সোনা, ফাটাফাটি লাগবে দেখে আয় ‘রংমিলান্তি’। সহজে টিকিট বিক্রি হয় এমন মুখ পোস্টারে পেলি না তো কী হল? ইন ফ্যাক্ট, খুব নামী স্টার-এর দরকারই পড়ল না রে এই ছবিটায়। ছবিটা দেখে তো মনে হল, বিখ্যাত-রা থাকলেই মুশকিল হত বরং। চরিত্রগুলো নিজের ‘শেপ’ না নিয়ে অভিনেতার ইমেজ তৈরি করে ফেলত হয়ত। শাশ্বত আর চূর্ণীর কথা আলাদা। ওরা যতটা না দামি অভিনেতা তার থেকে বেশি নামী অভিনেতা। বিশ্বাস কর, এই সিনেমার স্ক্রিপ্টই আসল রাজা। এ ছবি জীবনবোধের কত কঠিন কথা, এত সহজে বলে দিল যে হাসতে হাসতে ভাবছিলাম, সত্যি কেন মনে রাখি না জীবনটাকে সহজ ভাবলেই সহজ!
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আর একটি প্রেমের গল্প’ এত ভাল লেগেছিল যে ছবিটা দেখে এসে মাথায় ঘুরপাক খেয়েছিল দিন দশেক। ‘রংমিলান্তি’-ও ভাল লাগবে জানতাম। তবে এত ভাল লাগবে ঠিক সেই আশা করে যাইনি।
জীবনের একটা বড় সমস্যা‘সঠিক’ জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়াকারও কারও তো একজনও জোটে না। কিন্তু ‘রংমিলান্তি’র কমলিকার জুটে যায় প্রয়োজনের বেশি। সমস্যা! এ দিকে দিদি কমলিনীর সঙ্গে জামাইবাবুর সেপারেশন দেখে বিচলিত কমলিকা ঠিক করে জীবনসঙ্গীর আগে বন্ধু হওয়া দরকার, পরে স্বামী। ওরা ছোটবেলার পাঁচ বন্ধু একসঙ্গে বড় হয়েছে সমস্যাটা তাদের সামনে ফেলা হয়। বাকি চার জনই এগিয়ে আসে তাকে সাহায্য করতে। এ ক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন, বাকি চার জনই পুরুষ। সমস্যাটা শুরু হল ওখানেই। বোঝা গেল যে চারটি ছেলেই মনে মনে ভালবাসে ওকে। এ বার? কমলিকা বাছবে কাকে?
আবির্ভাব হল ‘অনু ঘটক’-এর। নামের সঙ্গে একটা ‘পম’ ছিল। তাকে বাদ দিয়ে ক্যাটালিস্ট হিসেবে ‘অনু ঘটক’ নামটা পছন্দ করল কমলিকার জামাইবাবু দীপজয় নিজেই। খুব আদরের শালির এ রকম একটা সমস্যায় অভিনেতা দীপজয় নিজেই বুদ্ধি করে মনোচিকিৎসক সাজল। বুদ্ধিটা যা বাতলালো তার নামই ‘রংমিলান্তি’।
আমরা কী কী খুঁজি একজন সঙ্গীর কাছে? কে কত সাহসী, তাৎক্ষণিক বুদ্ধি কী রকম? পকেটের ঠিক কী অবস্থা? বাবা হিসেবে কেমন হবে ইত্যাদি, ইত্যাদি। সেটারই একটা তালিকা বানিয়ে দিল ‘অনু ঘটক’ শালি কমলিকাকে। |
এইখানে দেখলাম কৌশিকের লেখা, পরিবেশনা এবং পরিচালনার কারিকুরি। জীবনের ঘটনাগুলোকে সাজানো, তার সঙ্গে গল্পটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, তাতে চার বন্ধু ডি জে, লাদেন, ঋক, আর টিটো, কে, কোন অবস্থায় কী ভাবে রিঅ্যাক্ট করবে, তাই দিয়ে ঠিক হবে কমলিকা কাকে কত নম্বর দেবে। প্রেমে সব কিছুই মধুর লাগে। কিন্তু কমলিকা যেহেতু চারজনকেই পছন্দ করে, খানিকটা ভালওবাসে, তাই বাছাইয়ের ব্যাপারে একটু সজাগ। কোনও একটা ঘটনায় একজন কী ভাবে প্রতিক্রিয়া দেখালে, অন্য জন কী করত বা করতে পারে, সেটাও কমলিকা মনে মনে হিসেব করতে থাকল। চিত্রনাট্যটাকে সাজানো আর সম্পাদক মৈনাক ভৌমিকের কাঁচির গুণ ফাটাফাটি। এই পুরো ব্যাপারটার মধ্যে প্রকাশ হল প্রত্যেকটি পাত্রর চরিত্র। তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড।
অসামান্য অভিনয় দীপজয়ের। ওরফে ‘অনু ঘটক’। ওরফে শাশ্বত। মেকআপটাও বেশ। ‘অনু ঘটক’কে প্রথম কয়েক সেকেন্ড দেখে ভাবতে হচ্ছিল এটাই শাশ্বত! গলাটাও এমন পাল্টেছে যে কে বলবে ওই জামাইবাবু দীপজয়। ইন ফ্যাক্ট, মেক আপ আর কস্টিউম সবারই খুব স্বাভাবিক। কোনও এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় না যে একটা সিনেমা দেখছি। আসল এক একটি চরিত্র যেন। সাবলীল, স্বচ্ছন্দ ব্যবহার, ঠিক ‘অভিনয়’ সুলভ অভিনয় নয়। আমি দু’শো ভাগ নিশ্চিত ওদের বয়সে আমি এত সাবলীল ছিলাম না। গ্যাদগ্যাদে, ভ্যানভ্যানে গ্লিসারিন দিয়ে চোখে জল, অভিনয়ের সেই দিন যে গেছে, এটা ভেবেই দারুণ লাগে আমার।
এই যে কমলিকাঅভিনয় করেছে ঋধিমা ঘোষ, ডি জে অভিনয়ে গৌরব চট্টোপাধ্যায়, লাদেনতানাজি, টিটোইন্দ্রাশীষ আর ঋকগৌরব চক্রবর্তী। এদের মধ্যে শুধু দু’জনকেই একবারে চিনতে পারবি। দুই গৌরব। দু’টো খ্যাতনামা অভিনেতা পরিবারের সন্তান। দু’জনেই দাদু এবং বাবার মান রেখেছে। চক্রবর্তীর অভিনয় একটু বেশি ভাল লেগেছে আমার। গৌরব চক্রবর্তী বেশ প্রতিশ্রুতিমান অভিনেতা। লাদেন মানে তানাজির ভীষণ সহজ অভিনয়, দেখলেই মনে হয় যেন প্রচুর বুদ্ধি, আবেগপ্রবণ, পকেট ফাঁকা।
টিটো (ইন্দ্রাশীষ) আর ঋধিমার (কমলিকা) আরও একটা ছবি লাগবে চূর্ণী এবং শাশ্বতর মতো পোড়খাওয়াদের পাশে দাঁড়াতে। ক্যামেরাটা চেনা, জানা, লেন্সটা বোঝা, একটু সময় তো লাগবেই রে। বিজ্ঞাপনের কাজ করা প্রকাশের ভূমিকায় রিঙ্গো, আর প্রমোটারের ভূমিকায় রাণা মিত্র, ছোট্ট হলেও খুব প্রয়োজনীয় দু’টি চরিত্রে খুব সুন্দর।
শিল্প নির্দেশক মৃদুলের কাজও বেশ, আর সিনেমাটোগ্রাফার গোপী ভগত খুব ভাল। খুব বেশি সাজানো ফ্রেম হলে কিন্তু ‘বিষয়বস্তুটা’ একটু মার খায়। তবে নির্মীয়মাণ একটা বাড়িতে বেশ কয়েকটা দৃশ্য ছিল, আর অ্যাডভেঞ্চার করতে যাওয়ার সময় আউটডোরে ছিল বেশ কিছু বাইরের এবং ভেতরের শট, ফ্রেমিং এবং লাইটিং দেখে বোঝাই যায় যে একজন দক্ষ সিনেমাটোগ্রাফারের কাজ।
সেই অর্থে ‘রংমিলান্তি’র গানও ছবির বিষয়টাকে ছাপিয়ে যায়নি। তিনজন সঙ্গীত পরিচালক, নীল দত্ত, অনুপম রায় আর বনি চক্রবর্তী বেশ আলাদা একটা স্পর্শ দিয়েছেআমার অবশ্য রাশিদ খানের ‘সাঁইয়া’ গানটাই সবচেয়ে ভালো লেগেছে।
দেখ, সত্যি কি খুব রং মিলিয়ে, নম্বরের হিসেব কষে জীবনসঙ্গী বাছা যায় সোনা? যায় না। কিছুটা পাওয়া যায় আর কিছুটা ক্ষমাঘেন্না করে নিতে হয়। কমলিনী বিচ্ছেদের পর প্রকাশকেই আবার বিয়ে করল কিনা, নাকি কমলিকা ওই চারজনের মধ্যেই কাউকে পেল, না কি একেবারে অন্য কাউকে বেছে নিল, এ সব কিছুই বলব না। দূর! সব বলে দেব নাকি তোকে? নিজে গিয়ে দেখ বাকিটা। তবে তুই যে দু’টো ঘণ্টা হাসতে হাসতে সব দুঃখ ভুলে যাবি, এ টুকু গ্যারান্টি আমি দিতে পারি।
না, কোনও বড় ব্যানার নয়। দীপ্তেন ফিল্মস প্রোডাকশন কী করে চিনবি, নতুন প্রযোজক, প্রথম ছবি, তবে ছবিটা দেখেই মনে হয় নাক-গলানো প্রযোজক নয়, আমি ঠিক চিনি না।
আমাদের ছেলেমেয়েরাও যেতে পারবে। একটা হাল্কা চুম্বন দৃশ্য আছেপ্রায় ‘না-এর সমান’টেলিভিশনে তার থেকে অনেক বেশি-ই দেখে ওরা। আসলে টিনএজারদেরই বেশি দেখা উচিত রে বিষয়টা তো এদের নিয়েই।
আর হ্যা।ঁ মাল্টিপ্লেক্সেও চলছে তো। মাল্টিপ্লেক্সে শুধু ইংরেজি আর হিন্দি ছবিরই ভিড় হবে? তোর বর অবাঙালি তো কী? কলকাতায় থাকে, আর বাঙালি নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চিনবে না? তা-ও তো ভাগ্যিস, ‘অটোগ্রাফ’-এর পর মাল্টিপ্লেক্সে প্রসেনজিৎকে দেখলে টিকিট কাটিস আজকাল। ‘ওর’ পরে কারা কারা প্রসেনজিৎ হবে ঠিক করবি না? |