|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
প্রতিবাদী চেতনার পাশাপাশি প্রশান্তির সন্ধান |
সম্প্রতি ইমামি চিজেল-এ অনুষ্ঠিত হল সম্মেলক
প্রদর্শনী ‘ভিজুয়াল ভেনচার্স’। দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ। |
বহু দিন ধরে চিত্রকলা আখ্যানের হাত ধরে চলতে চেয়েছে। আখ্যানের সহজ আকর্ষণ আছে। তা দার্শনিক প্রজ্ঞাকেও ছুঁতে পারে অল্প আয়াসে, যদি চিত্রীয় সংহতি ভারাক্রান্ত না হয়। আজও অবয়বের মধ্যে দিয়ে আখ্যানের জয়যাত্রা অব্যাহত। তবু এক সময় আধুনিকতাবাদী চিত্রকলা আখ্যান থেকে মুক্তি চেয়েছে। প্রাকৃতিক অবয়বের পরিচিত গণ্ডি থেকে বেরিয়ে প্রকাশের নিজস্ব আকাশ খুঁজেছে। ইউরোপে বিমূর্ত চিত্রকলার সূচনা ১৯১০ সাল নাগাদ ক্যানদিনস্কির ছবির মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের ছবির কথা ছেড়ে দিলে আমাদের আধুনিকতায় বিমূর্ত চর্চার শুরু চল্লিশের শিল্পীদের হাতে ১৯৬০-এর দশকে। এখন দু’টি রূপই পাশাপাশি চলছে নিজস্ব বৈভবে।
ইমামি চিজেল আর্টে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল সারা ভারতের নির্বাচিত কিছু শিল্পীর ছবি নিয়ে সম্মেলক প্রদর্শনী। তাতে মূর্ত ও বিমূর্তের পাশাপাশি উপস্থাপনা বুঝতে সাহায্য করে যে দুটি আঙ্গিকই এখনও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। ২২জন শিল্পীর প্রায় প্রত্যেকের দুটি করে ছবি নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘ভিজুয়াল ভেনচার্স’। কিউরেট করেছেন ড সাবা গুলরাইজ। শিরোনাম কোনও নির্দিষ্ট অভিমুখ ব্যক্ত করে না। নির্বাচনেরও কোনও নির্দিষ্ট নিরিখ নেই। তবু প্রদর্শিত ছবির সমৃদ্ধ নান্দনিকতা প্রদর্শনীটিকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে। সাম্প্রতিক চিত্রকলায় দুটি জোরালো প্রবণতা আছে। একটি আলোড়িত প্রতিবাদী চেতনা। অন্যটি প্রশান্তির সন্ধান।
অবয়বী ছবির প্রসঙ্গে আসা যেতে পারে আগে। আকবর পদমসীর ‘হেড’ শীর্ষক চারটি লিথোগ্রাফের ছাপচিত্রে মানবিক অস্তিত্বের সংকটই প্রাধান্য পেয়েছে। গোপী সরোজ পালের গুয়াশে ‘নটী বিনোদিনী’ রূপায়ণের সারল্যের মধ্যেই মানবীচেতনার বহুমাত্রিক স্পন্দনকে পরিস্ফুট করেছে। আর বি ভাস্করনের ছবিতে প্রতীক ও প্রতিমার দ্বৈতে গড়ে উঠেছে যে আখ্যানের পরিমণ্ডল, তাতে অস্তিত্বের জটিলতার মধ্যেও প্রশান্তিরই প্রাধান্য। রিনি ধূমল পুরাণকল্পমূলক প্রতিমায় আদিমতা ও লৌকিককে মিলিয়েছেন। সীমা কোহলির ‘গোল্ডেন উম্ব’ ছবিতে প্রতীক ও নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে সচিত্রকরণ প্রবণতা প্রাধান্য পেয়েছে। শেখর রায়ের অ্যাক্রিলিকে আঁকা বড় ক্যানভাসটিতে আখ্যান ও নাটকীয়তা যথেষ্ট জটিল হলেও তা খুব সার্থকভাবে কাব্যিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছে। সাদা কালোর প্রাধান্যে গড়া ছবিটিতে রয়েছে উপস্থাপনার চারটি স্তর। বৃষ্টি পড়ছে প্রসারিত হাতের উপর। বৃষ্টি পড়ছে ঘুমন্ত পথশিশুর শরীরে। আর মাঝখানে প্রবাহিত হচ্ছে জীবনের জঙ্গমতা। তাপস কোনার অবয়ব ভেঙে অস্তিত্বের সংঘাতকে প্রবল করে তুলেছেন ‘আ ন্যুড অবজার্ভার’ ছবিতে। শ্রীধর আইয়ারের ছবিতে মূর্ত ও বিমূর্তের সহাবস্থান।
|
|
|
শিল্পী: শেখর রায় |
শিল্পী: ইউসুফ |
|
একই ধরনের সহাবস্থান অনুভূত হয় অমিতাভ ধরের ‘সিটি স্পেস সাবার্বিয়া’ ক্যানভাস দুটিতেও। কিন্তু তাঁর প্রতিবাদী চেতনায় মূর্ততা প্রায় সম্পূর্ণই বিমূর্তে দ্রবীভূত হয়েছে। ইউসুফের ছবিতেও মূর্ত-বিমূর্তের এই সংঘাতটা অনুভব করা যায়। বিমূর্ততা দিয়েই তিনি বাস্তবের সংকটকে ধরতে চেয়েছেন। সুনীল দে-র বিমূর্ত ক্যানভাসে পরিস্ফুট হয় প্রচ্ছন্ন এক অধ্যাত্ম চেতনা। রৈখিক চিহ্নসমষ্টি অন্তহীন পৌনঃপুনিকতার মধ্য দিয়ে স্তব্ধ এক সুর জাগিয়ে তোলে। শমীন্দ্রনাথ মজুমদারের ছবিতে সেই সুর কেন্দ্রচ্যুত হয়ে ছড়িয়ে যায়। কখনও তা সংহত ছিল। তার পর বিশ্লিষ্ট হয়ে প্রসারিত হতে থাকে মহাবিশ্বের মতো। অচুথন কুদালুরের ছবি যেন রক্তবর্ণের এক আলোড়িত সিম্ফনি। উদ্ভাসিত লালিমার সঙ্গে অন্ধকারের সংঘাত। বিলাস সিন্দের অনামা ক্যানভাস দুটিতে নিসর্গের অনুরণন রয়েছে। গোপী গজওয়ানির বিমূর্ততায় প্রচ্ছন্ন এক নাটকীয়তা আছে। ফৈজা হুমার ছবিতে সেই নাটকীয়তা আরও প্রচ্ছন্ন। আয়তাকার চিত্রক্ষেত্র আলোকিত বর্ণের উদ্ভাসে সমাকীর্ণ। তার মধ্যে চারটি কৃষ্ণাভ বর্ণের চিহ্নপ্রতীকের টানাপোড়েন। হর্ষবর্ধন স্বামীনাথন আদিমতার জ্যামিতিক চিহ্নপ্রতীক ব্যবহার করে প্রশান্তির পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন। জিনসুক সিন্দের ‘রিদম অব আ ডে’। বিভিন্ন বর্ণের রঞ্জিত কাগজের পাশাপাশি ঘনসংবদ্ধ অবস্থান থেকে জেগে উঠেছে বর্ণিল আলোড়ন। সাবা হাসান তাঁর ক্যানভাসে তৈরি করেছেন ত্রিমাত্রিকতার বুনোট। পরিপূর্ণ জ্যামিতিক বিমূর্ততার একমাত্র দৃষ্টান্ত শোভা ব্রুটার ‘পেজেন্স’ শীর্ষক ক্যানভাসটি। এ ছাড়াও ছিলেন যোগেশ রাওয়াল ও রাম পালানিপ্পন। |
|