সোমবার সপ্তমীর দুপুর দেড়টা। তখনও মেট্রো চালু হতে আধ ঘণ্টা বাকি। মহাত্মা গাঁধী রোড স্টেশনের বাইরে বিশাল লাইন। শাটার ওঠা মাত্রই সেই ভিড় হুড়মুড় করে গিয়ে পড়ল টিকিট কাউন্টারের সামনে।
শুধু এই একটি স্টেশনই নয়, দমদম থেকে কবি সুভাষ, ছবিটা সর্বত্র প্রায় একই রকম। প্রথম ট্রেন থেকেই তাই বেসামাল মেট্রো চলাচল। গভীর রাতেও স্বাভাবিক হল না পুজোর মহানগরীর ‘জীবনরেখা’।
পঞ্চমীর রাত থেকে ষষ্ঠীর বিকেল পর্যন্ত ‘অপ্রস্তুত’ পুলিশের জন্য ভুগতে হয়েছিল দর্শনার্থীদের। আর সপ্তমীর সকাল দেখল, ‘অপ্রস্তুত’ ছিল মেট্রোও।
পুলিশ-কাহিনি অবশ্য এ দিন সকালেও ফিরে এসেছে। মন খুশ করে দেওয়া আবহাওয়া দেখে যাঁরা ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিলেন, তাঁদের জন্য তাই মাটির উপরেও অপেক্ষা করে ছিল দুর্ভোগ। দলে দলে দর্শনার্থীর চাপ নিতে পারেনি পুলিশ। এর সঙ্গে হাওড়া, শিয়ালদহ হয়ে শহরের পুজো দেখতে আসা মানুষের স্রোত যোগ হয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দিয়েছে। যদিও বিকেলে সর্বশক্তি নিয়ে রাস্তায় নেমে অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্য অবস্থা সামলে দিয়েছিল পুলিশ। যানজট কমেছিল, ধীরে হলেও এগোচ্ছিল গাড়ির স্রোত। কিন্তু রাত বাড়তেই হাল যে-কে সেই। তত ক্ষণে জনজোয়ারেও মহাষষ্ঠীকে অনেকটা পিছনে ফেলে দিয়েছে মহাসপ্তমী।
মহাত্মা গাঁধী রোড স্টেশনের বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন হাবড়ার শ্রেয়া চক্রবর্তী। সঙ্গে তিন বন্ধু। কলেজ স্কোয়্যার, মহম্মদ আলি পার্ক দেখে নিয়েছেন বেলা দেড়টার মধ্যে। কিন্তু সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে বাস-ট্যাক্সির লম্বা লাইন দেখে ঘাবড়ে গিয়েছেন শ্রেয়ারা। তাই দাঁড়িয়ে পড়েছেন মেট্রোর বন্ধ দরজার সামনে। শ্রেয়ার কথায়, “মণ্ডপের সামনে গিয়ে তো সেই লাইনেই দাঁড়াতে হবে। কখন যে বাস নড়বে, বুঝতে পারছি না। আধ ঘণ্টা দাঁড়ালেই তো মেট্রো পেয়ে যাব।”
কিন্তু মেট্রোর দরজার সামনে দাঁড়িয়েও তাঁরা ভাবতে পারেননি, শাটার উঠলে কী হতে চলেছে। দু’টো বাজার ১০ মিনিট আগে দরজা খুলল, এবং ভিড়টা আছড়ে পড়ল স্টেশনে। বহু মানুষ ছিটকে পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছেন শেষ পর্যন্ত। পড়ে গেলে পদপিষ্ট হওয়ার আশঙ্কা ছিল যথেষ্টই। এই ধাক্কায় শ্রেয়া ও তাঁর বন্ধুরা কে কোথায় ছিটকে পড়লেন, কে জানে!
প্রশ্ন হচ্ছে, পঞ্চমী-ষষ্ঠীর ভিড় দেখেও কেন শিক্ষা নিল না মেট্রো? কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, কাজের দিনে ট্রেন চলে সকাল সাতটা থেকে রাত সাড়ে দশটা (অর্থাৎ, সাড়ে ১৫ ঘণ্টা)। কিন্তু পুজোর সময় সপ্তমীর দিন ট্রেন চলার ব্যবস্থা হয়েছে ১২ ঘণ্টার জন্য। অষ্টমী ও নবমীতে ১৪ ঘণ্টার জন্য। দশমীতে কী হবে? সে দিনটা বৃহস্পতিবার। অনেক প্রতিমাই বিসর্জন হবে না ওই দিন। তাই দর্শনার্থীও থাকবেন অনেক। কিন্তু মেট্রো সে দিন শুরু তিনটেয়, রাত ন’টায় শেষ। চলবে মাত্র ছ’ঘণ্টা!
কেন আগে থেকে পরিকল্পনা করে এগোল না মেট্রো? কর্তৃপক্ষের যুক্তি, “আমাদের ট্রেনের সংখ্যা কম। তা ছাড়া কর্মীদের ছুটিছাটাও রয়েছে।” পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রেল স্বাভাবিক পরিষেবা না কমিয়েও বাড়তি ট্রেন চালাচ্ছে পুজোর ক’দিন। বস্তুত, এ দিন তারা পাশ করেছে লেটার নম্বর নিয়ে। কলকাতার সরকারি, বেসরকারি বাস পরিষেবাও তাই। তা হলে মেট্রোর কেন এই হাল? কর্তৃপক্ষের কাছে তার জবাব নেই।
দিনের প্রথম ধাক্কাটা অবশ্য এল পুলিশের কাছ থেকে! সকালে পর্যাপ্ত পুলিশ ছিল না। বেলা যত বাড়ল, মানুষের স্রোত বনাম পুলিশের অসম যুদ্ধ দেখল গড়িয়া থেকে সিঁথি, তিলজলা থেকে ঠাকুরপুকুর। ২৭ হাজার পুলিশকর্মী এঁটে উঠতে পারছিলেন না তাঁদের থেকে সংখ্যায় অন্তত ১০ গুণ বেশি জনস্রোতের সঙ্গে। এক ট্রাফিক পুলিশকর্তার আক্ষেপ, “মানুষের স্রোত আসছে-যাচ্ছে। আমরা শুধু এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে। অভিজ্ঞ পুলিশকর্মীরা এতে অভ্যস্ত। কিন্তু নতুনদের অনেকের প্রশিক্ষণই প্রায় হয়নি। যে দু’হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়েছে তাঁদেরও এক দিনের প্রশিক্ষণের পরেই নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।” ফল যা হওয়ার, সেটাই হয়েছে। দিনভর জটে আটকে ছিল শহর।
শুধু বিকেলের পর থেকে কয়েক ঘণ্টা মনে হচ্ছিল, আর হয়তো ভোগাবে না যানজট। মা অসুস্থ শুনে ধর্মতলার অফিস থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কাঁকুড়গাছি রওনা দিয়েছিলেন সন্তোষ সেনগুপ্ত। অন্য দিন যে রাস্তা পেরোতে ট্যাক্সিতে ৪০ মিনিট লাগে, এ দিন সে রাস্তা আধ ঘণ্টায় এসে সন্তোষবাবুর মন্তব্য, “চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, বিবেকানন্দ রোড হয়ে হুহু করে চলে এসেছি। মানিকতলা ছাড়া কোথাও এতটুকুও যানজট পেলাম না।” রাত ন’টাতেও তারাতলা থেকে নিউ আলিপুর যেতে সময় লাগছিল ২০-২৫ মিনিট। তবে কসবা কানেক্টর, বেহালার জেমস লং সরণি, হরিদেবপুরের মহাত্মা গাঁধী রোড কিংবা উত্তরের অরবিন্দ সরণি-আমহার্স্ট স্ট্রিটে গাড়ির গতি ছিল কম। তুলনায় চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, কলেজ স্ট্রিট অথবা রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে যানবাহনের গতি ছিল অনেক মসৃণ।
কিন্তু রাত বাড়তেই মূলত দক্ষিণ কলকাতা আবার যানজটে হাঁসফাঁস। সন্ধ্যা সাতটায় গড়িয়াহাট থেকে যাদবপুর যেতে যেখানে মিনিট কুড়ি লাগছিল, রাত ১১টায় সেই দূরত্বটাই পেরোতে লেগেছে দ্বিগুণেরও বেশি সময়। পুলিশকে আরও সমস্যায় ফেলে দিয়েছে অটোরিকশা। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় বিকেল তিনটের পর থেকে অটো বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ। সেই নির্দেশকে ঘিরে শুরু হয়েছে প্রতিবাদ। দক্ষিণ কলকাতা ও সংযোজিত এলাকায় কয়েকটি জায়গায় অবরোধও করেন অটোচালকরা।
পুলিশ কিন্তু সিদ্ধান্তে অটল। গত কয়েক বছরের মতো এ বারেও সসম্মানে উত্তীর্ণ হতে চায় তারা। সংযোজিত এলাকার চ্যালেঞ্জ নিয়েই।
শেষ পর্যন্ত মার্কশিটে কত নম্বর আসে, সেটা অবশ্য দশমীর আগে বোঝা যাবে না। |