পুজোর কথা বলতেই মনে পড়ে, রাত জেগে বাবার সঙ্গে ঠাকুর দেখা। উত্তর কলকাতার বিভিন্ন মণ্ডপ মহম্মদ আলি পার্ক, সিমলা ব্যায়াম সমিতি। চোখের পাতা যখন ভারী হয়ে যেত, ভাইবোনেরা একে অন্যের কাঁধে ঢলে পড়তাম। তখন প্রায় চ্যাংদোলা করে গাড়ি থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া এই ছিল বাবার সঙ্গে ঠাকুর দেখার ছবি। আর এতগুলো বছর পরে আমার ছেলের সঙ্গে ঠাকুর দেখার ছবিটা একদম বদলে গেছে!
পার্লে-আনন্দবাজার পত্রিকা শারদ অর্ঘ্যের জন্য ঠাকুর দেখতে গিয়ে কোথাও সেই পুরনো আনন্দটা আবার যেন ফিরে পেলাম। বুকটা টনটন করে উঠল। এখন পুজো কত সংগঠিত। শিল্পীদের ভাবনায় আগের সেই সাবেক ঠাকুর, চন্দননগরের আলো বদলে গিয়ে আলো হয়েছে চাঁদনি। ‘বাউন্স লাইট’ এবং অনেক শিল্পসম্মত ভাবে আলোর ব্যবহার হচ্ছে, পাল্টে গিয়েছে মঞ্চসজ্জা এবং প্রতিমা। দেখলে অবাক লাগে যে, মাত্র এই পাঁচ দিনের জন্য এতটা সিরিয়াস চিন্তাভাবনা শিল্পীদের এবং উদ্যোক্তাদের আছে।
এ বার যে পাঁচটি ঠাকুর দেখলাম, তার মধ্যে ঠাকুরপুকুর ক্লাবের বিষয় ও মণ্ডপ পরিকল্পনা স্বাতন্ত্র্যের দাবি রাখে, কিন্তু উৎসবের মেজাজের মধ্যে আলোর ব্যবহার যেন অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেহালায় বুড়ো শিবতলা জনকল্যাণ সঙ্ঘের পরিবেশে উৎসবের মেজাজ আছে। বাউল গান, বাঁশি এবং একটা গ্রামীণ পরিবেশ সৃষ্টি হয় বটে, তবে উৎকর্ষের মাপকাঠিতে অন্যেরা ছিল অনেক এগিয়ে। সেলিমপুর পল্লি স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন ক্লাব-এর পুজোয় গেলে সিস্টিন চ্যাপেলের ভাবনা মনের মধ্যে উকিঝুঁকি মারে। ঢোকার পথের দু’ধারে স্টিক ফিগারের ছবিও মুহূর্ত সৃষ্টির দাবি রাখে।
পাশাপাশি, নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের প্রতিমা ও মণ্ডপ প্রধানত পিতল আর কাঠের। এত সুন্দর, দেখলেই মনে হয় ‘শ্রাবস্তীর কারুকার্য’। কিন্তু, অনেক পুজোই আমরা দেখি, যেখানে উৎকর্ষের পিছনে অর্থটাও বড় বিষয়। উৎকর্ষের আড়ালে বৈভব দেখে কখনও অস্বস্তিতে পড়তে হয়। আবার কোথাও কোথাও খুব তুচ্ছ, সাধারণ জিনিসপত্র দিয়ে যে মণ্ডপ ও প্রতিমা তৈরি হয়, তাতে শৈল্পিক ভাবনার বিচ্ছুরণে এতটুকু ঘাটতি হয় না।
কাচ, আয়না, বোতল, কাচের ভাঙা চুড়ি দিয়ে হিন্দুস্থান পার্ক সর্বজনীন দুর্গোৎসবের মণ্ডপ এত সুন্দর সাজানো হয়েছে যে, ঢুকলেই প্রাণ ভরে যায়। কাচ ও আয়নার সঙ্গে আলোর ব্যবহার এতটাই চমকপ্রদ যে, মণ্ডপে ঢুকতেই চারপাশটা ঝলমল করে। তার পরে রয়েছে ধাপে ধাপে চমক। দ্বিতীয় যে ধাপে আমরা গিয়ে পৌঁছই, সেখানে কিন্তু আলোর রোশনাই ততটা নেই, বদলে গেছে, তার সঙ্গে বদলে গেছে চারপাশের মণ্ডপসজ্জাও। সবটাই যেন অনেকটা বিনীত, অনেকটা সহনশীল। এর পরে পৌঁছই সেই চূড়ান্ত স্তরে, মায়ের সামনে। চার পাশে আয়না, বৈভব পেরিয়ে আমাদের পৌঁছনো সেই অতি পরিচিত মৃণ্ময়ী মায়ের কাছে।
এ যেন ঠিক জীবনের কথা। শুরুতে চাই আলো, চাই অর্থ, চাই রোশনাই। তার পরে না-পাওয়া, জীবনের সঙ্গে যুঝে নেওয়া, সহনশীলতা আর মায়ের কাছে, ঈশ্বরের কাছে চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছনোর আগে এ সব কিছু ত্যাগ করা। জীবনের আসল ছন্দটা বুঝতে পারা। হিন্দুস্থান পার্কের এ বারের পুজো আমার কাছে একটি অভিজ্ঞতা। পরিক্রমায় আমাদের শেষ ঠাকুর দেখা ছিল হিন্দুস্থান পার্ক।
কেমন করে সেই কৈশোরে ফিরে যাওয়া, যেখানে প্রথম দেখা হয়েছিল আমার জীবনসঙ্গী রণজিতের সঙ্গে! |