ঠাকুর দেখা
মানুষের ভরা কোটালই বোধহয়
এই উৎসবের প্রকৃত মুখ

প্রায় দশ বছর বাদে পুজোর জজিয়তি করতে বেরোলাম। পার্লে-আনন্দবাজার পত্রিকা শারদ অর্ঘ্যের জন্য। বেশ ভালই কাটল সময়টা। এক পাশে পরমব্রতের সঙ্গে কেন ল্যোচ, সাম্প্রতিক ড্যানিশ চলচ্চিত্র থেকে সৃজিতের নতুন ছবির বিষয়ে নানা আলোচনা। অন্য পাশে যোগেনদার সঙ্গে আন্তর্জাতিক শিল্পকলা এবং পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার নতুন পাঠ্যক্রম সংক্রান্ত কথায় কথায় কী ভাবে যে আট ঘণ্টা কেটে গেল, টেরই পেলাম না। দীর্ঘ সময় ধরে বিশিষ্ট মানের আড্ডা মারার অবকাশ আজকাল খুব একটা মেলে না। কিন্তু এ রকম বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রায় বাধ্যতামূলক বেঁধে থাকার শর্ত থাকলে কারও পালানোর অবসর নেই।
সামনে পুলিশের পাইলট কার এবং উদ্যোক্তাদের সমস্ত পেশাদারি ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও গাড়িতে এক মণ্ডপ থেকে আর এক মণ্ডপে যেতে অনেকটা সময় লেগে যাচ্ছিল। চার দিকে মানুষের ভরা কোটাল এবং গাড়ির ঢল। তাই পুজোর মণ্ডপগুলোতে যত না সময় কাটিয়েছি, তার থেকে বেশি সময় কেটেছে রাস্তায় রাস্তায় এই ‘কার্নিভাল’-এর শহরের ভিতর দিয়ে উজান বাইতে। গাড়ি থেকে একটু অন্য ভাবে দেখার ও বোঝার চেষ্টা করছিলাম পুজোর শহরটাকে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের অভিঘাত কি এ বছরের পুজোর উপরে কোনও ভাবে এসে পড়েছে? পুজোর শহরে, মণ্ডপে, আলোয়, প্রতিমার রূপে বা আয়োজনের মধ্যে কোথাও কি বিন্যস্ত হয়েছে কোনও বিশেষ বয়ান, যা উদ্ভাসিত করে এক পরিবর্তিত কলকাতাকে? নাকি বাঙালি এই বাৎসরিক ‘স্পেক্ট্যাক্ল’-এর ব্যাপারে ততটা পরিবর্তনপন্থী নয়?
তবে একটা কথা টের পাচ্ছিলাম যে, আমাদের শহরে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পাশাপাশি আরও দু’টো বড় রকমের বিপ্লব ঘটে গিয়েছে এক হল, ‘অটোমোবাইল’ বিপ্লব এবং আর এক ‘মোবাইল’ বিপ্লব। এই দুই হল আধুনিক উন্নয়নশীল সমাজের দুই প্রধান চিহ্ন। উন্নয়নের প্রশ্নে আগামীর ভারতবর্ষ সম্পর্কে যে সব পরিসংখ্যানের তালিকা প্রকাশিত হচ্ছে, তা বিস্ময়কর। আরও বিস্ময়কর, এই প্রকাণ্ড উন্নয়নের বিস্ফারের পাশাপাশি আমাদের দেশে বেশির ভাগ মানুষের ভয়ঙ্কর হালহকিকতের তথ্য। কোন অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি মেটাবে এই বিপুল বিরোধ? শহরটাকে খুঁজছিলাম, শহরের স্থাপত্যের একটা সংহত রূপ খুঁজছিলাম। আমরা ছিলাম উত্তর কলকাতায়। এ দিকেই কলকাতার আদি ইতিহাস রচিত হয়েছে। কিন্তু গোটা শহরটা তো বিজ্ঞাপনে ঢাকা। মাটিতে তাকালে পায়ে চলা মানুষ আর গাড়ির মাথা। মানুষের মুখগুলো বিজ্ঞাপনের আর গাড়ির হেডলাইটের চড়া আলোর সামনে সিলুয়েট হয়ে গিয়েছে। মুখগুলো আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। উপরে তাকালে গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়ার পাক আর শুধু ব্যানার আর হোর্ডিং। কলকাতা চাপা পড়েছে, ঢাকা পড়েছে। বুঝি, পুজোর সংগঠকদের উপরে অর্থনৈতিক চাপ। তাঁরা যে সব অভিনব কাণ্ড ঘটিয়েছেন, বিজ্ঞাপনদাতারা না থাকলে হয়তো সে সব ঘটানো যেত না। এমনকী, বিজ্ঞাপনদাতারা না থাকলে এই পুরস্কারের জন্য যে বিপুল আয়োজন করতে হয়েছে, তা-ও করা যেত না। তাঁদের বদান্যতার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু, বিজ্ঞাপনদাতারাও যদি তাঁদের পুজোর বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে একটু স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দেন, তা হলে বোধহয় শহরটাকে এ রকম দমবন্ধ হতে হয় না। আর অন্তত পুজোর সময়ে গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ বিধি-নিষেধ রাখা যায়। বিস্মিত হতে হয় দেখে, কী প্রবল নিষ্ঠায়, দায়বদ্ধতায়, পরিশ্রমে কেউ চার মাস, কেউ আট মাস ধরে নির্মাণ করেছেন মণ্ডপ, প্রতিমা, পরিবেশ। নানা ‘থিম’, নানা মনন। সবাই চেষ্টা করছেন একটা অভিনব, স্বতন্ত্র ‘আইডিয়া’ প্রকাশ করতে। বিচারক হিসেবে যে ক’টা পুজো দেখার সুযোগ হল, সেই নিরিখে বলতে পারি, উত্তর কলকাতার সঙ্কীর্ণ গলি, এক ফালি মাঠকে নিয়ে যে এ রকম সব উদাত্ত শৈল্পিক অভিব্যক্তির বিচ্ছুরণ ঘটানো যায়, তা না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।
বিশেষ করে বলব ‘নলিন সরকার স্ট্রিট সর্বজনীন’-এর সামগ্রিক পরিকল্পনার কথা। ছোট গলির মধ্যে একটি শান্ত, সংহত পরিবেশ তৈরি হয়েছে প্রতিমা, স্থাপত্য, আলো, সঙ্গীতে, যা তাঁদের করল উত্তর কলকাতার শ্রেষ্ঠ পুজো। এ ছাড়া, ‘টালা বারোয়ারি’ ও ‘সিঁথি ইউথ অ্যাথলেটিক ক্লাব’-এর ভাবনা আর উদ্যোগকে স্যালুট জানাতেই হবে।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.