লক্ষ্য গ্রামীণ বাজার
মা, ওই বিস্কুটটা দাও, যাত্রার
সংলাপেও ঢুকল পণ্যের প্রচার

বিকাশবাবু ঘরে ঢুকতেই স্ত্রী এলোকেশী কেঁদে জিজ্ঞেস করলেন ‘ওগো, তুমি এ ক’দিন কোথায় ছিলে?’ বিকাশবাবু বললেন, ‘সে অনেক কথা। পরে বলছি।’ এলোকেশী বললেন, ‘‘তুমি একটু বসো। তোমার জন্য নতুন স্বাদের গ্লুকোজ আনছি।’’ সেই পানীয় খেয়ে ধাতস্থ হলেন বিকাশবাবু।
বাঁকুড়ার গ্রামে যাত্রার আসরে যখন এই দৃশ্য চলছে, ঠিক সেই সময়ে জলপাইগুড়ির রাজাভাতখাওয়ার যাত্রামঞ্চে এক যুবক পেটের ব্যথায় ছটফট করছেন। তাঁর বৃদ্ধা মা চামচে করে তরল ওষুধ খাইয়ে দিয়ে আশ্বস্ত করে বললেন, “ঠিক হয়ে যাবে বাবা। এই বিশেষ ‘মিকচার’ খেয়ে নে, এক্ষুনি ব্যথা কমে যাবে।”
পূর্ব মেদিনীপুরের ইটাবেড়িয়াতেও পালা চলছে। স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে বিপাশা পরকীয়া প্রেমে ডুব দিয়েছে। অতি ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে বিপাশা প্রেমিকের গলা জড়িয়ে ধরে আবদার করে বলল, “এর পর যেদিন আসবে, আমার জন্য কিন্তু ফর্সা হওয়ার অমুক ক্রিম আনবে।”
মালদার চাঁচলে যাত্রাপালায় স্বামী-স্ত্রী ঝগড়ায় ব্যস্ত। বাচ্চা ছেলে কাঁদতে কাঁদতে ঢুকে খাবার চাইল। মা অস্বস্তিতে পড়ে বললেন, “এখনও রান্না হয়নি। একটু সবুর কর!” বাবা বললেন, “ঘরে তো নতুন কোম্পানির ক্রিম বিস্কুট আছে, আপাতত তাই দাও না কেন।” ছেলে কান্না থামিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমাকে ‘কিম’ বিস্কুট দাও। আমি খুব ভাল খাই।”
জনপ্রিয় পালার একটি দৃশ্যে অনল ও কাকলি
এ সবই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন। যেগুলি জুড়ে দেওয়া হয়েছে যাত্রার সংলাপে। বহুজাতিক থেকে শুরু করে কর্পোরেট, স্থানীয় ক্ষুদ্র উদ্যোগীর স্বাস্থ্যপানীয়, প্রসাধনী, বিস্কুট, শ্যাম্পু, হাতঘড়ি, মশলা, জুতো, দাঁতের মাজন এমনকী মোবাইল ফোন-সহ নানা দ্রব্যের বিজ্ঞাপন যাত্রার মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রামে। সিনেমার অতি পরিচিত ‘ইন ফিল্ম’ বিজ্ঞাপনী প্রচারের ঢেউ আছড়ে পড়েছে যাত্রাতেও। সিনেমায় যেমন বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রচার দীর্ঘদিন আটকে ছিল দৃশ্যের গণ্ডিতেই। কিন্তু তার পর ক্রমে বেশ কিছু ছবির সংলাপেও জায়গা নেয় তারা। অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘বিরুধ’ ছবিটির কথা এ প্রসঙ্গে অনেকেরই মনে পড়বে। সেই রীতি কিন্তু গত সাত-আট বছরে জাঁকিয়ে বসেছে যাত্রাতেও।
বাংলা যাত্রা জগতের জনপ্রিয় জুটি অনল-কাকলি। অনলবাবুর কথায়, “যেখানে এখনও বিদ্যুতের তার ঢোকেনি, যে গ্রামে কোনও টিভি নেই, যে গ্রামে খবরের কাগজ দু’একটা এলেও দু’-চারজনের বেশি পড়তে পারেন না সেই সব গ্রামের মানুষের কাছে আমরা খুব সহজে পৌঁছে যাই। যাত্রা শেষ হয়ে গেলেও যাত্রার সংলাপ গ্রামের লোকের মুখে মুখে ঘোরে। তাই, যত দিন যাচ্ছে যাত্রার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়ার মাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।” চিৎপুরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গত বছর সাত-আট বছরে বিজ্ঞাপনের বিষয়টি ব্যাপক ভাবে যাত্রাজগতে ঢুকে পড়েছে। একটি দলের ম্যানেজার সৃষ্টিধর পাল বললেন, “বিজ্ঞাপনদাতারা যাত্রামাধ্যমকে বেছে নেওয়ায় পারস্পরিক সুবিধা হয়েছে। আমরা যেমন ওঁদের প্রোডাক্টকে গাঁ-গঞ্জের মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি, আমরাও ওঁদের কাছ থাকে কিছু টাকা পাচ্ছি। যা পালা নামাতে যথেষ্ট সাহায্য করছে।” কত টাকা পাওয়া যায়? আর এক দলের ম্যানেজার বিজয় ভট্টাচার্য বলেন, “বিশ হাজার টাকা থেকে শুরু করে দু’-তিন লাখ টাকা। ক্ষেত্র বিশেষে পাঁচ লাখ টাকাও বিজ্ঞাপনদাতারা দিয়ে থাকেন।”
বিজ্ঞাপনদাতাদের আগ্রহের কারণ আছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক শুভেন্দু দাশগুপ্তের ব্যাখ্যায়, আয়ের একটা বড় অংশই তো গ্রামে রয়েছে। গ্রামে ছড়িয়ে রয়েছে একটা বড় বাজার। “চাষ থেকে আয়ের সিংহভাগই বড় চাষির হাতে। ছোট আড়তদারের সংখ্যাও যথেষ্ট। গ্রামে সিনেমার চরিত্রের চেয়ে যাত্রার চরিত্রকে অনেক বেশি আপন মনে করেন দর্শকেরা। তা ছাড়া যাত্রায় উপস্থাপনার ভঙ্গিটিও বেশ চড়া মেজাজের হওয়ায় তা মনে প্রভাব ফেলার ক্ষেত্রে অন্য একটা মাত্রা যোগ করে।” কলকাতার একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার সূত্রে জানা গেল, তাঁদের দ্রব্যটিকে গ্রামীণ বাংলায় পৌঁছে দিতে যাত্রাই সবচেয়ে আকর্ষণীয় মাধ্যম। যাত্রার লিফলেটের সঙ্গে বা পোস্টারে পণ্যের বিজ্ঞাপন দেওয়ার সঙ্গে যাত্রার সংলাপে জুড়ে দিলে ফল অনেক ভাল হয়, বলে দাবি করলেন ওই সংস্থার এক কর্তা অভিজিৎ দে। তাঁর কথায়, “যদি এক বার বা দু’বার আকর্ষণীয় মুহূর্তে নায়ক বা নায়িকা পণ্যটির কথা বলেন, দর্শকমনকে তা অনেক বেশি প্রভাবিত করে।” যাত্রা নিয়ে এক দশকের উপর গবেষণা করে চলেছেন প্রভাত দাস। তিনি বললেন, “চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেও যাত্রার হ্যান্ডবিল, পোস্টারে প্রসাধনী দ্রব্য ও স্থানীয় হোটেলের বিজ্ঞাপন থাকত। সেগুলো খুব কার্যকরী হয়েছে বলে মনে হয় না। সংলাপের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ায় তা অনেক বেশি প্রভাব ফেলছে।”
বিজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসেবে যাত্রার ব্যবহার অভিনব হলেও অবশ্যম্ভাবী ছিল বলেই মনে করেন বিজ্ঞাপন জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব রাম রায়। তিনি বলেন, “চিন্তা করলে দেখা যাবে, যাত্রার মতো লোকশিল্পকে কয়েক হাজার বছর ধরে প্রচার এবং প্রসারের মাধ্যম হিসেবেই ব্যবহার করা হয়েছে। মহাকাব্যের গল্প তো যাত্রা, আখড়া, চিত্রকরদের হাত ধরেই ছড়িয়েছে। বাইবেলও তো গল্পকারদের মুখে মুখেই প্রচারিত হয়েছিল।” বিজ্ঞাপন ও বিপণন বিশেষজ্ঞ শিলু চট্টোপাধ্যায় বললেন, “গ্রামের বাজার ধরতে যাত্রার জুড়ি নেই। খবরের কাগজের পাঠক সীমিত। ইন্টারনেট নেই বললেই চলে। টিভি থাকলেও বিদ্যুতের সমস্যা রয়েছে। এফএমগুলো এখনও শহরকেন্দ্রিক। ফলে যাত্রার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। খুশি মনে মানুষ যখন যাত্রা দেখতে বসেন, তাঁর মনে পণ্যের প্রচার অনেক বেশি ছাপ ফেলে। গ্রামীণ বাজারে যে সব পণ্যের চাহিদা রয়েছে, তার বিজ্ঞাপনে যাত্রা খুবই কার্যকরী।”
সিনেমা থেকে যাত্রা বিজ্ঞাপন ঢুকে পড়েছে সর্বত্রই। এ বার কি তবে নাটকের পালা? পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় বললেন, “হলে আশ্চর্যের কিছু নেই। এবং আমার ধারণা, হবেও। সেটা যদি নাটক ও চরিত্রের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়, তাহলে আপত্তি নেই।” সুমনের মতে, বিশ্ব-অর্থনীতির গতি যে দিকে শিল্প তার বাইরে নয়। চিত্রশিল্পীদেরও আজকাল অনেক সময় ‘বাস্তু’ মেনে ছবি আঁকতে হচ্ছে। সিনেমায় যেমন খুব স্বাভাবিক গতিতেই ব্র্যান্ড এসে পড়ে, যাত্রা বা নাটকেও তার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বলেই মনে করেন তিনি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.