|
|
|
|
|
|
|
বেদখল ঠাকুরদালান |
অবহেলায় ঐতিহ্য |
সে কালের দুর্গোৎসব ছিল রাজা, জমিদার এবং কিছু বনেদি পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি ছিল প্রতিপত্তি দেখাবার অন্যতম মাধ্যম, যা অনেকটা প্রকাশ পেয়েছে বনেদি বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপ বা দুর্গাদালানের স্থাপত্যরীতিতে। অর্থাৎ, এর গঠনসৌকর্য দেখেই আঁচ করা যায় বাবুর বনেদিয়ানা। তবে, শুধু এই নয়, এ ধরনের ঠাকুরদালানের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই জড়িয়ে আছে বহু ইতিহাস। যেমন, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ঠাকুরদালানে পুজো বন্ধ হওয়ার পর মহর্ষির উদ্যোগে এখানেই সূত্রপাত হয় মাঘোৎসবের। আর শোভাবাজারে নবকৃষ্ণের ঠাকুরদালান বিখ্যাত হয়ে আছে দেবীদর্শনের জন্য ক্লাইভের আগমনকে কেন্দ্র করে। বড়িশাতে সাবর্ণ পরিবারের চণ্ডীমণ্ডপে যেমন চার্নকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। বৃহত্তর বড়িশা-বেহালা অঞ্চলে সাবর্ণ চৌধুরিদের উদ্যোগে দুর্গোৎসব শুরু হলেও পরে এই অঞ্চলে গড়ে ওঠে আরও একটি ঠাকুরদালান। এদের অনেকেই সাবর্ণদের অধীন জমিদার ছিলেন। যেমন মনোহর মুখুজ্যের (যাঁর নামে মনোহরপুকুর রোড) পরিবার, বর্তমানে ওদের খিলানযুক্ত ঠাকুরদালান রয়েছে বনমালী নস্কর রোডে। |
|
এই অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য দুর্গাদালানের মধ্যে রয়েছে রায়বাড়ি, ব্রাহ্ম সমাজ রোডে সোনার দুর্গাবাড়ি, হালদারবাড়ি ও ঘোষবাড়ি। সংকটজনক অবস্থায় রয়েছে সরশুনা চ্যাটার্জিবাড়ি ও বড়িশা বড় বাড়ির দুর্গাদালান। পরিবার বিস্তৃতির জন্য সাবর্ণদের অনেক ঠাকুরদালান পরে গড়ে ওঠে। তবে এর সব ক’টিতে পুজো এখনও হচ্ছে। বেহাত হওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে পুজো বন্ধ বড় বাড়িতে। রায় কৃষ্ণদেব মজুমদার চৌধুরি ১৭১০-এ তৈরি করেন বড় বাড়ির দুর্গাদালান (সঙ্গের ছবি)। ১৭১৭ থেকে এখানে জাঁকের সঙ্গে পুজো শুরু হয়। ১৯৫২-৫৩ থেকে এই দালানের দখল নেয় স্থানীয় ব্যায়াম সমিতি। অতঃপর হেরিটেজ তালিকাভুক্ত দালানটি রক্ষা করার জন্য সাবর্ণ সংগ্রহালয়ের তরফে আবেদন গিয়েছে বহু স্থানে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সংরক্ষণের দায় কেবল সরকারের নয়, সাধারণ মানুষ এগিয়ে না এলে কোনও ঐতিহ্যই বাঁচানো যাবে না।
|
কাগজের দুর্গা |
বরাহনগর ন’পাড়ার হরিসাধন বিশ্বাসের শখ হল, ফেলে দেওয়া নানা জিনিস দিয়ে দুর্গা মূর্তি তৈরি করা। ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, বিজ্ঞাপন সংস্থার চাকুরে হরিসাধন প্রতি বছর গেঞ্জির কাপড়, তেজপাতা, রবার-পাইপ প্রভৃতি কিছু না কিছু সামগ্রী দিয়ে মিনিয়েচার দুর্গামূর্তি তৈরি করেন। এ বছর করেছেন আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন খবরের অংশ, শিরোনাম ও বিজ্ঞাপনের কাটিং দিয়ে। শুধু জরির অলঙ্কার ছাড়া পুরো মূর্তিটি তৈরি হয়েছে কাগজ দিয়ে। চোখ, মুখ, পোশাকেও আলাদা ভাবে কোনও রঙ ব্যবহার করা হয়নি। |
|
|
বিশেষ রীতি |
সংবৎসরব্যতীতে তু পুনরাগমনায় চ...। এমনি করেই তুমি আবার এসো মাগো। বিজয়ার দিনে এই হল প্রার্থনা। সঙ্গে মিষ্টিমুখ আর কোলাকুলি। তবে, দেবীর বিসর্জনের পরেও থাকে নানা ধরনের নিয়মনিষ্ঠা। তারই একটি খুঁজে পাওয়া গেল বেহালার রায়বাড়ির পুজোতে। প্রাচীন এই পুজোতে বোধনের পূর্বে বেলগাছের বেদিতে ঘট বসিয়ে তাতে চণ্ডী রূপে আরাধনা হয় মায়ের। এই ‘বিল্ববরণ’ অনুষ্ঠানের পর সকলে সমবেত হন আবার এখানে। একটি চৌকিতে প্রতিষ্ঠিত হয় সেই ঘট, সঙ্গে হয় নারায়ণের পুজো। এর পর এই ঘটের ডাবটি পরিবারের প্রবীণের হাত থেকে ক্রমে হাতবদল হয়ে পৌঁছয় সবচেয়ে ছোট বাচ্চাটির হাতে। এই হল ওদের মঙ্গলক্ষণ, অর্থাৎ বিজয়া। তার পর ঠাকুরদালানে মিষ্টিমুখ আর শেষ বেলার ঢাকের বাদ্যিতে গমগমে উৎসবের সমাপ্তি, আসছে বছর আবার হবে।
|
অস্ত্র কারখানা |
|
মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রত্যেক দেবতা তাঁদের নিজের নিজের শ্রেষ্ঠ আয়ুধ বা অস্ত্র দেবীকে দান করেন। পুরাণের সেই বর্ণনা অনুসারে দুর্গাপ্রতিমার দশ হাতে থাকে ত্রিশূল, খড়্গ, ঢাল, চক্র, তির, ধনুক, গদা, বজ্র, শঙ্খ, সর্প। দুর্গার সঙ্গে যাঁরা থাকেন, অস্ত্রশস্ত্র থাকে তাঁদের হাতেও। এক সময়ে দুর্গাপ্রতিমার এই সব অস্ত্র পিতল দিয়ে তৈরি হত। এখনও কোনও কোনও পারিবারিক পুজোর প্রতিমায় পিতলের অস্ত্র দেখতে পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পিতলের স্থান নিয়েছে টিন (অর্থাৎ টিন প্লেটিং করা পাতলা লোহা)। প্রতি বছর পুজোর আগে ব্যস্ততা বাড়ে ওই সব অস্ত্র তৈরির কারখানায়। সিমলা, গরানহাটা, কুমোরটুলি অঞ্চলে রয়েছে অস্ত্র-কারখানা। সঙ্গের ছবিতে সিমলা অঞ্চলে লক্ষ্মীনারায়ণ দাস (এলএনডি) কারখানায় অস্ত্র তৈরির দৃশ্য। সে সব অস্ত্র এখন দেবীর হাতে।
|
মুখ রইল না |
প্রতিমাশিল্পীরা কি ঠাকুর দেখেন? কঠিন প্রশ্ন বটে। তবে হ্যাঁ, অনেকেই দেখেন। কেউ কেউ খুঁজে বেড়ান সুন্দর মুখ। কথায় বলে সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। তদুপরি মায়ের মুখ বলে কথা। টানা চোখের মুখ, গোল মুখ, বাংলা ধাঁচের মুখ বা আর্টের মুখ এমন কত শৈলীর উপস্থাপনা বাংলার দুর্গোৎসবে। আর্টের ঠাকুরের রমরমা হওয়ার আগে জিতেন পাল, সুনীল পাল, মোহন বাঁশী রুদ্র পালেদের তৈরি মুখের কদর ছিল অনেক। বিসর্জনের ঘাটেও থাকে সেই মুখ চেনার পালা। কারণ, লোক ঠিক করা থাকেই, জলে পড়ার পর প্রায় প্লাস্টিক সার্জেনের কায়দায় নিঃশব্দে চুরি যায় মায়ের মুখ। শিল্পী অনুযায়ী তার দাম ওঠে ২৫০-৬০০ টাকার মধ্যে। তার পর আর কি, তা থেকেই ছাঁচ হয়ে ‘কপি’ হয়ে যায় মুখ। বাঘাযতীনের মৃৎশিল্পী উত্তম দে বলছিলেন, কুমোরটুলির বিখ্যাত শিল্পীদের হাতে গড়া মুখ এখন দক্ষিণ কলকাতার অনেক মৃৎশিল্পীর কাছেই পাওয়া যাবে। এর পর কেউ কি ভাবছেন মুখের আদলের কপিরাইট নিয়ে, না কি ভাবছেন মুখ রইল না মাগো।
|
রজতজয়ন্তী |
পুজো শুরু হয়েছিল মৃন্ময়ী মূর্তিতে। তখন ‘হিমালয় কন্যা’র এই মূর্তি গড়তেন জিতেন পাল এবং পরে কার্তিক পাল। শিবমুখী এই দুর্গা খানিকটা আড় হয়ে দাঁড়ানো উত্তর দিকে। পরাধীন ভারতে, বর্তমান হরিশ মুখার্জি রোড এবং বসন্ত বসু রোডের সংযোগস্থলে ২৩ পল্লির প্রথম দুর্গোৎসব হয় ১৯৩৯-এ। ১৯৮২-তে তৈরি হয় শিবমন্দির। এর পর পরিকল্পনা নেওয়া হয় দুর্গার একটি স্থায়ী মূর্তি স্থাপনের। অতঃপর জিতেন পালের মূর্তি অবলম্বনে বেনারসের শিল্পী শিউনাথ বিশ্বকর্মা দেড় বছরের পরিশ্রমে তৈরি করলেন অষ্টধাতুর এই দেবীমূর্তি। উচ্চতায় ১৪ ফুট এবং ওজন প্রায় ৩ টন। যোশী মঠের শংকরাচার্য স্বরূপানন্দ সরস্বতী এর উদ্বোধন করেন ১৯৮৬-র ৫ অক্টোবর, মহাপঞ্চমী তিথিতে। এ বছর এই মূর্তি প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে এ দিন আয়োজিত হয়েছিল একটি প্রভাতী শোভাযাত্রা। অনুষ্ঠানে বেলুড়মঠ রামকৃষ্ণ মিশনের নীলাঞ্জন মহারাজ ও মহানাগরিক-সহ উপস্থিত ছিলেন অন্যরা। পুজোর প্রতিদিনই থাকছে সাংস্কৃতিক ও অন্য অনুষ্ঠান। ২৩ পল্লির দেবীমূর্তি হস্তশিল্প ও নান্দনিকতার একটি অপূর্ব দৃষ্টান্ত।
|
প্রণাম |
দেখভাল করার লোকের অভাবে ও অন্যান্য কারণে আমাদের দেশে বয়স্ক নাগরিকদের একটা বড় অংশই নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে বাধ্য হন। এমন মানুষের সংখ্যা কলকাতা শহরেও কম নয়। তাঁদের সাহায্যের জন্য বছর দু’য়েক আগে কলকাতা পুলিশ ও দ্য বেঙ্গল-এর যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘প্রণাম’। শহরের ৪৮টি থানা (এখন ৬৫) এলাকা থেকে প্রায় ৪২৬৪ জন প্রবীণ নাগরিক সদস্য হয়েছেন ‘প্রণাম’-এর। ২৪১৯-০৭৪০ নম্বরে ফোন করে বা http://www.pronam.in-এ লগ ইন করে যোগাযোগ করা যাবে। প্রত্যেক থানাতেই আছে এর শাখা। সম্প্রতি আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার প্রণাম-এর শাখা সংগঠনের প্রবীণ সদস্যরা প্রকাশ করেছে ‘শেষ থেকে শুরু’ নামে এক দেওয়াল পত্রিকা। প্রবীণ নাগরিকদের সঙ্গে থানার আধিকারিকরাও লিখেছেন সেখানে। ১ অক্টোবর অঞ্চলের প্রবীণ নাগরিকদের বাসে করে প্রতিমা দর্শনের ব্যবস্থাও করেছিল এই শাখা সংগঠন।
|
ভারিয়া শিল্পী |
|
মধ্যপ্রদেশের ছিন্দওয়ারার পাতালকোট গ্রাম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০০০ ফুট উপরে। চারিদিকে পাহাড়, মাঝে পঁচাত্তর বর্গকিলোমিটার জায়গায় ১৫টি গ্রামে ভারিয়া জনজাতির প্রায় ২৭০০ জনের বাস। এখানকার প্রাচীন কাঠখোদাই মুখোশ শিল্প এখন অবলুপ্তির পথে। মাত্র ৪ জন ভারিয়া শিল্পী এখনও এই কাজ করেন। তাঁদেরই এক জন, বাহান্ন বছর বয়সী ব্রিজলাল ভারতী এসেছেন বাগমারি ইয়ুথ প্রোগ্রেসিভ অ্যাসোসিয়েশন-এর মণ্ডপ সাজাতে। ছোট ছোট কাঠের টুকরোর উপর ছেনি, হাতুড়ি, বাটালি দিয়ে গাছ, ষাঁড়, মানুষ, গৃহবধূর মুখের আদলে ‘মুখুটি’ খোদাই করেছেন ব্রিজলাল। তাঁর সঙ্গেই কাজ করেছেন মধ্যপ্রদেশেরই পাঠানগড় অঞ্চলের গোন্দ জনজাতির ‘ভিত্তিচিত্র’ শিল্পী দু’ই সহোদর ভাই অনিল ও সুনীল টেকাম। গোন্ড চিত্রসম্ভার দিয়ে সাজানো হয়েছে মণ্ডপের প্রবেশপথ। কেমন লাগছে কলকাতা শহর? এখানে তাঁরা এসেছেন তাঁদের ‘কাজ’ দেখাতে, আর ফিরে যাবেন এই শহরের বাস-ট্রাম, উঁচু উঁচু বাড়ি আর দুর্গাপুজোর অভিজ্ঞতা নিয়ে জানালেন ব্রিজলাল। সঙ্গে তাঁরই ছবি।
|
আকাশছোঁয়া |
উচ্চতা বাহান্ন ফুট! বিধাননগরের গাছে-ভরা রাস্তায় দূর থেকেই দেখা যাবে আকাশছোঁয়া মূর্তি! এফ ডি ব্লক-এর আয়োজনে কলকাতার বৃহত্তম প্রতিমা! ‘ফাইবার-গ্লাসে তৈরি, ইনি বিসর্জনে যাবেন না, খুলে ফেলার পরে হয়তো রূপান্তর হবে, ‘রি-সাইক্লিং’, জানালেন এফ ডি ব্লক সর্বজনীনের সভাপতি প্রদীপ সেনগুপ্ত! আবার, এই ‘রি-সাইক্লিং’-এর মতোই কী ভাবে চেনা ‘ইমেজ’ ফিরে আসে অচেনা আবহে, তারই চেহারা হাজরা-র কাছে ‘সাধনা সংঘ’-এর পুজোয়। ভাস্কর শ্যামল রায়ের ভাবনায় সদ্যপ্রয়াত মকবুল ফিদা হুসেন-এর বিভিন্ন ইমেজ দিয়ে মণ্ডপ। সঙ্গে চায়না ক্লে-র প্রতিমা, গড়েছেন চন্দ্রিমা রায়।
|
আশীর্বাদী |
সকলের মঙ্গলকামনাই মাতৃপুজোর প্রধান লক্ষ্য। দেবীস্তুতি একই, তবু বিভিন্ন পরিবারে লক্ষ করা যায় নানা রীতি। যেমন বেহালার মুখোপাধ্যায়বাড়ির মূর্তির চালচিত্রের পেছনের একটি কুলুঙ্গিতে বোধনের পরে জ্বালানো হয় একটি প্রদীপ। সামনে থেকে যা অদৃশ্যই থাকে। পুজোর ক’দিন জ্বলতে থাকে অনির্বাণ এই শিখা। ওঁদের কাছে এ হল ‘বংশরক্ষা প্রদীপ’। তিনটি বলি-র রক্ত দিয়ে দশমীতে নিভবে এই প্রদীপের আলো। এর পর তৈরি হবে কাজল। বিশ্বাস, এই ‘রুধির কাজল’-এর ‘টিকা’ পরলে বা অঙ্গে ধারণ করলে পাওয়া যাবে মায়ের আশীর্বাদ। এই ঐতিহ্য এ পরিবারের নিজস্ব, আজও চলছে সেটি নিয়ম মেনেই।
|
ত্রিমাত্রিক |
সুসজ্জিত মণ্ডপ, আলোর রোশনাইয়ের ভেতর চোখ জুড়নো প্রতিমা। যার পেছনে শুধুই বাঁশ, কাঠ, খড়ের জঙ্গল। এই রূপেই দেব-দেবীরা পূজিত হন মণ্ডপে মণ্ডপে। ত্রিমাত্রিক প্রতিমা বানিয়ে সেই চিরাচরিত রূপ এ বার বদলে দিলেন সঙ্ঘশ্রী এবং কুমোরটুলি সর্বজনীন পুজোর উদ্যোক্তারা। কলকাতা থিম দেখছে বেশ কিছু দিন ধরেই। তবে ১৯৪৬-এ সঙ্ঘশ্রীর পুজো শুরুর সময় বিশেষ কেউ এ সব নিয়ে ভাবেননি। সঙ্ঘশ্রী বরাবরই প্রতিমা-কেন্দ্রিক নানা থিম এনেছে। থিমের জন্য রাধা ফিল্ম স্টুডিয়ো থেকেও সেট ভাড়া করে আনা হত। এ বার ওঁদের মণ্ডপে ত্রিমাত্রিক প্রতিমাকে দেখা যাচ্ছে সচল অবস্থায়। পুরোটাই আলোর কারসাজি। পরিবেশের কথা ভেবে রং নয়, প্রতিমার সাজ নকশাদার কোলাজে। দিন-রাত মণ্ডপ আলোময়। ভাবনা শিল্পী সুশান্ত পালের। কুমোরটুলিতে প্রতিমা ত্রিমাত্রিক হয়েছেন থিমের প্রয়োজনে। সৃষ্টি ও শান্তির এই থিমে দেখা যাচ্ছে অসুর স্বয়ং আহ্বান করে আনছেন মা’কে। প্রতিমা শূন্যে ভাসমান। নীচে জলাশয়। এ সবকে প্রদক্ষিণ করে দর্শনার্থীরা দেখছেন ত্রিমাত্রিক প্রতিমা। পরিকল্পনা শিল্পী সুবল পালের।
|
আড়াইশো পূর্ণ |
|
আড়াইশো বছর পূর্ণ করল ঝামাপুকুর চন্দ্রবাড়ির দুর্গাপুজো। আঠেরো শতকের মধ্যভাগে আদি সপ্তগ্রাম থেকে জোড়াসাঁকোয় এসে বসতি স্থাপন করেন সোনার কারবারি কালাচাঁদ ও রামপ্রসাদ চন্দ্র। পরিবার সূত্রে জানা যায়, তাঁরা ১৭৬১-তে প্রথমে সেখানেই শিবদুর্গা মূর্তিতে দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন। রামপ্রসাদের এক উত্তর পুরুষ সুবলচাঁদ ঝামাপুকুর অঞ্চলে ২৪এ বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিটে নতুন ভদ্রাসন ও ঠাকুরদালান তৈরি করে সেখানে পুজোটি নিয়ে আসেন। আশ্বিনের কৃষ্ণাপ্রতিপদ তিথি থেকে বোধন, পুজো হয় বৈষ্ণবীয় রীতিতে। ২৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাম-সীতার মূর্তি স্থাপন করা হল গতকাল ষষ্ঠীর দিন। এই পরিবারে এখনও পুজো উপলক্ষে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পুরনো রীতি বজায় আছে।
|
প্রকৃতির শিল্পী |
দু’হাজার ছয়-এ ‘পাথুরিয়া শ্মশানমেলা’য় বাঁকুড়া বড়জোড়ার প্রশান্ত দাস (২১) বেড়াকাঠের কাজ করে তাঁর ক্যানভাসে ছোটদের দিয়ে আঁকিবুকি করিয়ে নজর টানেন মেলায় গান করতে আসা শিল্পী সৈকত মিত্রের। সেই বছর ডাক পড়ে কলকাতার পশ্চিম পুঁটিয়ারির মণ্ডপ করার। শুরুতেই আটটা পুরস্কার জোটে শরকাঠির তৈরি মণ্ডপের জন্য। ঠাকুরদা সুধীরচন্দ্র দাস ছিলেন বিখ্যাত শঙ্খশিল্পী। বাবা অমর দাস পাথুরিয়া শ্মশানমেলার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। প্রশান্তর প্রথাগত কোনও শিক্ষা নেই। প্রকৃতির কোলে জন্মানো জিনিস দিয়েই শিল্পসৃষ্টি করা তাঁর পছন্দের। দু’বছর ধরেই বাঘাযতীন উদয়ন সংঘের প্রতিমা ও মণ্ডপ করার দায়িত্ব তাঁর ওপর। এ বারে কোনও কৃত্রিম রং ব্যবহার না করেই বেলের কাণ্ড ও বেল দিয়ে সৃষ্ট হচ্ছে প্রতিমা ও মণ্ডপ। প্রশান্তর আক্ষেপ, পুজো কমিটির ধারাবাহিক প্রশংসা পেলেও এখনও জোটেনি বিপিএল কার্ডও। গ্রামে এর-ওর বাড়িতে চলছে তাঁর শিল্পভাবনার বাস্তবায়ন।
|
যারা পরিযায়ী |
হাতে নিলে মন ভাল হয়ে যায়। যারা পরিযায়ী-র শারদ সংখ্যা। পাতা ওলটালেই যেন পালাই-পালাই করে মন। প্রবীরকুমার সেনের ‘নিছক ভ্রমণ ডায়ারি’, রতনলাল বিশ্বাসের ‘এক অসমাপ্ত ভ্রমণ’ তো উদাহরণ মাত্র... কত রকমের রচনা! যেমন তুষারশুভ্র নিসর্গের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে দেবাশিস বিশ্বাসের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘আনিনির পথে’ পাঠককে পৌঁছে দেবেন দেবল সেন। পাশাপাশি আবার ‘সিমলিপালের খৈরী’ নিয়ে রতনলাল ব্রহ্মচারী আর সত্যজিতের ‘সিকিম’ নিয়ে দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের রচনা। চোখজুড়ানো ফোটোগ্রাফ, চমৎকার পাতা, ঝকঝকে ছাপা।
|
পুজোর দিনবদল |
|
সংস্কৃতি বা রুচি বিষয়ে প্রবীণদের সঙ্গে উত্তর-প্রজন্মের যে ধারণাগত ব্যবধান স্বাভাবিক এবং অনিবার্য, দুর্গাপুজোয় উৎসবের প্রকাশরূপেও তা বারে বারে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। লিখেছেন সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। সদ্য প্রকাশিত তাঁর দুর্গা পুজো/বড়োবাড়ি থেকে বারোয়ারি (এল অ্যালমা পাবলিকেশনস, ১২৫.০০) পড়তে পড়তে কলকাতার দুর্গাপুজোয় প্রতিমার ধরন থেকে উৎসবের রূপ কালে-কালে কী ভাবে বদলেছে তারই একটা হদিশ হাতে এসে যায়। গম্ভীর গবেষণাধর্মী বা হালকা কোনও ধরনের রচনাই নয়, ইতিহাসকে পটভূমিতে রেখে স্মৃতিতে ফিরে যাওয়া, আবার স্মৃতির ফাঁকে ফাঁকে সমাজ-রাজনীতির উপকরণও ভরে দেওয়া। সন্দীপের গ্রন্থরচনার এ-ধরনটির সঙ্গে মেশানো মুদ্রণ পারিপাট্য আর নানা প্রতিমার ছবি।
|
বড্ড ভারী |
‘দরজা খুললেন কল্পনা যোশী। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সেই বিপ্লবী-কন্যা কল্পনা দত্ত। কী সুন্দর দেখতে!...’ ক্রোড়পত্র:১-এ স্বপ্না দেবের ‘আত্মকথা অথবা নেম ড্রপিং’ কমিউনিস্ট ব্যক্তিত্বদের নিয়ে স্মৃতি। রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের আখ্যান। গল্প-কবিতা ছাড়াও একগুচ্ছ প্রবন্ধ শারদীয় অনুষ্টুপ-এ (সম্পা: অনিল আচার্য)। অর্থনীতি নিয়ে অবশ্যপাঠ্য মৈত্রীশ ঘটক এবং পরীক্ষিৎ ঘোষের লেখা। প্রদীপ বসুর ‘কে আধুনিক? আধুনিকতাই বা কী?’ এস ই জেড নিয়ে অনিতা অগ্নিহোত্রীর লেখা। ‘আটপৌরে ফেসবুক’-এ শাশ্বতী ঘোষ মেয়েদের কত রকমের জীবনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন পাঠককে। এ রকম নানা রচনায় ঋদ্ধ, অথচ সংখ্যাটি এতই বেঢপ যে হাতে নিয়ে পড়তে রীতিমত অসুবিধে হয়। পুরনো কলকাতার বিজ্ঞাপন ইত্যাদি নিয়ে কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্তের তিনশো পাতার ক্রোড়পত্রই একে ভারী করেছে। লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাসে আরও অনেক প্রথমের মতো এটাও বোধহয় অনুষ্টুপ-এর কৃতিত্ব, তবে সেটা কিন্তু পাঠকের অস্বস্তিরও কারণ হয়ে উঠতে পারে।
|
মাটির সাজ |
|
পারিবারিক পুজোগুলিতে এক সময়ে পুরো মাটি দিয়েই তৈরি হত দুর্গা প্রতিমার গয়না। কিন্তু আঙুল দিয়ে মাটির উপর সূক্ষ্ম অলঙ্করণের সেই শিল্পটা প্রায় হারিয়েই গেল ডাকের সাজ এবং শোলার সাজ আসার পরে। খুব কম কয়েকটি বাড়িতে এখনও মাটির গয়নার প্রচলন থাকলেও সর্বজনীন পুজোর প্রতিমায় এ দৃশ্য এখন প্রায় বিরল। প্রায় হারিয়ে যাওয়া সেই শিল্প এবার দেখা গেল কানাই ধর লেন ‘অধিবাসীবৃন্দ’র প্রতিমায়। এবার তাদের থিম ‘ফিরে চল মাটির টানে’। রঙিন টেরাকোটার পুতুল দিয়ে সাজানো মণ্ডপের সঙ্গে মানানসই অস্ত্র, গয়না-সহ পুরো মাটির প্রতিমাটি তৈরি করেছেন মেদিনীপুর জেলার পাঁশকুড়ার শিল্পী বীরেন্দ্রনাথ মাইতি। সঙ্গের ছবিতে ধরা পড়েছে প্রতিমার মুকুট তৈরির একটি মুহূর্ত।
|
দশভুজা |
ইংরেজি সাহিত্য, কবিতা, ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা, মডেলিং, ধ্রুপদী নাচ, মুম্বই এবং দক্ষিণী সিনেমা-দুনিয়া! একই অঙ্গে এত রূপ, এবং সেই ষড়ৈশ্বর্য নিয়ে, এতকাল পরে, তিনি পা রাখছেন টলিউডে। রিচি রোডের মেয়ে কমলিনী মুখোপাধ্যায় পুজোর আগে দ্রুত ছুঁয়ে গেলেন তাঁর এই জন্মশহর। অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর নির্মীয়মাণ ছবি ‘অপরাজিতা তুমি’-র অন্যতম নায়িকা তিনি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কয়েকটি ‘সিকোয়েন্স’ শুট-এর সূত্রে সহসা কলকাতা আগমন। সেই কমলিনীকে ‘মিস’ করেন যে কবিতা লিখত, কবিতা লিখে বিদেশ গিয়েছিল? প্রশ্ন শুনে চঞ্চলা সুন্দরীর মুখে অন্য রকম আলো, উঁহু, মিস করব কেন, এখনও তো লিখি, একটু সময় পেলেই...। প্রশ্ন এটাই যে, সময় কোথায়? তামিল, তেলুগু, কন্নড় এবং মলয়ালম ছবির ব্যস্ততম নায়িকাদের একজন তিনি, কমল হসনের মতো কিংবদন্তি তাঁর সহ-অভিনেতা, পাশাপাশি সমান্তরাল ছবির সুখ্যাত পরিচালক শাজি এন করুনের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ফিল্ম ‘কুট্টি শ্রাঙ্ক’-এও তিনিই নায়িকা! কী করে এত দিক সামলে চলেন, সেই প্রশ্নটি অন্তত দশভুজার দেবীপক্ষে নিরর্থক। বস্তুত, মনের টানেই তাঁর এই বহুমাত্রিক ভেসে-চলা! না হলে দিল্লিতে ম্যানেজমেন্ট কোর্স করতে করতে মাঝপথে আচমকা কেউ ছেড়ে দেয়? কিংবা, প্রথম হিন্দি ছবিতেই পরিচালক রেবতী (ফির মিলেঙ্গে), সহ-অভিনেতা অভিষেক বচ্চন, শিল্পা শেট্টি! মন-পবনে নাও ভেসে চলেছে। কমলিনী হাসছেন। |
|
|
|
ফরিদ-পুর |
নিবাস ব্যারাকপুর। পেশায় শিল্পী। যে গোত্রের শিল্পী, তাতে কোনওক্রমে দিন গুজরান হয়, কিন্তু স্বীকৃতি নেই। সুতরাং, গত পনেরো বছর ধরে এঁকেই চলেছেন ফরিদভাই তাঁর চলমান ক্যানভাসে ট্রাক, ম্যাটাডোর, ছোট লরি...। গাঢ়, উজ্জ্বল রং, বিপরীত বর্ণেরা সটান পাশাপাশি, সঙ্গে দু-এক পংক্তিতে নানাবিধ জীবনসত্য, ধরা যাক, বুরি নজরেওয়ালে... বা ৮০ বন্ধু...! ধূসর হাইওয়ে আর বিবর্ণ জীবনের পটে রংয়ের বিস্ফার! সেই বর্ণ-মালাকেই ভাষা দেন তিনি। দাদুর হাত ধরেই গাড়ির কাঠে ছবি আঁকার শুরু। অতঃপর, কী ভাবে সেই সব ছবিই উঠে এল দক্ষিণ কলকাতার মাদুরদহ ঐকতান সর্বজনীনের মণ্ডপে, সে এক দীর্ঘ কাহিনি, কিন্তু এই মুহূর্তে ফরিদভাই খুশি। কয়েক দিন আগেই তুলি বোলাচ্ছিলেন দ্রুত। ওই যে ঝলমলে ‘ওয়েলকাম’, তারপর ফুল-দেওয়া মেয়ে, নানারকম ফুল আর কল্কা সব জেগে উঠেছে এই মণ্ডপে। দু’ধারে ইনস্টলেশনের মতো অটো, টেম্পো, রিকশা... মাঝখানে টায়ার দিয়ে প্রবেশ-প্রস্থানের ভাগ! দেবী এখানে আক্ষরিকই ‘বাহন-বাহিনী’! ‘দেবী এবং তাঁর সন্ততিদের বাহনের সঙ্গে আমরা যোগ |
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য |
করতে চেয়েছি এ কালের নানাবিধ বাহনকে, সংক্ষেপে সেটাই থিম’, উদ্যোক্তাদের পক্ষে জানালেন সৌভিক পয়রা। ভাবনার মূল কাঠামোটি তাঁরই। আয়োজনটি অভিনব। সঙ্গে কাল বাদ পরশু নবমীতে আছে ফরিদভাই-সহ কয়েকজন ট্রাক-শিল্পীর সংবর্ধনা। সাধু উদ্যোগ! কেউ ভোলে, কেউ ভোলে না...। |
|
|
|
|
|
|
|