। কোনও কোনও জেলায় মাত্র ১০% মানুষের বাড়িতে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। বিমানবাবু বলেছেন, এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা ‘চিরস্থায়ী’ হতে পারে না। কিন্তু এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, এর পরিবর্তন অল্প সময়ের ব্যবধানেই ঘটে যাবে। আর পরিবর্তন ‘স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে’ও হবে না। রাজ্য কমিটি থেকে নিচু তলার কমিটি পর্যন্ত প্রত্যেক কর্মীকে সাংগঠনিক ঢিলেঢালা অবস্থা কাটাতে হবে।
প্রশ্ন হল, কী ভাবে তা সম্ভব হবে? চিনের হু জিন তাও যা বলেছেন আর দলীয় মুখপত্রে বিমান-নিরুপম যা বলছেন, তার মধ্যে একটি যোগসূত্র আছে বলে সিপিএম নেতারা মনে করছেন। তবে সিপিএম নেতারা এ-ও বুঝতে পারছেন, নতুন পরিস্থিতিতে বিরোধী দলে থেকে দলের মতাদর্শগত অভিমুখ নতুন করে তৈরি করতে হবে, এটা যেমন সত্য, তেমনই প্রয়োজনে কিছু সুনির্দিষ্ট আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণেরও দরকার রয়েছে। বুদ্ধ-নিরুপম কিন্তু এখনও মনে করেন, বিরোধী দলের সেই আন্দোলনেরও চরিত্রগত পরিবর্তন হবে। ষাট-সত্তরের দশকের বিরোধী বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে নিশ্চয়ই এই আন্দোলনের চরিত্র এক হবে না। কতটা ‘গঠনমূলক’, কতটা ‘নেতিবাচক’ হবে সেই আন্দোলন, তা স্থির করাই এ বার পার্টি কংগ্রেসে দলের সব চেয়ে বড় কাজ। |