৭০ বা ৮০’র দশকে গড়ের মাঠে খেলোয়াড় তৈরি করত বিভিন্ন ছোট দল। আর সেই ক্লাবগুলি থেকে বেরিয়ে পরবর্তী কালে মাঠ কাঁপিয়েছেন সুব্রত ভট্টাচার্য-মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য-সুধীর কর্মকার-গৌতম সরকারদের মতো তারকারা।
আর গত ১০-১৫ বছরে ঠিক একই ভাবে পুজোর ময়দানেও বন্দন রাহা, প্রশান্ত পাল, সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, অনির্বান দাশেরা হাত পাকিয়েছেন উত্তর কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব কলকাতার একেবারে ছোট ক্লাব থেকে। কম বাজেটের পুজো থেকে।
আশ্চর্য সমাপতন! গড়ের মাঠে বছর বছর খেলোয়াড় গড়ে তুলেও এক সময় কলকাতা ময়দান থেকে মুছে গিয়েছে খিদিরপুর, উয়াড়ি, বালি প্রতিভার ফুটবল দলগুলি। আর আনকোরা শিল্পীদের সুযোগ দিতে বাজেটের অভাবে, লোকবলের অভাবে কম বাজেটের পুজোগুলি ধীরে ধীরে চলে গিয়েছে কিছুটা পিছনের সারিতে।
পোস্তার দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট, পিকনিক গার্ডেন্সের সুনীলনগর সর্বজনীন, পাথুরিয়াঘাটা পাঁচের পল্লি কিংবা ভবানীপুর দুর্গোৎসব সমিতির পুজোগুলির সেই দাপট আর নেই। কেউ কেউ অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছে। আবার পরিবর্তনের সঙ্গে পা মেলাতে না পারায় ভবানীপুরের সংঘমিত্র, মুক্তদল, বকুলবাগানের মতো পুজোগুলি এখন অনেকটা অতীতকে সঙ্গে করেই টিঁকে থাকার লড়াই করছে।
কেন এই অবস্থা?
সুনীলনগর সর্বজনীন পুজো কমিটির অন্যতম কর্তা অনুব্রত চক্রবর্তী বুক বাজিয়েই বললেন, “কলকাতায় থিম পুজোর চল কিন্তু আমাদের হাত ধরেই। সেটা আশির দশকের শেষের দিকের কথা। তখনও মানুষ থিম পুজোকে মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু নব্বইয়ের গোড়া থেকেই দর্শকদের নজর কাড়তে শুরু করে এই পুজো।”
ক্লাবের সদস্যেরা বলছিলেন, ১৯৯২ সালে এই পুজোতেই পাটকাঠি দিয়ে মণ্ডপ গড়ে নিজের জাত চেনান এক তরুণ শিল্পী, বন্দন রাহা। এর পর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। বড় বাজেটের পুজোয় ডাক পড়ে বন্দনের। আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় এই শিল্পীকে আর ধরে রাখতে পারেননি সুনীলনগরের কর্তারা। তবে, বছর কয়েক আগে ফের এক বার বন্দন ফিরেছিলেন ‘আঁতুড়ঘরে’। সেটা কি নেহাৎই চাহিদা নাকি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে, তা নিয়ে অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে চায়নি পুজো কমিটি।
বন্দন রাহা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে গত দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সুনীলনগরের পুজোতেই হাত পাকিয়েছেন সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ দে-র মতো শিল্পীরা। তাঁদের পরবর্তীকালে তুলে নিয়েছে মহানগরীর ছোট, বড়, মাঝারি পুজো। ময়দানে খ্যাতি বেড়ে যাওয়ায় এ বারে তাঁদের অনেকের হাতেই বড় বাজেটের দু’-তিনটি করে পুজো। আর এ বছর সুনীলনগর বেছে নিয়েছে আর এক নতুন প্রতিভা, শক্তি শর্মাকে। শক্তির কাজ দেখে শঙ্কিত ক্লাব-কর্তারা। কত দিন তাঁকে ধরে রাখা যাবে উদ্বেগটা তা নিয়েই।
বছর দশেক আগের কথা। হঠাৎই এক দিন ‘ঘরের ছেলে’ প্রশান্ত পালকেই থিম গড়ার সুযোগ দিয়েছিল দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট পুজো কমিটি। আর গত ছয় বছর ধরে কলকাতার পুজোর বাজারে প্রথম পাঁচেই ঘোরাফেরা করেছে প্রশান্তর নাম। ২০০১ সালে গোবর দিয়ে তৈরি মণ্ডপ দেখতে সেই প্রথম বারের মতো ভিড় আছড়ে পড়েছিল পোস্তার ওই পুজোয়। আর ২০০৩ সালে ডোকরার কাজে শহরে ভিড়ের রেকর্ড গড়েছিল দর্পনারায়ণ। পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ওই পুজো কমিটির কর্তা বিকাশ দে বলেন, “প্রশান্ত তো আমাদের পাড়ারই ছেলে। এক সময় এই পুজোর সম্পাদকও ছিল। মণ্ডপ গড়ার দায়িত্ব দেওয়ার সময় জানতাম, ও নাম করবেই।”
বিকাশবাবু জানান, প্রশান্ত পালের পর অবশ্য তাঁর ‘গুরু’ কমলদীপ ধরের হাত ধরেছিল দর্পনারায়ণ, কাজ করেছেন অমর সরকারের মতো খ্যাতনামা শিল্পীও। আবার এই মণ্ডপেই পুতুলের কাজ দেখিয়ে খ্যাতি পেয়েছেন গৌরাঙ্গ কুইল্যা। তরুণ শিল্পী হিসেবে গৌরাঙ্গ কাজ করেছেন ভবানীপুর দুর্গোৎসব সমিতিতেও। দর্পনারায়ণে কাজ করে নিজের জাত চিনিয়েছেন অনির্বাণ দাশও। তাঁর এবার ডাক এসেছে বড় পুজো থেকে। এ বার আনকোরা কৃশানু পালকে দিয়ে মণ্ডপ তৈরি করিয়েছে দর্পনারায়ণ। বিকাশবাবুর আশা, “ও ঠেকে ঠেকে ঠিক শিখে যাবে।”
নব্বইয়ের দশকে সুনীলনগরের থিম পুজোর সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে পদ্মপুকুরের ভবানীপুর দুর্গোৎসব সমিতি। কলকাতায় প্রথম বাতানুকূল মণ্ডপও তাঁদের। ওই পুজোর পূর্বতন কর্তা উৎপল রায় এখন আর ওই পুজোর সঙ্গে নেই। জৌলুসও হারিয়েছে দক্ষিণের এক সময়ের চমক লাগানো পুজোটি। উৎপলবাবুর দাবি, “কাঁথি, তমলুক, বাঁকুড়া থেকে পাটের, টেরাকোটার যে সব শিল্পী আমি তুলে এনেছি তাঁরা এখন কলকাতার পুজোর সম্পদ।”
ওই শিল্পীরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন ইতিমধ্যেই। বাজার পড়েছে তাঁদের আঁতুরঘরের। |