পুজোর মরসুমে নতুন আধুনিক বাংলা গানের বাজার অনেক দিনই পড়তি। এ বারে সেই বাজারে নতুন করে জাঁকিয়ে বসেছেন খোদ রবীন্দ্রনাথ। এক দিকে আধুনিকের মরা গাঙ, অন্য দিকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভরা জোয়ার। সুতরাং জয় মা বলে সেই খাতেই তরী ভাসাচ্ছে সিডি কোম্পানিগুলো।
গত বছরেও যে সব সিডি কোম্পানি কিছু কিছু আধুনিক গান বাজারে ছেড়েছিল, তাদের অনেকেই এ বার পিছিয়ে গিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, খুব কমই আধুনিক গানের অ্যালবাম এ বার প্রকাশিত হচ্ছে। আশা অডিও-র দিব্যেন্দুশেখর লাহিড়ির যুক্তি, “এক একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবামের যা বিক্রি তার অর্ধেকও আধুনিক গানে নেই। চাহিদা না থাকলে পুজোর নামে এক গাদা সংকলন বাজারে ছেড়ে লাভ নেই।”
রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাজার অবশ্য চিরকালই তেজী। তার পরেও গত বছর পুজোর সময় থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিক্রি নতুন করে বেড়েছে। এ বছরেও তার কমতি নেই। দিব্যেন্দুশেখরের দাবি, “এই বছরে এতটাই চাহিদা যে আমরা আর অন্য কোনও গানের কথা ভাবতে পারছি না। ব্যবসাও অনেক বেড়েছে।” তাঁর হিসেবে গড়ে যেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিক্রি গত তিন বছর আগেও শতকরা ৩৫টি ছিল ,এখন তা শতকরা ৮৫-তে দাঁড়িয়েছে। ফলে পুজোর বাজারে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে আধুনিক গান। কথাটা অস্বীকার করলেন না ‘সারেগামা’র মুখ্য নিবন্ধক এস এফ করিমও। বললেন,“আধুনিক গানের চাহিদা অনেক কমে গিয়েছে, এটা সত্যি।” সেই বিক্রির অভাব মিটিয়ে দিয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীতই। পাশাপাশি করিমের দাবি, নতুন গান সাড়া না ফেললেও পুরনো আধুনিক গানের একটা বড় চাহিদা এখনও আছে। স্বর্ণযুগের গান এ বারও নতুন
মোড়কে বেরোচ্ছে। পুজোর দিনগুলিতে এখনও শতকরা ১২ শতাংশ শ্রোতা পুরনো গানগুলি তাঁদের পছন্দের তালিকায় রাখছেন।
আশির দশকের পর থেকেই পুজোর গান তার জৌলুস হারিয়েছে। প্রবীণ শিল্পীদের মধ্যে এই নিয়ে ক্ষোভ আগেও ছিল এখনও আছে। কেউ কেউ বলছেন, “যথেষ্ট চর্চার অভাব। শিল্পীর সঙ্গে গীতিকার ও সুরকারের কোনও সমন্বয় নেই।” দায় এড়াতে পারেন না শিল্পীরাও। প্রবীণ শিল্পী হৈমন্তী শুক্ল যেমন সরাসরি বললেন, “শ্রোতারা ঠিক কী চান, তা বোঝার মতো অভিজ্ঞতা অনেকেরই নেই। চটজলদি গানে দরদ থাকে না। গানের প্রতি আত্মবিশ্বাসও কম।”
তবুও বৈচিত্র আনতে চেষ্টা করেছেন কয়েক জন শিল্পী। যেমন? অনসূয়া চৌধুরীর গানে সুর দিয়েছেন বাংলা ব্যান্ডের কেউ কেউ। গান লিখেছেন তিলোত্তমা মজুমদার। অন্য দিকে মনোময়ের গানে সরাসরি বাউলের প্রভাব। কিন্তু সার্বিক ভাবে আধুনিক গানের চাহিদা অনেক অনেক কম। সেটা উপলব্ধি করেই কোম্পানিগুলো মুড়ি-মুড়কির মতো অ্যালবাম বের করার রাস্তা থেকে পিছিয়ে এসেছে। ‘ধুম অডিও’র রূপল কবিরাজ পুজোর গান নিয়ে আলাদা করে কিছু ভাবেনইনি। কেন? তাঁর মতে, এখনকার শ্রোতারা গান সম্পর্কে দারুণ সচেতন। “আমরা মাত্র কয়েকটি সংকলনই বাজারে ছেড়েছি। তার মধ্যে আধুনিকের সংখ্যা কম।” পুজো আসার অনেক আগেই ‘সাগরিকা’ বাজারে আনত নামী-অনামী শিল্পীদের আধুনিকের সংকলন। এ বার ব্যতিক্রম। ‘সাগরিকা’র দীপাঞ্জন সাহা বললেন, “এ বার প্রকাশিত সংকলনের সংখ্যা অনেক কম। তবে রবীন্দ্রসঙ্গীত থাকছেই।”
কেন বাড়ল রবীন্দ্রসঙ্গীতের চাহিদা? সার্ধশতবর্ষ বলেই কি? শিল্পী থেকে শ্রোতা, সকলেরই বক্তব্য: রবীন্দ্রসঙ্গীত চিরকালের গান বটেই। সেই সঙ্গে আধুনিক গানের শূন্যস্থানও পূরণ করেছে তা। আগের বার পুজোতেও রবীন্দ্রসঙ্গীতই শ্রোতাদের শারদীয় আমেজকে পূর্ণ করেছিল। এ বছরেও সেই ধারা বজায় আছে। এ-ও যেন এক ‘পরিবর্তন’ এর হাওয়া। এমনটাই মনে করেন রূপঙ্কর। তিনি নিজে আধুনিক গানের কোনও সংকলন করেননি। কেন? “শ্রোতাদের মনে প্রাণে পরিবর্তনের হাওয়া। আধুনিক ছেড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত। দেখি না কোথায় গিয়ে থামে। তার পর না হয় ভাবব।” লোপামুদ্রাও সেই পথে হেঁটেছেন। আধুনিক গান থেকে এ বছর পুজোয় তিনি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। বললেন, “আমার আগেকার অনেকগুলি রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংকলন এ বার পুজোয় নতুন করে শোনা যাবে।”
দক্ষিণ কলকাতার সুপরিচিত সিডি ব্যবসায়ী পুজো এলেই নজরে রাখেন শ্রোতাদের চাহিদা কোন দিকে। গত এক মাসের পর্যবেক্ষণে তিনি বুঝতে পেরেছেন, “একেবারে নতুন প্রজন্ম এখনকার কিছু বাংলা ছায়াছবির গান পছন্দ করছেন। কিন্তু তার আগের প্রজন্ম রবীন্দ্রসঙ্গীত।” তিনি হিসেব দিলেন, “রবীন্দ্রজয়ন্তীতে যদি গড়ে ১৫০ রবীন্দ্রসঙ্গীতের সিডি বিক্রি হয়ে থাকে, পুজোর বাজারে সেই চাহিদা আরও বেড়েছে।” তাঁর বিস্ময়,
নতুন অনামী শিল্পীদের সিডিও বিক্রি হয়ে যাচ্ছে কোনও প্রচার ছাড়াই। বিভিন্ন রেকর্ডিং স্টুডিওগুলোর ছবিও তাই। বাইপাস সংলগ্ন এক স্টুডিওর কর্ণধার স্বরূপ পাল বললেন, “তিন শিফটেই কাজ চলছে। বেশির ভাগই রবীন্দ্রসঙ্গীতের।আধুনিকের সংখ্যা খুবই কম।” তবে উত্তর কলকাতার সিডি ব্যবসায়ী বলছেন, “বাংলার শিল্পীদের সঙ্গে কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, শান, অভিজিৎ, নাসিরুদ্দিন শাহ, অলকা ইয়াগনিকদের চাহিদাও কম কিছু নয়।”
পুজোকে ঘিরে বিদেশেও সাড়া ফেলেছেন রবীন্দ্রনাথ। ইউ ডি সিরিজের রাজকল্যাণ রায় বললেন, “তিন মাস আগে থেকেই প্রবাসীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, কিশোরকুমারের বিভিন্ন সময়ে গাওয়া গানের সংকলন।” তাঁর কাছেও বিস্ময়, “এ বছরে আধুনিক গানের বরাত প্রায় নেই-ই।” থাকবে কী করে? বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছেন রবীন্দ্রনাথই যে! |