পুরনোয় পা রেখেও নতুন উত্তরণের
পুজোয় বাজিমাত কিন্তু সচেতনতারই
থিম বড় গেরো! বহু বছর বাদে মণ্ডপে জনতার ঢল নামলেও মনটা খুঁতখুঁত করছে উত্তর কলকাতার নামী পুজোর ৫০ বছরের পুরনো পুরোহিতের। যে যা-ই বলুন, এ বারের মা দুগ্গা মাথায় বড়জোর গত বারের কার্তিক-গণেশের সমান-সমান হবেন। গত পুজোয় লক্ষ্মী-সরস্বতীও এই দুর্গার থেকে মাথায় উঁচু ছিলেন। বিসর্জনের সময়ে যাঁদের ঠাকুর কাঁধে তুলতে হয়, থিমের কল্যাণে পাড়ার সেই ছেলেরা অবশ্য হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন।
সপ্তমীর সকালে লাইন দিয়ে হেদুয়ার কাশী বোস লেনে ঢুকে যাঁরা এই প্রতিমা দেখলেন, তাঁদের চোখে-মুখে কিন্তু ভাবান্তর বোঝা গেল না। অন্তত আট ফুট উঁচু আয়তনেত্র চেনা দুর্গা প্রতিমাকে অনেকেই চোখ বুজে ভক্তিভরে নমস্কার করছেন। কিন্তু পুরোহিত কালীপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের মতে, এ পুজোর ধারা অনুযায়ী বরাবরের ১৬ ফুটি ঠাকুরের পাশে এ এমন কী! থিমের জন্য এই আপস করতে হয়েছে। বহু বছর বাদে নিজেদের ছক ভেঙে কাশী বোস লেন শহরের রাজপথ থেকে ৮ ফুট উঁচু প্ল্যাটফর্মের উপরে প্রকাণ্ড পাহাড়ি মন্দির গড়েছে। কিন্তু ৭৪ বছরের পুরনো বারোয়ারি পুজো সাবেক আচার-অনুষ্ঠানে ফাঁকফোকর রাখতে নারাজ। শাস্ত্র মতে, মাটিতেই পুজোর ঘট স্থাপন করতে হবে। কিন্তু মাটি থেকে উঁচু থিম-মণ্ডপে সেটা হবে কী করে? শেষে মণ্ডপের কাঠের মেঝেয় ফাঁক রেখে তাতে গঙ্গামাটি ভরা লম্বা পাইপ বসানো হয়েছে। এতেই শ্যাম ও কুল-- দুই-ই বাঁচল। ওই গঙ্গামাটিতেই পুজোর ঘটের অধিষ্ঠান।
একসঙ্গে থিম ও পুজো রক্ষা করতে এমন রকমারি কৌশলের ছড়াছড়ি পুজোর কলকাতা জুড়ে। অনেক মণ্ডপেই একসঙ্গে দু’টি প্রতিমা। পুরোভাগে থিমের প্রতিমা। একপাশে ছোট পুজোর প্রতিমা রাখা। থিম-পুজোর জমানায় নানা পরিবর্তনেও সাবেক পুজো অস্তিত্ব অটুট রেখেছে।
এ বছরে কিছু প্রাচীন বাড়ির পুজোও কিন্তু একই সঙ্গে অতীত-বর্তমান দুই নৌকোর যাত্রী। সপ্তমীর সন্ধেয় রাজা নবকৃষ্ণ দেব স্ট্রিটে শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে সদ্য প্রকাশিত পারিবারিক ওয়েবসাইট নিয়ে তুমুল আলোচনা। বাড়ির অনেক কালের পুরনো গিন্নি নন্দিনী দেববৌরানির আহ্লাদ, যাক এ বারের ঠাকুরের ছবিটা অন্তত লন্ডন-বেঙ্গালুরুতে পড়ে থাকা মেয়েরা এখনই দেখতে পাবে। নন্দিনীদেবীর ভাসুরপো তীর্থঙ্করকৃষ্ণ, শৌর্যেন্দ্রকৃষ্ণ দেবরা জানালেন, রাজা নবকৃষ্ণ দেবের উত্তরাধিকারী দু’টি বাড়ির পুজোর খুঁটিনাটিই ওয়েবসাইটের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।
থিমের শহরে নতুনের মধ্যে দিয়ে এমন কত ‘পুরনো’ই যে ফিরে ফিরে আসে! নিউ আলিপুর সুরুচি সঙ্ঘের মণ্ডপে কাশ্মীরি লোকশিল্পীদের ‘লাইভ শো’-র ফাঁকে বাজছে পুজোর ‘থিম সং’। সপ্তমীর বিকেলে ৪৫ মিনিট লাইন দিয়ে মণ্ডপে ঢুকে গান শুনতে শুনতে এক প্রৌঢ় দম্পতি এ কালে পুজোর গানের আকাল নিয়ে আফসোস করছিলেন। কাশ্মীরের হিমবাহে উষ্ণায়ন ও দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে বাঁধা গানে সুরকার জিৎ গঙ্গোপাধ্যায় কাশ্মীরি বাদ্যযন্ত্র রাবাব-দারবুকা-উধের গমগমে মেলোডি এনেছেন। কাড়া-নাকাড়া-ঢোলের বাজনার পথ ধরে এ গানে কাশ্মীরের ‘একা চিনার’-এর নিঃসঙ্গতার সঙ্গেই মিশে যাচ্ছে দেবীর আগমনীর আশাবাদ। ‘রূপং দেহি, জয়ং দেহি’র সুরে, শাঁখের শব্দে জিৎ গানটা শেষ করেছেন।
বড়িশা ক্লাবের পুজোতেও আদিবাসীদের দুর্লভ বাদ্যযন্ত্র বানামের সুরটাই থিম। ভাওয়াইয়ার সুরে লোপামুদ্রা মিত্রের গান গোটা পরিবেশটাকে যেন পূর্ণতা দিয়েছে। বানাম যন্ত্রটির নেপথ্যে সাত ভাইয়ের বোন, চক্রান্তের শিকার এক দুঃখিনী আদিবাসী কন্যা মন্দোরীর করুণ লোকগাথা। সপ্তমীর সন্ধেয় মাইকে লোপামুদ্রার কণ্ঠে সে-মেয়ের বেদনা বড়িশার ভিড়ে-ঠাসা পুজো মথিত করছে। চেতলা অগ্রণীর পুজোতে শাঁখ-কাঁসরের সঙ্গে আজানের সুরের মন্তাজ। কসবার রামলাল বাজারের পুজোয় মৌলিক গানে ‘গাছ বাঁচানোর ডাক’। পুজোর থিম নিয়ে গান বাঁধার কাজটা উপভোগ করেছেন জিৎ। বাংলা পুজোর গানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী শিল্পীর দাবি, “পুজোর ‘থিম-সং’ কিন্তু সৃষ্টিশীলতার নতুন জানলা খুলে দিচ্ছে।”
থিমের লড়াইয়ে পুরস্কার শিকে ছেঁড়েনি অনেক পুজোর বরাতে। কিন্তু ‘জয়’টা এসেছে অন্য ভাবে। এ বারের পুজো পরিবেশ-সচেতনতা বা নিরাপত্তা নিয়ে দায়বদ্ধতার দিক দিয়েও ব্যতিক্রমী। পরিবেশবন্ধু পুজোর খোঁজে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের বিচারক-টিমের সদস্য কৃষ্ণজ্যোতি গোস্বামীর হিসেব, শহর-শহরতলির হাজার চারেক পুজো এ বার প্রতিমায় সিসাবিহীন রং ব্যবহার করেছে। মোটে তিন বছর আগে এই তালিকায় সবেধন নীলমণি একটি পুজো ছিল। শহরের পুজো কমিটিগুলির সম্মিলিত মঞ্চও এ বার পরিবেশ-বিধি মানার বিষয়ে জোর দিচ্ছে। নামী বারোয়ারির বাইরে রাজারহাট-নিউটাউনের অলক্তিকা আবাসন বা শ্যামবাজার মোড়ের বাই-লেনে নবীন সঙ্ঘের মতো একটা ছোট পুজো, থিমের মণ্ডপ সাজাতে যাদের প্রতি বার টিনের চালের ক্লাবঘরের খুঁটি সরাতে হয়, তারাও এই নিয়ম মেনেছে।
পুজো মণ্ডপের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে লোহার মণ্ডপ গড়ার বিষয়েও দমকল বা কেন্দ্রীয় ইস্পাত মন্ত্রক দীর্ঘ দিনই সওয়াল করছে। দেশে-বিদেশে বড় অনুষ্ঠানের আয়োজনে লোহার কাঠামোই দস্তুর। ইস্পাতের মণ্ডপ নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের মুখপাত্র দেবাশিস দত্ত বেশ কয়েকটি পুজোর ভূমিকায় খুশি। বড় পুজো যোধপুর পার্ক লোহার স্তম্ভে সাঁচির স্তূপ গড়ে তুলেছে। ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে লোহার পাত কেটে নকশায় ফুটে উঠেছে সন্তোষপুর লেকপল্লির থিম ‘আল্পনা’। অজেয় সংহতির কাজললতার মণ্ডপে লোহা-পেতলের ছড়াছড়ি। কসবার বোসপুকুর তালবাগান ও শীতলামন্দিরে এবং নাকতলা সম্মিলনীতেও ধাতুর প্রাধান্য। সন্তোষপুর অ্যাভিনিউ সাউথ-এর থিম সাবেক গেরস্থালির চেনা পিঁড়ি-র জন্যও ধাতব মণ্ডপ। এই মণ্ডপের খরচা খানিকটা বেশি হলেও পরের বারও কাঠামোটার ব্যবহার করা যাবে। পুজো কর্তা ধ্রুব বসু এখনই বলছেন, “এ বার মণ্ডপের কাঠামোটা কোথায় রাখা যায়, ভাবছি। তবে পরের বারও লোহার মণ্ডপই আমরা করব।”
তবে মণ্ডপের স্থাপত্য-চিন্তায় সব থেকে বড় বদলের স্বাক্ষর সেই হেভিওয়েট পুজো একডালিয়ার তোরণে। জার্মান স্থপতি গ্রেগর স্নেইডারকে নিয়ে এসে যেন এত দিনের মণ্ডপ-ভাবনার খোলনলচে বদলানোর প্রয়াস। বাঁশ-কাপড়ের ডেকরেটরের চেনা মণ্ডপ থেকে অভিনবত্বে উত্তরণের একটা নতুন দিকও এই পুজোয় খুলে যাচ্ছে।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.