|
|
|
|
|
|
|
নাটক সমালোচনা... |
|
শম্ভু মিত্র এবং কয়েক জন |
এই প্রথম তাঁকে নিয়ে নাটক। আগামী কাল। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী |
তাঁর মৃত্যুর পর ১৪ বছর অতিক্রান্ত। ‘নবান্ন’ থেকে ‘উলুখাগড়া’, ‘রাজা অয়দিপাউস’, ‘চাঁদবণিকের পালা’ সবই আজ ইতিহাস। আর, ‘নাট্যরঙ্গ’-র উদ্যোগে সেই ইতিহাস ফের জীবন্ত হয়ে উঠবে আগামী কাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়, মধুসূদন মঞ্চে। নামবে নাটক ‘শ্রীশম্ভু মিত্র’।
নামভূমিকায় সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভাস চক্রবর্তীর ‘হ্যামলেট’ বা দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘বিকেলে ভোরের সর্ষে ফুল’ নাটকে অভিনয়ের জেরে হইচই ফেলে দিয়েছেন যিনি। কিন্তু তা বলে, শম্ভু মিত্র? শুধু অভিনয় নয়, নাটকটা সুরজিতেরই লেখা। এ বার তিনি যুগপৎ নাট্যকার এবং অভিনেতা!
ব্রাত্য বসুর ‘রুদ্ধসঙ্গীত’ নাটকের সাফল্যখচিত রাস্তায় মুগ্ধ পদার্পণ? সত্যটাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না সুরজিৎ, “‘রুদ্ধসঙ্গীত’ নাটকটা দেখার পরই পরিচালক স্বপন সেনগুপ্ত আমাকে আইডিয়াটা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তুই তো ওঁকে চিনতিস। শম্ভু মিত্রকে নিয়ে তা হলে নাটক লিখতে পারবি না?” এবং ব্রাত্যবাবুর পাশাপাশি আরও এক জনের কাছে ঋণস্বীকার করছেন তিনি, “কিন্তু ‘রুদ্ধসঙ্গীত’ তো দেবব্রত বিশ্বাসের জীবনী নয়। নাটকে ভালমন্দ নিয়ে গোটা মানুষটাকে ধরা যায়? এ সব ভাবতে ভাবতেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘তৃতীয় অঙ্ক, অতএব’ নাটকটা দেখি। আরে, এ ভাবেও তা হলে ভাবা যায়!” |
|
শম্ভু মিত্রের সাজে। |
শম্ভু মিত্রকে নিয়ে নাটক, ফলে ‘নাট্যরঙ্গ’-র এই প্রয়াসে জড়ো হয়েছেন আরও অনেকে। জীবনে প্রথম মঞ্চসজ্জায় কৌশিক সেন। তাঁরই পরিকল্পনায় মঞ্চে নৌকোর প্রতীক। এ কি চাঁদ বণিকের পাড়ি দেওয়ার প্রতীক? ওই নাটক পাঠের শেষেই তো শম্ভু মিত্রের গলায় মূর্ত হয়ে উঠত সেই লাইন - ‘তল নাই? পাড়ি দেও। এ আন্ধারে চম্পকনগরী তবু পাড়ি দেয় শিবের সন্ধানে। পাড়ি দেও, পাড়ি দেও।’ বেঁচে থাকা মানেই তো অন্ধকার, দিগভ্রান্ত সমুদ্রে পাড়ি।
মঞ্চের আড়ালে উৎপল দত্তের কণ্ঠ দিয়েছেন সুপ্রিয় দত্ত। নেপথ্যে আরও একজন। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। তিনিই ধরতাই দেন, “যখন তৃপ্তি মিত্র চিরকালের মতো চলে গেলেন, শম্ভুদা তাঁকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন।” সুরজিৎ, সুপ্রিয়, কৌশিকদের মতো তরুণরা শম্ভু মিত্রের সঙ্গে কাজের সুযোগ পাননি, কিন্তু রুদ্রবাবু? ‘গালিলেও’ থেকে ‘মুদ্রারাক্ষস’ বহু নাটকে তিনি শম্ভু মিত্রের সঙ্গে ছিলেন। “নতুন প্রজন্ম তো শম্ভু মিত্রকে চেনে না। তারা যদি নাটকটা দেখে একটু ভাবে, তাও অনেক,” বললেন তিনি।
নতুন প্রজন্মের কাছে শম্ভু মিত্র মানে? এই নাটকের সঙ্গে ব্রাত্য বসু জড়িত নন। তাঁর মনে হয়, “বাংলা উচ্চারণ যা হতে পারত, কিন্তু হয়নি, শম্ভু মিত্র সেই সম্ভাবনার প্রতীক।” সুরজিৎ এবং কৌশিক অন্য মত, “শম্ভু মিত্র মানে সেই মানুষ, যিনি আপস করেন না। আর সেই আপসহীন নিঃসঙ্গতায় স্বরাট।”
নাটকের এক জায়গায় উৎপল দত্ত এবং শম্ভু মিত্রের কথোপকথন। উৎপল বলেন, ‘আমার নাটকে লাল পতাকা কত উদ্বেল হত জানেন!’ শম্ভু মিত্রের পাল্টা উত্তর: ‘আজও তারা উদ্বেল সবুজ আবির নিয়ে।’ |
|
সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় |
এখানেই বাংলা নাটকের নতুন প্রকরণ। দেবব্রত বিশ্বাসের সময় ‘মাওবাদী’ শব্দটার অস্তিত্ব ছিল না, কিন্তু ‘রুদ্ধসঙ্গীত’ নাটকে তাঁর মুখেই ‘মাওবাদী না কামাওবাদী’ সংলাপ এসেছিল। “শম্ভু মিত্রকে আমরা শ্রদ্ধার্ঘ্য দিতে চাইছি। আর তাতে ব্রাত্যই ট্রেন্ডসেটার,” বলছেন কৌশিক। দুটি নাটকের তফাতও বুঝিয়ে দিচ্ছেন তিনি, “‘রুদ্ধসঙ্গীত’ আসলে কমিউনিস্ট পার্টি বনাম শিল্পীর লড়াই। কিন্তু দোষগুণ মিলিয়ে দেবব্রত বিশ্বাস মানুষটি সেখানে পুরো থাকেন না। আর এই নাটকে আমরা শম্ভু মিত্রকেও প্রশ্ন করতে ছাড়িনি। কেন ‘গালিলেও’ প্রযোজনার সময় তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ধরণী ঘোষকে ডাকেন না? কেন তিনি হুমায়ুন কবীরের নির্বাচনী সভায় যাওয়ার পরই বহুরূপী সরকারি অনুদান পায়?”
আর ‘পথিকৃৎ’ ব্রাত্য? আগামী কাল এই নাটকের প্রথম শো-র সময় তিনি বিদেশে। থিয়েটারের কমরেডদের এই উদ্যোগে তাঁর প্রতিক্রিয়া: “ভালই তো! নাটকটা নামুক। লোকে কী বলছে, তার পর দেখা যাবে।”
লোক? ‘রুদ্ধসঙ্গীত’ নাটকে দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্রের মতো চরিত্ররা এসেছিলেন সরাসরি। এখানে ‘বহুরূপী’র বিভিন্ন নাটকের চরিত্ররা শম্ভু মিত্রকে ডাকে, তাঁর সঙ্গে কথোপকথন চলে...
বেণীনন্দন: এর যুগ শেষ হয়ে ওর যুগ আসে। পাল্টাতে হয়। বদলাতে হয়।
শম্ভু মিত্র: এক রাজশক্তি যায়, গণতন্ত্রের নামে আর এক রাজশক্তি আসে। কিন্তু পাল্টানোর নামে একজন আর একজনকে নকল করে।
তিনি, শম্ভু মিত্র তো বরাবরই বৃত্তের বাইরে, একা। কে ভুলতে পারে ‘দশচক্র’ নাটকের শেষে ট্রাঙ্ক টানতে টানতে তাঁর বেরিয়ে যাওয়া, “কাউকে না-কাউকে তো সমাজটার বিরুদ্ধে একা দাঁড়াতেই হয়।”
সেই একা দাঁড়ানোর সাহসকেই শ্রদ্ধার্ঘ্য। কমিউনিস্ট সংঘকে প্রত্যাখ্যান করার কথা বলে প্রথম সিঁড়িটা তৈরি করেছিলেন ব্রাত্য। এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয় ধাপ, যখন বাংলা নাটক লাল-সবুজ সব সঙ্ঘকেই প্রত্যাখ্যান করার কথা বলে। তখনই মনে পড়ে যায় ‘নাটমঞ্চের দিশা’ নিবন্ধে শঙ্খ ঘোষের সেই লাইন, ‘সহজের পথ নেয়নি বহুরূপী, সেখানেই তার ঐতিহাসিক মর্যাদা আর সামর্থ্য। সূচনার সেই সামর্থ্যবিন্দুটাকে বুঝতে হয়তো আরও কিছুদিন সময় লাগবে আমাদের।’
আগামী কাল সেই সময়েরই যাত্রা হতেছে শুরু! |
|
|
|
|
|